কলকারখানার বেহালদশা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২১, ১৩:৪৪ |  আপডেট  : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৫২

খবরটি পাঠে চোখ ছানাবড়া হবে না এমন কেউ আছেন বলে মনে হয় না। ১৫ জুলাই সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে শিল্প-কারখানার সংখ্যা ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি হলেও এগুলোর পরিদর্শনের জন্য রয়েছেন মাত্র ৩২০ জন পরিদর্শক। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ১ কোটি ৪১ লাখ চার হাজার ৭৫৩জন শ্রমিক। এই বিপুল সংখ্যক কারখানা ও শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করা মাত্র ৩২০ জন পরিদর্শক দিয়ে কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ড এবং তাতে ৫২ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে শিল্প সেক্টরে কত অনিয়ম অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান। ওই কারখানাটিতে না ছিল জরুরি নির্গমনের পর্যাপ্ত পথ, না ছিল অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা। কর্মরত শ্রমিকদের বীমা করার বিধান থাকলেও তা প্রতিপালিত হয়েছিল কি না তাও জানা যায়নি। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিল্পমালিক তাদের কারখানা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি খুব একটা আমলে নেন না। এ বিষয়ে যেসব আইন রয়েছে, তাও তারা প্রতিপালন করতে চান না।

উল্লিখিত রিপোর্টটিতে পরিদর্শনের যে চালচিত্র উঠে এসেছে, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। একজন পরিদর্শকের পক্ষে সারা বছরে একবার করে হলেও ৭ হাজার নয় শত চল্লিশটি কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করা যে সম্ভব নয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। মূলত এই জনবল সংকটের কারণেই সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) পক্ষে সঠিকভাবে ওগুলো পরিদর্শন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বহু কলকারখানা বছরের পর বছর অপরিদর্শিত থেকে যায়; যে কারণে বিভিন্ন সময়ে ছোটবড় নানা দর্ঘটনা ঘটে। আর দুর্ঘটনা ঘটলেই তা নিয়ে কয়েকদিন হইচই হয়, তারপর সবকিছু যথাপূর্ব তথা পরং।

কলকারখানায় দুর্ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। এর আগেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু যে কারণে এসব দুর্ঘটনা, সেসবের প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ কখনোই পরিলক্ষিত হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কিছু নগদ নারায়নের বিনিময়ে কগজ-কলমে তাদের কারখানা পরিদর্শনের সনদপত্র পেয়ে যান। কারখানাগুলোতে বিরাজ করে এক অরাজক পরিস্থিতি। কেবল মাত্র পোশাক শিল্পে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তাও বিদেশি ক্রেতাদের দুটি জোট অ্যাকর্ড ও এলায়েন্সের কঠোর নজরদারির কারণে। তাই অনেকেই মনে করেন, আমাদের সরকার যদি অ্যাকর্ড-এলায়েন্সের মতো সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টিতে যথাযথ গুরুত্বারোপ করে, তাহলে অবস্থার উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

১৩ জুলাই সমকালের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের কলকারখানোয় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটলেও সে প্রেক্ষিতে দায়ের করা মামলার বিচার শেষ হয় না। ২০১২ সালের ২৪ নাভেম্বর সাভারের আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে আগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহত হন ১১২জন শ্রমিক, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক, ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকায় টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় আগুন লেগে মারা যায় ৪২ জন শ্রমিক। এর আগে ২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল সাভারে স্পেকট্রাম্প নামের একটি নয়তলা পোশাক কারখানা ধসে নিহত হয়েছিল ৭৩ জন শ্রমিক। এসব ঘটনাায় মামলা দায়ের হলেও সেগুলোর বিচার প্রক্রিয়া আজও শেষ হয়নি। ‘জাস্টিস ডিলেড, জাস্টিস ডিনাইড’ বলে যে প্রবচনটি রয়েছে, তার যথার্থতা প্রমাণ হয় উল্লিখিত মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়া থেকে। বিচার প্রক্রিয়ার এই অকারণ দীর্ঘসূত্রতা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারগুলোর ন্যায় বিচার পাওয়া একরকম অনিশ্চিত করে তুলেছে। একই পত্রিকার ১৪ জুলইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরান ঢাকার ৪৪ এলাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেখানে ছোটবড় মিলিয়ে অন্তত তিন হাজার ৫০০ টি রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ ও বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্যের গোডাউন, কারখানা ও দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০১ টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

বিল্ডিংকোড না মেনে ভবন তৈরি করা, অবৈধভাবে সেসব ভবনে কেমিক্যাল কারখানা স্থাপন ও গোডাউন গড়ে তোলায় এ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ২০১০ সালে নিমতলী অগ্নিকান্ডে ১২৪ জন, ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় ৭১জন এবং চলতি বছরে আরমানিটোলায় আগ্নিকান্ডে চারজনের মৃত্যু হয়। এসব দুর্ঘটনার পর সরকারি বিধি না মানা নিয়ে শোরগোল পড়ে গেলেও পরবর্তীতে তা নিয়ে আর কোনো কথাবার্তা শোনা যায়নি। পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন ও কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কতদূর তা এখনও অজানাই আছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে বিল্ডিংকোডসহ সরকারি বিধানসমূহ সঠিকভাবে প্রতিপালনে গাফলিতি এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরের উদাসীনতা এসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনা প্রধান কারণ।

 রোগের কারণ নির্ণয়ের পর যদি কার্যকর ওষুধ বা প্রতিষেধক প্রয়োগ করা না হয়, তাহলে রোগের প্রকোপ আরো বৃদ্ধি পায়। ভবন নির্মান, করাখানা ও গোডাউন স্থাপনে সরকারি বিধিমালা সঠিকভাবে প্রতিপালিত না হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ও নীরিহ শ্রমিকদের প্রাণহানী ঘটতেই থাকবে। আমরা মনেকরি, শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে ছোটবড় সব শিল্পকারখানায় সরকারি বিধি সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কি না সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি আবশ্যক। আর সেজন্য ডিআইএফডির লোকবল বৃদ্ধি করা অতীব জরুরি। সরকারকে এ বিষয়ে যথাযথ দৃষ্টি দিতে  হবে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত