একজন আরজ আলী

  মালিহা পারভীন 

প্রকাশ: ৪ মে ২০২১, ১২:০২ |  আপডেট  : ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫১

ফাইল ছবি

আরজ আলী। বয়স চৌষট্রি বা পঁয়ষট্টি হবে । ছিলেন সরকারী প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। বছর সাতেক অবসরে গেছেন । স্ত্রী নাজমা বেগম কিডনী জটিলতায় ভুগে মারা গেছেন তাও প্রায় দশ বছর হলো । তাদের দুই মেয়ে আমেরিকায়।  বিয়ে করে ওখানেই থিতু হয়েছে। কালেভদ্রে ওরা দেশে আসে। ফোন করে মাঝেমধ্যে । নাহ, বাবার জন্য তাদের মন কেমন করে সে কারনে নয়। ওরা  মোবাইলে বাবার অনেকগুলো মিসড কল যখন দেখে তখন সময় করে একটা কল দেয়। আরজ আলী তাঁর অখণ্ড অবসরে মোবাইল  কি করবে কি করবে ভাবতে ভাবতে হাতের মোবাইলে মেয়েদেরকে হরহামেশা কল দিয়ে বসে।  ছেলেকেও ফোন করে। ছেলে অবশ্য কখনো তাকে কলব্যাক করেনি । ছেলে কর্পোরেট অফিসের ডাকসাইটে কর্মকর্তা।  ব্যস্ততার শেষ নেই। তবুও সে কখনো তার স্ত্রী অর্থাৎ  ছেলে বউ রুমার মাধ্যমে বা বাসার সহকারীর কাছে বাবার খোঁজ খবর নেয়।

জুম্মার দিনে,  ঈদের জামাতে ছেলে বাবাকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়তে যায়। নাতি আরিজ আর ছেলের সাথে যখন আরজ আলী একসাথে যায় তখন  মন তার আনন্দে ভরে উঠে।  বউমা তিনজনের একরকম পাঞ্জাবীও  কিনে দেয় কোনো ঈদে বা পহেলা বৈশাখে। নাতিকে দিয়ে  আরজ আলী ছবি তুলে রাখে। কখনো ফেসবুকেও  দেয়।  তাঁর সৌভাগ্য দেখে বন্ধুরা তাকে হিংসে করে।

আরজ আলী থাকে তাঁর একমাত্র ছেলের বাসায়। ছেলের বাসায় বললে ভুল হবে। বরং তার বাসায় ছেলে থাকে।  ছেলের বউ রুমা আর তেরো বছর বয়সী নাতি আরিজ - এই নিয়েই এখন তার পরিবার। মোহাম্মদপুরের আদাবরে এই এপার্টমেন্টটা আরজ আলী চাকরী থাকাকালীন গিন্নীর জেদে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে কিনেছিলেন।

স্ত্রী মারা যাবার পর এটাকে আর নিজের বাড়ি মনে হয় না আরজ আলীর ।  আর কখনো যদি আচরনে তা প্রকাশও পায় তাহলে বরং অস্বস্তি হয়। ছেলের বউ নিজের পছন্দ মতন নতুন করে বাড়িটা সাজিয়েছে। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে ' আমার'  শব্দটার কাছে আত্মসমর্পণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আরজ আলীও তাই করেছেন। আমার বাড়ি, আমার সংসার এ কথা মনেও হয় না এখন তার । কোনোমতন বাকি দিনগুলি পার করে দিতে পারলেই বেঁচে যান। স্রোতে গা ভাসিয়ে চলা আর কি। আজকাল  সন্তানদেরও কেমন অন্য গ্রহের অন্য মানুষ মনে হয় তার।

আরজ আলী ফজর নামাজ সেরে চন্দ্রিমা উদ্যানে হাঁটতে যান নিয়মিত।  এই সময়টুকু তার একান্ত নিজের। খোলা আকাশ, সবুজ, পথ, মানুষ! বেশ লাগে। এখানে প্রায় সমবয়সী মানুষগুলোর সাথে আরজ আলীর পারস্পরিক বোঝাপড়া বা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে হাঁটার পর তারা একসাথে কোথাও নাস্তা করেন, আড্ডা দেন । সবার বয়স ও রোগ কাছাকাছি। সবার গল্পও প্রায় একরকম।

আরজ আলীর তেমন কোনো নির্দিষ্ট সখ  নাই।  তবে দু পাতা একপাতা নিয়মিত ডায়েরি লিখে সে । ছাত্র জীবনের অভ্যাস। যদিও ফেসবুকিং আর জি বাংলার সিরিয়াল দেখে ইদানীং ডায়েরি লিখায় কিছুটা ছেদ পরছে।

আজ সকালে ঘরে ফিরে ডায়েরি নিয়ে বসেন তিনি। সাইড টেবিলে নাস্তা ঢাকা দেয়া আছে। সেই রুটি,  সবজি বা বুটের ডাল। খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।  নাজমা বেগমের কথা মনে পরে। কি যত্ন করেই না তাকে খাওয়াতেন ! তবে ভাত খাবার সময় নিজ হাতে লেবু চিপে দিত।  এ দৃশ্যটা খেতে বসলে চোখে ভাসে। আরজ আলী দীর্ঘশ্বাস ফেলে।  বেঁচে থাকতে এই ভাললাগার কথাটা বলা হয়নি এতোদিন একসাথে সংসার করা নিজের স্ত্রীকে। নেহায়েত পুরুষালী ইগো হয়তো । এই ইগো জিনিষটা না থাকলে বোধকরি সব সংসারেই শান্তি থাকতো ।

আজ লিখা আসছে আরজ আলীর মাথায় । তার কলম দ্রুত চলছে। লিখছেন জীবন চক্র, জীবন প্রবাহ নিয়ে নানান ভাবনার  কথা। দরজায় ছায়া দেখে তিনি চোখ তুলেন। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে তার নাতিটা এসে দাঁড়িয়েছে। দাদুর ডায়েরি নিয়ে নাতি আরিজের সবসময় ভীষন কৌতূহল। মাঝে মাঝে তাকে পড়ে শোনাতে হয় কি লিখলেন তিনি। কলম বন্ধ করে আরজ আলী তিনি  নাতিকে কাছে ডাকেন।  বিছানায় বসেই দাদুর মোবাইল নিয়ে শুরু হয় তার গেইম খেলা। স্বল্পভাষী হলেও খেলার ফাঁকেফাঁকে সে তার দাদার সাথে টুকটাক কথা বলতেই থাকে। একসময় প্রতিদিনের মতন আরীজ আজোও শুনতে চায়  ডায়েরীতে আজ কি লিখা হয়েছে ।  বুঝুক না বুঝুক শুনুক না শুনুক নাতি আরিজের এই আগ্রহটুকুর জন্যই আরো লিখতে ইচ্ছে করে আরজ আলীর।  
আরজ আলী ডায়েরীটা খুলে পড়তে শুরু করেন --

" মানুষের জীবনের শুরুতে একটা সময় থাকে যখন জীবন হয় শুধু যোগ অংকের । প্রতিষ্ঠান, পেশা, বাবা মা ভাই বোন নানা-নানী, দাদাদাদী স্বজন বন্ধু, সহপাঠী অথবা ভালবাসার একান্তজন । তারপর কর্মজীবন। সফলতার চাবি হাতের মুঠোয় ধরার নিরন্তর চেস্টা। সংসারী হয় সে । যোগের হিসাব নানা বৈচিত্রে পূর্ণতা পায়। নিজের ঘর,  জীবনসংগী, সন্তান, আত্মীয়, প্রতিবেশী-  ভরভরন্ত জীবন ! সময় পরিক্রমায় সূর্য তখন মাথার উপর!

এরপর কখন যে জীবন পাতায় বিয়োগ অংক জায়গা করে নেয়। প্রকৃতির নিয়মে একে একে চলে যেতে থাকে পূর্বসূরীরা।  নানানানী, দাদাদাদী পর্ব শেষে মা বাবা খালা ফুফু মামা  চাচাদের যাবার পালা।

আঁচল ধরা সন্তানরা ঘর ছেড়ে  পিছনের পথ পিছনে ফেলে ওরা এগোয় । আর সন্তানরা যদি বিদেশমুখী হয়  তবে সব পাখি ঘরে ফিরলেও তারা আর ফিরে আসে না দেশে গাদাগাদি করে থাকা ঘরগুলি, কাপড়ে ঠাসা আলমারি, জুতার ড্রয়ার,  খাবার টেবিল ঘেরা চেয়ার -- ফাঁকা  হতে থাকে।

একসময় কর্মজীবনের ছুটাছুটি  ফুলস্টপে এসে থামে। হঠাৎ পাওয়া হাতের মুঠোয় বেহিসেবি  সময়।  এতোদিনের ঘড়ির কাঁটায় চলা অভ্যাস, কিছুটা অর্থনৈতিক টানাপোড়েন অনেককে একধরনের হতাশায় নিমজ্জিত করে। তবে এই পরিবর্তনকে মানিয়ে নেয়াই মংগলজনক । 

এতোদিনের খেয়াল না রাখা নিজের শরীর উচ্চ রক্তচাপ বা অতিরিক্ত শর্করার নোটিশ ঝুলিয়ে  অস্তিত্বের জানান দিতে থাকে ।  সকালে অফিস ছুটে যাওয়া  কর্তাব্যক্তিটি ও  এতোদিন চারদেয়ালে বন্ধ গৃহিনী  কেডস কিনে পার্কে হাঁটতে বের হয়ে পরে । পার্কে এসে মিলে নতুন বন্ধু যাদের জীবনেও পড়েছে  পড়ন্ত সুর্যের ছায়া। বাড়িতে রান্নার আয়োজন সংক্ষিপ্ত হয় । সামাজিকতা কমে আসে।  

ওশুধ আর ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে ভরে যায়  টেবিল। দরজায় কলিংবেলের শব্দ আগের মতন আর বাজে না।  সন্তানের চেয়ে মোবাইল ফোন, টেলিভিশন বেশি প্রয়জোনীয় মনে হয়। এরা সময় কাটাতে সাহায্য করে, একাকিত্ব দূর করে। ধর্মকর্ম, পত্রিকা পড়া , গ্রামের বাড়ি , সমাজসেবা বা সমাজ নিয়ে থাকতে আগের চেয়ে ভালই লাগে। বয়স কালের সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ, রাগ, ভাবসাব মিইয়ে আসে। নিদ্রাস্বল্পতার ঘুম ভাঙা রাতে হঠাৎ চাওয়া পাওয়ার হিসাব কষে মন। জগত সংসারের  প্রতি জমা হয় শীতল অভিমান।  কেউ নিজেকে গুটিয়ে নেয়, কেউ নিস্পৃহতার পাহাড় গড়ে।

মৃত্যূর জন্য অপেক্ষার মধ্যে শুরু হয় বদলে যাওয়া  পারিপার্শ্বিকতার  সাথে মানিয়ে নেয়া। সমর্পনের চেস্টা।  ঘরদোরে ঝুল জমলে, জায়গার জিনিষ জায়গায় না পেলে, তরকারীতে লবন বেশি হলে  আগের মতন আর মেজাজ তিরিক্ষি হয়  না। আত্মজ, জীবন সংগীর এমনকি ঘরের সহযোগীর তিক্ত কথার বর্ষন না শোনার ভান করে দিব্যি এড়িয়ে যাওয়া যায়।  যারা একসময় তার উপর নির্ভরশীল ছিল , যারা তার সামনে নতজানু হয়ে থাকতো তারাই এখন  আর আগের মূল্যায়ন করছে না, তার কোনো মতামত গ্রহন করছে না। তাতেও সে আর কষ্ট পায় না।

বার্ধক্যে এসে জীবনদর্শন পাল্টে যায় ।মৃত্যুভয় ভর করে চিন্তা চেতনায় । শরীর ও মনের সচলতা কমে আসে। ডাক্তারের কাছে চেক আপে যেতে আগের মতন আর ভূল হয় না। নিষ্ক্রিয়তায়, স্থবিরতায় নিজেকে মাঝেমধ্যেই সংসারে  অপাংক্তেয়, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। কখনো সন্তানদের স্বার্থপরতা জীবনের প্রতি জাগায় আরো বিতৃষ্ণা ।

এখানেই যদি কারো জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ভাল। অথবা  কোনো এক সকালে যদি ঘুম থেকে আর না জাগে তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি ভাগ্যবান। আর দুর্ভাগা হলে  স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, আলঝেইমার, বাত বা অচল অস্থিমজ্জা নিয়ে বিছানায় নিজের বর্জ্যের গন্ধের সাথে সকাল সন্ধ্যা কাটানো ।  চারপাশের মানুষদের কপাল কুচকানো, মুখঝামটা,  করুণা তো আছেই !  ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুমের জাগতিক চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে উঠে যেতে থাকে মানুষ।ন তিনি সবার চরম বিরক্তির মধ্যে একদিন তিনি পুত্র কন্যা বা কারো ঘরে আস্রয় পান শেষের কটা দিন। অথবা কেউ আইসিইউর বিছানায় চিরতরে চোখ বন্ধ করেন। মৃত্যূর পর  ঘরভর্তি কান্নাকাটি কারো কপালে জোটে বা জোটে না। কারো জোটে একটু আধটু সামাজিক মৌনতা বা দীর্ঘশ্বাস।

এ তো গেল নন কোভিড মৃত্যুর কথা। এখন কোভিডে মৃত্যু মানেই যেন অপমৃত্যূ। অন্য সব যেন স্বাভাবিক মৃত্যু। হয়তো এখন এটাই একমাত্র রোগ যার কারনে কেউ তার কাছে ধারে ঘেঁষে না। মৃত্যুর আগেও না, পরেও না।  কেউ লাশ ধরে না, জানাজা দাফন থেকে দূরে থাকে শত হাত। সে তার যত আপনিই হউক না কেন!

আরজ আলী অবশ্য এইসব নিয়ে ভাবে না।  মারা যাবার পরে কে কাছে আসলো তার, কে আসল না তাতে মৃত ব্যক্তির কিই বা যায় আসে!  সে তো তখন সকল  কিছুর উর্ধ্বে।"
সে তখন অনন্ত যাত্রার যাত্রি । 

চোখ ঝাপসা হয়ে আসে বুঝি আরজ আলীর। তিনি ডায়েরীটা বন্ধ করে পাশে রাখেন ।  নাতি আরিজ  কি বুঝলো কে জানে! সে এসে দাদার  গলা জড়িয়ে ধরে -
' দাদু,  তুমি কিন্তু কোথাও যাবে না --'

আরজ আলীর অনেকদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। 

---
ঢাকা, বাংলাদেশ

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত