আমার স্মৃতিতে চিরসাথী নীলোৎপল
প্রকাশ: ৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৩২ | আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০৫
আমার শৈশব, স্কুল-কলেজ সেই ছায়াময়, মায়ের আঁচলে জড়ানো লৌহজং গ্রামেই কেটেছে। ইউনিভার্সিটি পড়ার সুবাদে ঢাকায় এসে ইডেন কলেজে মাস্টার্স শেষ করি। ভার্সিটি পড়ার সময় আমার বান্ধবী নীনার মাধ্যমে ১৯৯৩ইং সালে নীলোৎপল আর আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। এ বিয়েতে পিতার দায়িত্ব পালন করেছেন আমাদের সকলের প্রিয় শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হক। সেই মঙ্গলাচরণ থেকে শুরু করে বিয়েতে গ্রামে যাওয়া, ধানমন্ডিতে বৌভাত সবকিছুতেই ওয়াহিদ ভাইয়ের অগ্রনী ভূমিকা ছিল।
আমাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত লোক সংস্কৃতির অন্যতম জেলা ময়মনসিংহ তৎকালীন নেত্রকোনা ধোবাউড়ায় ১৯৫৫ইং সালের ৬ই ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণ করেছিল বাংলার প্রাচীন গানের ও রবীন্দ্রসংগীতের সাধক, শিল্পী, প্রশিক্ষক, পেশায় প্রকৌশলী আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ধন, আমার স্বামী নীলোৎপল সাধ্য।
সে ছিল একজন নিষ্ঠাবান, নিভৃতচারী রবীন্দ্র গবেষক। তাঁর বিশ্বাস ছিল "প্রচার নয়, কর্মই প্রধান, কর্ম করে যাও, ফলের আশা করোনা।" তাই তো সবসময় সে নিজেকে আড়াল করেই রাখতো।
নীলোৎপলের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভাবনা - "বাঙালি জাতির একজন আমি, এই কথাটি যখন নিজেকে শোনাই, তখন বিশ্বমানবের মধ্যে আমি সবচেয়ে গৌরব বোধ করি। কোন একটি জাতির আর কিছুই চাওয়ার থাকে না শুধু রবীন্দ্রনাথের মতো একজন মহামনবের উপস্থিতির কারণে। যুগ যুগ ধরে তিলে তিলে জন্ম নেয়া মহাপূণ্য ফলের সামগ্রিক রূপ রবীন্দ্রনাথ।"
নীলোৎপলের কর্মের পরিধি ছিল অনেক বিশাল। প্রায় চার দশক ধরে জেলা-উপজেলায় ঘুরে ঘুরে সহস্রাধিক প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করেছে। রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদ ছাড়া সে শিল্পকলা একাডেমীর সংগীত প্রশিক্ষক হিসেবে সেই ১৯৯৭-২০১৫ইং পর্যন্ত ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে সংগীত কর্মশালায় নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
তাছাড়া বিভিন্ন সময় ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক ও পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডেরও সদস্য ছিল। রবীন্দ্রনাথ ও পঞ্চকবির গানের ব্যতিক্রমী শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। টেলিভিশনে, বেতারে, শিল্পকলা একাডেমী, বাংলা একাডেমী সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জাতীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদ ও ছায়ানট শুদ্ধ সংগীত বিস্তার ও প্রসারে সমাজে নানা স্থানে ছড়িয়ে দেওয়ার যে অঙ্গীকার বহন করে, নীলোৎপল পর্যায়ক্রমে সেই জায়গা করে নেয় এবং প্রধান ভূমিকা পালন করে।
আমি অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি "নীলোৎপল বিশ্বাস করত মানুষের সাথে মানুষের মিলনকে সংস্কৃতির ভিতর দিয়ে পরিচালিত করতে পারলেই কেবল তৈরি হবে চেতনাবোধ। মানুষ হয়ে উঠবে সংস্কৃতিবান। বাঙালী সংস্কৃতির যা কল্যাণকর, যা জনহিতকর, সবকিছুই সে অন্তরে ধারণ করতো। তেমনি সকলের কাছে পৌঁছানোর প্রয়াসে বাংলাদেশের শহর, জেলা, উপজেলা, গ্রাম, প্রান্তর বিচরণ করে ঘরে ঘরে গিয়ে সংগীত ও সংস্কৃতির আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল। জীবন বাজি রেখে ক্রমে ওয়াহিদুল হকের প্রিয় ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠে। গুরুর প্রয়াণের পর আমৃত্যু নিষ্ঠার সাথে এ কাজ করেছে নীলোৎপল। অনেক গুণীজন তাকে ওয়াহিদুল হকের যোগ্য উত্তরসূরি ও রবীন্দ্রনাথের গানের ফেরীওয়ালা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
নীলোৎপলের বিশাল জ্ঞানের ভাণ্ডার ছিল, যা সমুদ্রের গভীরতার মত বিস্তৃত। তাই আমার প্রাণের এ মানুষটি জ্ঞানের অন্বেষণে সব সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখতো। বিয়ে প্রথম দিকে খুব মতনৈক্য দেখা দিত কিন্তু পরে দেখলাম আমার চাওয়া তো সাধারণ চাওয়া আর সে তো অসাধারণ এক মানুষ।
আমার ব্যক্তিগত জীবনে নীলোৎপল ছিল প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বাস, একজন দায়িত্ববান স্বামী। বাইরে যেমন সহজ সরল, ঘরে ঠিক তাই। আমাদের পরস্পরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল যে সে কোন দিন আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে নাই। তার কোন বিলাস-বাহুল্যতা ছিল না, লোভ ছিল না। আরও ছিল না অভাববোধ, যার জন্য চাকুরীর ক্ষেত্রে প্রোমোশনটা পর্যন্ত সে নেয় নি কারণ অফিসে ব্যস্ত হয়ে পরলে সংগীতে সময় দিতে পারবে না।
সে খুব ভোজন রসিক ছিল। খেত কম কিন্তু বাজার করতো বেশি। আমি তাকে কোন দিন খালি হাতে ঘরে ঢুকতে দেখি নাই। কোথায় কি খাবার বিখ্যাত সেটা তার নখদর্পণে ছিল। ঢাকার বাইরে গেলেই তার পছন্দের খাবারগুলো নিয়ে আসতো। এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়, চুয়াডাঙার খাসীর মাংস নাকি খুব বিখ্যাত। সে ওখানে প্রশিক্ষণ দিতে গেলেই দশ থেকে নয় কেজি ওজনের খাসীর মাংস ফ্রিজিং করে নিয়ে আসতো প্রায়ই।
আমাদের বাসভবনটি ছিল সংগীতের তীর্থস্থান। সবসময়ই রবীন্দ্রভক্ত ছাত্র-ছাত্রী ও গুণীজনদের আসা যাওয়া ছিল। নীলোৎপল শুধু গান শিখাতো তা নয়, রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শন, সংগীত, শিক্ষণরীতি, বিজ্ঞান, ধর্ম, কর্ম নানা বিষয়ে আলোচনা করতো। তার রবীন্দ্রপ্রেমিক ছাত্রছাত্রীরা মনে প্রাণে তার আলোচনা মনোযোগ সহকারে শুনত। বরং আমি বলতাম এত আলোচনা করে গান শেখাও কতটুকু? সে প্রতি উতরে মুচকি হাসত, কোন কটু কথা বলতো না।
'রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন' আসলে বিভিন্ন জেলা, শাখা থেকে তার প্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা আসতো গানগুলো প্রিয় স্যারকে দেখিয়ে বাছাই করে নেওয়ার জন্য। গাওয়ার পর সকলেই তাকে জিজ্ঞাসা করতো "গান কেমন হল?" সংগীত সুন্দরভাবে গীত হলে সে যেমন প্রশংসা করতো, তেমনি অবলীলায় ত্রুটিগুলোও ধরিয়ে দিত। তবে গান শুনিয়ে তাকে খুশী করা খুবই দুরূহ কাজ ছিল। নীলোৎপল নিজেই স্বল্প শ্রুত ও দুরূহ গান করতে পছন্দ করতো।
রবীন্দ্রনাথ ছিল নীলোৎপলের আদর্শ আর "রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদ" ছিল তার জীবন। তাই তো ২০১৯ইং সালে মরনব্যধি অসুখ নিয়ে চিকিৎসার গুরুত্ব না দিয়েই এক মাসে চারটি জেলায় প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাছাড়া মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ২০১৯ইং সালে ৫ই জানুয়ারী চাঁদপুর, ২২শে ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছিল। ২০২০ইং সালের ১৭ই মার্চ এই সংগীত পিপাসু মানুষটি ইহজগতের সকল মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেল। মৃত্যুর দুই দিন আগেও বলেছিল, "আমার যে অনেক কাজ বাকী রয়ে গেলো গো"। দেশের প্রতি তার প্রচণ্ড মমতাবোধ ছিল এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে খুব হতাশ হতো।
সংস্কৃতির বিকাশে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাদান, প্রচার ও প্রসারে নীলোৎপলের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তার মহান সাধনার ফল দেশের মানুষের কল্যাণের পথে এগিয়ে যাক। সার্থক হয়ে উঠুক একটি জাতির সকল মঙ্গল কাজে। মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে পৌঁছে যাক বাঙ্গালী সংস্কৃতির উপকরণ। আমি মনে করি নীলোৎপলের কাছে সংস্কৃতি প্রেমীরা সর্বাত্তক ভাবে ঋণী।
পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্য দিয়ে নীলোৎপলের মৃত্যু ভাবনা শেষ করছি -
"আজি বিজন ঘরে নিশীথ রাতে আসবে
যদি শূন্য হাতে"
এই গানটিতে মৃত্যুকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে পরম তৃপ্তি পেতে আগ্রহী রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যু অত্যন্ত গোপনে এসে হাজির হয়। আপাত দৃষ্টিতে মৃত্যুর এই হাত আমাদেরকে আলোকময় ধরা থেকে অসীম অন্ধকারে নিয়ে যায়। পার্থিব জীবন যতই আড়ম্বরপূর্ণ হোক, প্রকৃতপক্ষে এই জীবন ভিখারির জীবন।
তুমিও আজ আঁধারঘন, অনন্তলোকে নীরব শয়নে চির শায়িত। তোমাকে জানাই আমার শূন্য হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: প্রয়াত নীলোৎপল সাধ্যের সহধর্মিণী
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত