আলোকিত অন্ধকারের জনপথ

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২১, ২১:২৩ |  আপডেট  : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:১৫

শাশ্বত স্বপন
--------------------

 

মিটফোর্ড হাসপাতালে চাকুরিতে যোগদানের দিন, তারপরও আরো কিছুদিন বুড়িগঙ্গার বিষাক্ত পানির দুর্গন্ধে আমার বেশ কষ্ট হয়েছিল। ভাবতাম, আর সব মানুষেরা কিভাবে চলছে? কিছুদিন পর এই পরিচিত গন্ধ আমার নাকের ঘ্রান ইন্দ্রিয় স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে এবং আমি আর এখন গন্ধ পাই না। হাসপাতালে রোগীর ভীড় খুব বেশি, তার মধ্যে কেরাণীগন্জের রোগীই চল্লিশ শতাংশের বেশি। এখানে কোন কোন বিভাগের  বহিঃবিভাগের ডাক্তাররা দিনে দুইশ থেকে তিনশ জন রোগী দেখেন। বহিঃবিভাগের রোগীদের মধ্যে ষাট শতাংশ মুখ খোলা বোরকা পড়া, দশ শতাংশ মুখ ঢাকা বোরকা পড়া মহিলা এবং সাথে তাদের ছেলে-মেয়ে; দশ শতাংশ লুঙ্গি-শার্ট পড়া, আর বাকীরা লুঙ্গির সাথে গেঞ্জি বা গামছা, লুঙ্গির সাথে পাঞ্জাবী ও টুপী; অবশ্য কিছু রোগী শার্ট-প্যান্ট ইত্যাদি পরিধান করেও এখানে আসে। পরিধানের এই বর্ণনা দিয়ে বুঝাতে চাচ্ছি, এদের প্রায় সবাই অতি সাধারণ মানুষ, এ দেশের দারিদ্র আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এরা আচ্ছাদিত। এদের সবাই ধর্মভীরু। হাসপাতালের ঔষধের সাথে তাবিজ-কবচ, পানিপড়া, পীর-ফকির ইত্যাদিতেও এরা বিশ্বাস করে। যোগদান করার পর থেকে আমার মনে হয়েছে, আমি সতেরশ অথবা আঠারশ শতাব্দিতে এসে পড়েছি। রোগীরা খুবই সহজ-সরল এবং রোগ-বালাই সম্পর্কে এদের ধারণা হাস্যকর। দারিদ্রতা, অজ্ঞতা, অশিক্ষা, পারিবারিক অশান্তি-এদেরকে মনে হয়, একুশ শতকের আলোকিত অন্ধকারের জনপথে আবদ্ধ করে রেখেছে।
 
হাসপাতালের প্রথম গেটের গলি দিয়ে রোগী, রোগীর সাথী ও সাধারণ মানুষের যাতায়াত খুব বেশি। প্রথম গেটের গলি দিয়ে হাসপাতালের দক্ষিণ দিকের গেট পার হয়ে বুড়িগঙ্গা ঘাটে যাওয়া যায় এবং সেই ঘাট দিয়ে বিষাক্ত পানিপথ নৌকা যোগে পার হয়ে কেরানীগঞ্জ যাওয়া যায়। কোরবানী ঈদের আগের কয়েকদিন প্রথম গেটের গলি দিয়ে রোগী ও সাধারণ মানুষের যাতায়াত খুব বেশি দেখা গেছে। বিশেষ করে, ঈদের দুই দিন আগে নয়া বাজার হাটের গরু, ছাগল, মোটর গাড়ী, রিক্সা, ভ্যান আর মানুষের প্লাবনে প্লাবিত হয়েছে মিটফোর্ডের রাস্তা, হাসপাতালের গেট, বুড়িগঙ্গার ঘাট। হাসপাতালের প্রথম গেট দিয়ে ঢুকতে হাতের বাম পাশের ছোট ফুটপাতে সাড়ে তিন হাতের কম পরিমাণ জায়গার সাপের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে একটি কঙ্কালসার, অর্ধনগ্ন নারী গত কয়েকদিন ধরে পড়ে আছে। প্রায়ই দেখতাম, কিছু মানুষ উৎসুক হয়ে দেখছে, কেউ কথা বলতে চেষ্টা করছে। আমি নারীটির কাছে গিয়ে ভীড় করা মানুষের নানা কথা শুনেছি; নানা জন নানা ধরনের কথা বলেছে; কিভাবে সাহায্য করা যায়¬--তাও আমি শুনেছি তাদের নিজেদের মধ্যে কথোপকথন থেকে। আমিও ভীড় করা মানুষের একজন, দায়িত্ব এড়িয়েছি; তবে ভেবেছি,  শত শত ধর্মভীরু মানুষ, বোরকা পড়া রোগী,  তাদের সাথীরা অথবা কোন স্টাফ নিশ্চয়ই জরুরী বিভাগে নিয়ে যাবে।

সম্প্রদায়, বেদে গোষ্ঠী--এদের নিয়ে রাষ্ট্রের, রাষ্ট্র পরিচালকদের কোন মাথা ব্যথা নেই। এদের ভোট নেই, তাই এদের নিয়ে কারো কোন ভাবনাও নেই। এ দেশে ধর্মীয় শাখা-উপশাখা, ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল, ধর্মের নামে বা ধর্মীয় শব্দের নামে ব্যাংক, এনজিওর অভাব নেই,  যাদের ধর্মীয় স্বার্থে হলেও কিছু করা উচিত, উল্লেখিত অস্পৃশ্য, দলিত মানুষের জন্য এরা কিছু করে না বরং যার মাথায় তেল আছে, তার মাথায় আরো তেল দেয়। বিশেষ করে এনজিওগুলোর  বিরাট ভূমিকা থাকার কথা, কিন্তু তাদের নিজেদের আকাশ ছোঁয়া উন্নয়ন দেখলেই বুঝা যায়, তারা কাদের স্বার্থে কাজ করে। স্রষ্টার নামে যারা মাসের পর মাস ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে, ধর্মের বানী প্রচার করে;  পীর-আওলিয়া-মহাপ্রভু-মহারাজ-ফাদার-বুদ্ধ  এবং যাদের বিশাল শিষ্য বাহিনী-- তারা কি স্রষ্টার এই অবহেলিত আদম সন্তানদের চোখে দেখে না, তারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য যেভাবে কাজ করেন, সেভাবে কি তাদের জন্য কাজ করতে পারেন না?
 
 মাঝে মাঝে আমার খুব কষ্ট হয়, যখন ভাবি, এত মানুষ, এত সম্পদ, এত কোরবানি, এত আনন্দ, আবার মানুষের কারণে কত যন্ত্রণা, কত দুর্বিসহ ঘটনা ঘটে! একজন ডায়বেটিস রোগী, সারাদিনে আধা কেজি খাবারও খেতে পারে না অথচ কোটি কোটি টাকার সম্পদ তার। সম্পদ বাড়ানোর জন্য এ দেশের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, হেন কোন খারাপ কাজ নেই--যা তারা করে না। যদি এরা ধর্মানুযায়ী যাকাত আদায় করত অথবা সরকারী নিয়মে ঠিকমত ট্যাক্স দিত তাহলে এদেশের পথে পথে এ রকম নারীরা পড়ে থাকত না।
 
কেন যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করছে না--বুঝি না। মানুষরূপী কিছু মানসিক ভারসাম্যহীন--যাদেরকে খুব সহজ করে পাগল বলি; এরা আমাদের আশে পাশে থাকে বিড়াল কুকুরের মত ছন্নছাড়া হয়ে। ফুটপাতের সর্বহারারা তো তবুও ভিক্ষা বা কাজ এর মাধ্যমে খাবার চাইতে পারে। এরা তাও পারে না। কেউ এদেরকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না।
 
মানুষ, প্রকৃতির এ নির্মম খেলা থেকে কিছুই শিখে না। শিখে না ইতিহাস থেকে, শিখে না এ নিথর পড়ে থাকা মানুষরূপী, এ নারীটির জীবন থেকে। তবে এ কাজ থেকে একটা বিষয় বুঝতে পারলাম, সাধারণ মানুষরা কেউ একা একা জামেলায় জড়াতে চায় না। তবে মানবীয় গুণাবলী প্রকাশ করার সুযোগ সবাই চায়, সবাই তা খুঁজে, চায় একজন নেতা এবং তার নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব। এই যে আমি, নেতৃত্ব দিয়ে কাজটি শুরু করেছি, এখন সবাই যার যার সাধ্য মত কাজ করছে। আসুন, আমরা শুরু করি, আমরা জাগি, আমরা জাগলে, সবাই জাগবে, জাগবে বাংলাদেশ।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত