একজন সুজাতা দেবী

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২১, ১৮:২৩ |  আপডেট  : ২ মে ২০২৪, ২২:৪৭

আজ অনেক বছর পর সুজাতা দেবী নিজের ঘর ছেড়ে ছাদে উঠার সিঁড়িতে পা রাখলেন। কেন হঠাৎ মনের  এই নিছক পাগলামী কে জানে? বহুকাল তিনি নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেছেন নিজের গড়া জগতের মধ্যে। নিজের শোবার ঘরখানা আর লাগোয়া বারান্দার ছোট্ট পরিসরে। অথচ প্রাসাদোপম বিশাল বাড়িখানায় ঘুরতে অনেক সময়ের দরকার। সুজাতা দেবীর কস্মিনকালেও ইচ্ছে জাগেনি দেখবার। হয়তো এ বাড়ির লোক গুলোর কাছে  তিনি আপন হতে পারেন নি বলেই। রাজপ্রাসাদে আজীবন তিনি অতিথি হয়ে কাটিয়ে দিলেন। জীবনের বয়স প্রান্তসীমা ছুঁইয়েছে। চেনা মুখগুলো আজ আর নেই। যারা আছে তাদের সুজাতা দেবী চেনেন না। তাদের ও মুখ দেখাতে ভয়।পাছে দেনা পাওনার হিসেব উঠে।মনে মনে হাসেন তিনি।পৃথিবীতে তাঁর মত অচেনা আরও কি কেউ আছে? এমন কি তাঁর সবচাইতে কাছের মানুষ তিনিও  সুজাতা দেবীর মনের কাছে যেন চিরকাল বোবা মন নিয়ে বাস করে গেল।ভাবতে ভাবতে সুজাতা দেবী একটি একটি সিঁড়ি ভাঙে আর স্মৃতির ছেঁড়া টুকরো তাঁকে আন্দোলিত করতে থাকে।

বনেদী বাড়ি বলতে যা বোঝায়, এ বাড়ি কিন্তু তা নয়। শুধু প্রাচুর্যের চরম প্রকাশ মাত্র।বনেদী বাড়ির যে আভিজাত্য থাকে তা এ বাড়িতে নেই।আছ শুধু আত্মম্ভরিতা মাত্র।তার শ্বশুর অর্থের দাপটে তা কিনে নেবার প্রয়াস চালান প্রতিনিয়ত।ঠিক সেইভাবে তাকেও কিনে এনেছেন রূপের আরেক প্রদর্শনের অহংকারের নিমিত্তে।নইলে সুজাতা দেবীর শিক্ষক পিতার কন্যাকে কখনোই পুত্রবধু করে আনতেন না।বাবা কেন যে জীবনে এই চরম ভুলটা করলো সুজাতা আজও হিসাব মেলাতে পারেনা।বাবার তো অর্থের  প্রতি কখোনই লোভ দেখেনি।বরং বলতেন দারিদ্রের সাথে বসবাস করা যায় কিন্তু শিল্পবোধ শূন্য লোকের সাথে কখনোই নয়।হয়তো মায়ের কথাই ঠিক।কপালের লেখা কেউ মুছে দিতে পারেনা।কত যত্ন করে বাবা তাকে শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্র প্রজ্বলনের চেষ্টা করেছেন।তার প্রতিটির আলোই একে একে নিভে গেছে এ বাড়িতে এসে।আজো তার মনে পড়ে ভোরবেলা নতুন বৌ বেশে স্বামীর হাত ধরে যখন এই বিশাল বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছিল বুকে আনন্দের ঝংকার উঠেনি।তার পরিবর্তে এক অজানা আশংকায় কেঁপে উঠেছিল। নির্ভরতা পেতে চেয়েছিল স্বামীর হাত ধরে।আশ্রয় ও পরম মনে হয়নি।জীবনের সেই অনুভূতিই পরম সত্য হয়ে গিয়েছিল, ফুল শয্যার রাতে। নীলাদ্রিকে নিয়ে ছাদে উঠতে চাইলে অনেকটা নিমরাজী হয়ে তার কথা রেখেছিল। সেদিনও ছিল এমন আষাঢ়ী পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে যেন পৃথিবী।সুজাতা খুব চাইছিল নীলাদ্রি তাকে গান করতে বলুক।কিন্তু নিলাদ্রী তার ধারে কাছেও নেই। কানে লাগানো আই ফোন।ইংরেজী মিউজিকের সাথে দোল খাচ্ছে শরীর।উপযাচক হয়ে সুজাতাই বলে একটা কবিতার লাইন বল।এমন ভান করলো যেন এর চাইতে বিরক্তিকর আর কিছুই হতে পারেনা। সেদিনই সুজাতা বুঝে গিয়েছিল তার ভালো লাগার সমাধি এখানেই হয়ে গেছে।

মেয়েদের নাকি যে পাত্রে রাখা হয়, সে পাত্রের আকার ধারন করে। কত বড় প্রহসন এ সুজাতা দেবীর মত করে কে বুঝেছে? এ সংসারটা যে এক বিশাল রঙ্গমঞ্চ আর প্রত্যেকেই তার কুশীলব। মেনেই যদি না নেয়, তবে জগৎ সংসার চলবে কেন? সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে, এটুকু অভিনয় যে করে যেতে হবেই। কিন্তু সে শুধুই মেনে নেয়া মনে নেওয়া নয়। যদি অন্তর্লোকে সহানুভূতির আলোকে দেখা হয়, তবে এ বোধদয় হওয়া কঠিন কিছু নয়। তবে সুজাতা দেবী যে অভিনয় করছেন না এ সবাই জানে। একটা সুক্ষ বিপরীত রেখা অলিখিত ভাবে টানা হয়ে গেছে এ বাড়ির প্রত্যেকের সাথে। যা কখনই আর মুছা যাবে না। দ্বিরাগমনে সুজাতা বাবার মুখোমুখি হতেই বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই মনস্থির করে ফেলেছিল। যাই হোক, তাকে সুখী মানুষের অভিনয় করে যেতেই হবে।

নীলাদ্রিকে খারাপ কিছুতেই বলা যায় না।সে তো কখনে সুজাতা দেবীর সাথে এমন কিছু আচরন করেনি যে সংসার করা যায় না।কিন্তু রূচি বোধের এত বিশাল দূরত্ব আর নিজের জগত থেকে এক বিন্দুও ছাড় দিতে অরাজী এই মানুষের সাথে কতটুকু হাঁটা যায়? কখনো জানতে চায়নি, সুজাতা কি চায়? অর্থের প্রাচুর্যে সব ঢেকে দিতে চাওয়া মানুষকে কি ভাবে বোঝাবে এর বাইরেও একটা জীবন আছে। বলেনি তাই। দুজন দুজনের মত করে এক সমুদ্রে দুই দ্বীপের মত করে কাটিয়ে দিয়েছে জীবনের সব দিনগুলো।জাগতিক নিয়েমে তার দুই সন্তানও এলো পৃথিবীতে। ওরাও সুজাতার মত হয়নি। না হোক, কি করেই বা হবে? ওরা যে ভালোবাসার সন্তান না, কামনার সন্তান। ভালোবাসার সন্তানদের মত মানবিক দিকগুলো কামনার সন্তানদের থাকে না।

আজ চার যুগ পরে সুজাতা দেবীর আবার কেন যে ছাদে উঠতে ইচ্ছে হল কে জানে? মনের যে কত রকম পাগলামী থাকে? এমন পাগল মন বয়সের ধার ধারে না। সবার জীবনও কত বিচিত্র! কত কিছুই অজানা রয়ে যায় পৃথিবীতে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে ছাদে উঠে এলেন।ছাদ এখন তাঁরই মত বিবর্ণ। তবুও ভালো লাগে।ছাদ বাগানের পাশে বেতের চেয়ারখানা টেনে নিয়ে বসলেন।এখন ভোরের আলো ফুটিফুটি করছে।দিনের মাহেন্দ্রক্ষণ বড় পবিত্র থাকে এ সময়টা। মানুষের মনও। এই যে যাদের নিয়ে তাঁর এই ভাবনা আজ আর তাদের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই, আক্ষেপ নেই, অভিমান নেই। বাবা বলতেন পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আসে। কেউ আসে দিতে আর কেউ নিতে।যারা দিতে আসে তারা সৌভাগ্যবান। অঋণী হয়ে বিদায় নিতে পারাটাই যে মুক্তিরপথ। সুজাতা দেবীর দুই ছেলে। দুজনই বিদেশে। মাসের দুবার ফোন করে মায়ের খবর নেয়।এর চাইতে বেশি তাঁর চাওয়াও নেই।নীলাদ্রি চলে গেছে ছয় বছর। রোগশয্যয় একবার বলেছিল, বাবা তোমাকে এ বাড়িতে এনে অন্যায় করেছে।মৃদু হেসে সুজাতা দেবী বলেছিলেন এর চাইতে খারাপ বাড়িতেও তো যেতে হতে পারতো।আর কিছু বলেনি।মনে মনে সুজাতার নীলাদ্রির প্রতি অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো, যাকে কিছুতেই ভালোবাসা বলা যাবে না। এক একজনের সাথে এক এক রকম সম্পর্ক গড়ে উঠে যা চিরকালীন কিন্তু সবার অনুভবে ধরা দেয় না।মাথাটা কেমন দুলে উঠল।সাথে ঘুম ঘুম ভাব। শরীর জুড়ে অস্বস্তি। মৃত্যু কি সমাগত। সুজাতা দেবী বিড় বিড় করে বলছে "কা তব কান্তা কাস্তে পুত্রঃ...

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত