আমার কুলগুরু, আমার শিক্ষক

  অলক মিত্র

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৮:৫৪ |  আপডেট  : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪২

অলক মিত্র

-----------

মানুষের জীবনে কোন না কোন মানুষের প্রভাব পরে, প্রভাবিত মানুষটি তার মত পথ অনুসরন শেষ পর্যন্ত করবে কীনা সেটা তার বিষয়। এজন্য সে মানুষটির কোন দায় থাকে না। আমি একজন অতিসাধারণ মানুষ, আমার জীবন বোধ ও শিক্ষা সংস্কৃতি তেমন বড় কোন মাপের নয়। আমার কুল গুরু ও স্কুল জীবনের শিক্ষক আব্দুর রহমান মাষ্টার, একজন বিশাল প্রতিভাবান।

আমার জীবনে সেই মানুষ, আমার রহমান স্যার, আমার দেবতা! শেষ পর্যন্ত আমিও বক্র রেখায় পথ চলতে চলতে তাঁকে ভুলেই গেছি। নিশ্চয় এ দায় তাঁর নয়।

আমার এই শিক্ষক তার সমস্ত মেধা-মনন দিয়ে চেষ্টা করেছেন তার এই শিক্ষার্থীকে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার। আমি তা হতে পারিনি এ দায়ভার তো আমার শিক্ষকের নয়। এ দায় আমার মগজ আর ইচ্ছা শক্তির। তার দেয়া শিক্ষা আমি গ্রহন করতে পারিনি। এ ব্যর্থতা শুধুই আমার।

আব্দুর রহমান মাষ্টার বিক্রমপুরের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক পরিচিত নাম। সাদা কে সাদা কালো কে কালো বলার মত সাহস নিয়েই তিনি পথ চলেছেন। সামাজিক বৈষম্য, শ্রেণি ও বর্ণগত স্বার্থের বিরুদ্ধ স্রোতের মাঝি ছিলেন রহমান স্যার।

আমার বাবার সাথে তারঁ একটা বন্ধুত্ব ছিলো, একদিন শিমুলিয়া বাজারে ডাঃ কালীজীবন মজুমদার কাকার ফার্মেসীতে তাঁকে প্রথম দেখি। চোখে ভারিক্কি চশমা, সবুজ মিলের লুঙ্গী, নীল খদ্দেরের পাঞ্জাবি। ফর্সা চেহারার সৌম্য পুরুষ। এটাই আমার দেবতার প্রথম দর্শন।

পরবর্তীতে ছাত্র হবার আগে ঐ শিমুলিয়া বাজারের গান্ধী ঘোষ কাকার দোকানেও আরেকবার জিতেন জেঠু (প্রখ্যাত কমিউনিষ্ট নেতা জিতেন ঘোষ) সমেত দেখা হয়। তারা গোয়ালী মান্দ্রা ঋষি পাড়ায় কোন এক সভার কথা আলাপ করছিলেন। সাথে আমার বাবা বা দাদু--কে ছিলেন মনে নেই, তবে মিষ্টি খেয়েছিলাম।

বাবার সাথে টুকটাক কথা বললেন। আমি তাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। গুরু গম্ভীর কণ্ঠে নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম বললাম। তখন আমি হলদিয়া হাইস্কুলের প্রাথমিক ক্লাসের ছাত্র, বর্তমানে হাইস্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছে।

তারপর বাবার মুখে শোনা, তিনি শুধু একজন শিক্ষকই নন, ছিলেন সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর একজন মুখপাত্র। ছিলেন আদর্শবান রাজনৈতিক সংগঠক। তখনো আমি ব্রাহ্মণগাওঁ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হইনি।

আমি ছোটবেলা যে সৌম্য পুরুষ রহমান স্যার কে দেখেছি তিনি একসময় হলদিয়া জি,আর বি,এম স্কুলের শিক্ষকও ছিলেন। আমাদের অগ্রজ ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন, আজিজ বেপারী, আবদুল হাই খান প্রমুখ তার ছাত্র ছিলেন। ঢালী ভাই বলেন, রহমান স্যার ইংরেজি ও অংক উভয় বিষয়ে সমান পারদর্শী ছিলেন।

আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি, আমি স্যারের কাছে সংস্কৃত পড়েছি। তখন চতুর্থ বিষয় ঐচ্ছিক হিসাবে সংস্কৃত অথবা আরবি নেয়া যেত। স্যার সংস্কৃত বিষয়ে এত ভাল জানতেন যে, কোন ব্রাহ্মণ সমাজের গোত্রভুক্ত মানুষও এতটা পারতেন কিনা সন্দেহ ।

সাধারণত হিন্দু ছেলেমেয়েরা সংস্কৃত আর মুসলমান ছেলেমেয়েরা আরবি পড়তেন। প্রকৃতপক্ষে এগুলো ভাষা ও নীতিজ্ঞান ৷ এসব শিখার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই।

১৯৬৯ সনে আমি এক বছর আরবী পড়েছি মুন্সিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে। আরবিটা আমার কাছে বেশ সহজ মনে হত।আসলে কোনটাই সহজ নয়।

যাক, সংস্কৃত ক্লাস করতে গিয়ে স্যারের শেখানো একটি শব্দও আজ আমার মনে নেই। কত কিল ঘুষি যে খেয়েছি-- তার বলে শেষ করা যাবে না।

ব্রাক্ষণগাঁও স্কুলের টিনের চালা ঘরের নামটি ছিলো রাম কুমার বিদ্যাপিঠ। এ রাম কুমার বিদ্যাপিঠ ঘরেই বসতো রহমান স্যারের সংস্কৃত ক্লাস।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ যে, ঐ সময়ে লৌহজং থানার মধ্যে ঐতিহ্য নিয়ে ব্রাহ্মণগাঁও স্কুল ছিল শীর্ষ স্থানীয়। ওখানে ক্যাপটেন সুলতান আহমদ প্রধান শিক্ষক, যার শাসন আর সোহাগে বাঘে মহিষে এক ঘাটে পানি খেতো।

সদ্য প্রয়াত সাধন স্যার, কাদির স্যার, কমর উদ্দিন স্যার, খলিল স্যার, বারেক স্যার, দেলোয়ার স্যার, লোকমান স্যার, সিরাজ স্যার, জামাল স্যার, মৌলভী স্যার প্রমুখ শিক্ষক ছিলেন বরেন্য।

এদের সবারই ছাত্র আজ দেশ বিদেশে খ্যাতিমান হিসাবে ইতোমধ্যেই সবার পরিচিতি অর্জন করেছেন। এ কথা সবারই জানা। বলছিলাম সেই মানুষটির কথা যে মানুষটি আমার কাছে দেবতুল্য ৷ কেন এ প্রশ্ন স্বভাবতই অনেকেই করতে পারেন। যে শিক্ষকের সংস্কৃত ক্লাসের একটি অক্ষরও আমার মনে নেই, সে শিক্ষক দেবতুল্য-- এটা স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে। উত্তরটা অন্য জায়গায়।পড়ার পাঠ্যবই যে সব, তা নয়।এ সত্যিটা আমায় শিখিয়েছেন এ মানুষটি।

রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি যে একটা শিল্প মাধ্যম--তা তিনিই শিখিয়েছিলেন।

আজ হয়ত বাস্তবতার নিরিখে লোকে হাসবেন কারন এখনকার রাজনৈতিক নেতা আর তাদের দর্শন কি --তা আর কারো অজানা নয়।

সেদিন এ মানুষটি আমাদের এ সমাজ সংস্করণও রাজনীতির একটি অংশ এ সত্যটার উপলব্ধি শিখিয়েছিলেন। রাজনীতির মাঠে আজ অসততার মহিরুহ অথচ আমার প্রিয় শিক্ষক রহমান স্যার বলতেন, রাজনীতির মাধ্যমে জনসেবা করা একটা অন্যতম ধর্ম।

আজ তিনি বেঁচে থাকলে দেখতেন কী সব সেবক আজ অলি গলি পাড়া মহল্লায় চষে বেড়াচ্ছে ঐ রাজনীতির নামে। স্যার পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষে রাণী গাঁও হতেই তার রাজনীতির মাঠ, পাঠ করতে শুরু করেন। রহমান স্যারের একজন বন্ধু ছিলেন, তিনি কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ, কুমারভোগ তার বাড়ী। দুজন ভাতৃত্ব বোধে উজ্জীবিত ছিলেন।

রাণীগাঁও আর কুমার ভোগ একই এলাকার, তাই দুজনের কাজ করা হয়ে উঠে সহজ, তবে পুলিশ আর সরকারি দলের লোকজনদের বাঁধা অতিক্রম করে কৃষক সমিতি বা ব্রাত্য জনগোষ্ঠীর জন্যকাজ করা কঠিন ছিলো। বর্ণবাদী হিন্দু জনগোষ্ঠীর নেতারা তাদের খুব একটা ভাল চোখে দেখতেন না। তারা জানতেন শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু হলে তাদের রামরাজত্ব করা কঠিন হয়ে পরবে। জমিতে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে গোটা বিক্রমপুরে গড়ে তোলা হয় কৃষক সমিতির আন্দোলন। তালুকদার, চৌধুরী

আর জমিদার পরিবার ও সামন্তবাদের আশংকা ছিলো কৃষকরা সংগঠিত হলে তাদের পাহাড় সম শোষনের অবসান হবে।

বঙীয় কৃষক সভার আহবানে তেভাগা আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ বিক্রমপুরেও আছরে পরে। জিতেন ঘোষ, রহমান মাষ্টার, শাহেদ আলী মিয়া, কালী শংকরর প্রমুখ এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

কৃষক কারো গোলাম নয়- তেভাগা চালু কর, কৃষক ঐক্য গড়ে তুলো এ শ্লোগানে মিছিল দিনের পর দিন শক্তিশালী হতে থাকে। শেষ অবধি এ আন্দোলন বিজয়ী হয়। রহমান স্যার জেলও খাটেন। একটানা ১৭ দিন অনশন করেন। এ ইতিহাস পাঠ আমরা ক'জন করেছি?

বিক্রমপুরে জনসংখ্যার দিক হতে তাঁতী জনগোষ্ঠী বেশ বড় অংশ ছিল। চল্লিশের দশকে তাঁতী সম্মেলনের মাধ্যমে গোয়ালীমান্দ্রা হাটে সৈজদ্দিন বেপারী সভাপতি ও আব্দুর রহমান মাষ্টারকে সাধারণ সম্পাদক করে বিক্রমপুর তাঁতী কো-অপারেটিভ সমিতি গঠিত হয়।

এদিকে ১৯৪৩ সনের দুর্ভিক্ষ শুরু হলে রহমান মাষ্টার রিলিফ কমিটির দায়িত্ব নিয়ে সরকারের নিকট হতে ত্রান সামগ্রী এনে বিলি করেন।

জেলা রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন সততার সাথেই৷ সাংবাদিক শফিউদ্দিন আহমেদ তার সহযোদ্ধা হিসাবে তখন মানুষের পাশে এসে দাড়াঁন।

রহমান স্যারের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা , তার জীবন বোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে আলোচনা তো দুরের কথা, সামান্য প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার মত জ্ঞান আমার নেই।

আমার শিক্ষক রহমান মাষ্টার সাম্যবাদ, মানবিক গুন সম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। আমাদের তিনি তার কনকসারের ভাংগা দালানের দ্বিতীয় তলায় বসে যে শিক্ষাটুকু দিয়েছিলেন, তাও তো আমি মনে রাখতে পারিনি। তার শেখানো পথে হাঁটতে পারিনি। সে দায় আমার, আমাদের।

সুসময় আর দুঃসময় হাত ধরে চলে। স্যার জীবনভর সরল-সুন্দরের স্বপ্ন দেখতে চেয়েও কেবল দুঃসময়ের সাথে যুদ্ধ করে পথ চলেছেন।

আমার মত তখন বহু তরুণ যেমন মুনীর মোর্শেদ, বারেক সর্দার আমেল, ডঃ আনোয়ার হোসেন তরুন, প্রয়াত সোলেমান, সাতঘড়িয়ার মুজিবুর রহমান, কুমারভোগের সাবেক চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ খান ( নুরুল ইসলাম খান নামে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী হিসাবে তখন পরিচিত ছিলো) আমেরিকা প্রবাসী মোশাররফ হোসেন, আবদুল্লা হিল বাকী, মানু, গুলশান ঢালী স্টোরের মালিক গিয়াসউদ্দিন ঢালী অখিল, হেদায়েতুল ইসলাম, আমেরিকা প্রবাসী আজিজুর রহমান, মকবুল বেপারী, প্রয়াত সাত্তার বেপারী প্রমুখ ছিলো স্যারের পাঠশালায় রাজনৈতিক ছাত্র।

আমাদের অগ্রজ সিপিবি নেতা এডভোকেট মন্টু ঘোষ, অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া, মনোয়ার রফিকুল উল আলম তারাও সেই সময় সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার সৈনিক হিসাবে কাজ করতেন। স্মরণের জানালায় আরো অনেকের নামই এই সময়ে মনে নেই, তবে নাম বলা এ লেখার উদ্দেশ্যও নয়।

আমার কুল গুরুকে এ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা বলতে পারেন। স্যার তার অভাব অনটনের সংসারে কখনই লক্ষী দেবীর বরকত পাননি যতটা পেয়েছিলেন সরস্বতী দেবীর আশীর্বাদ। তাই তো তার ছেলে মেয়েদের তিনি শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় বিচরণের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।

পারিবারের সদস্যরা নাটক, রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী পালনও করতেন স্যারের নেতৃত্বে। স্যারের কনকসারের বাড়ীতে জিতেন ঘোষ, সত্যেন সেন,জ্ঞান চক্রবর্তী, অনীল মুখার্জি, মুনির চৌধুরী, রনেশ দাসগুপ্ত, শাহেদ আলী ,শফিউদ্দিন আহমেদ, মোজাফফর আহমেদ, সর্দার ফজলুল করিম, কমরেড ফরহাদ, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ মানুষদের পদচারণা প্রায়শই ছিলো।

বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের সাথে তার নীতিগত, মতবিরোধ থাকলেও একজন বাম রাজনৈতিক রহমান স্যার জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম আর তার নৈতিকতাকে শ্রদ্ধার সাথেই সম্মান জানাতে কুন্ঠা বোধ করতেন না। দেশপ্রেমের এ অলিখিত চুক্তি আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই দেখাতে পারেন। কথিত আছে, বঙ্গবন্ধুর সাথে তার জেলখানায় থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু একবার প্রয়াত এম,কোরবান আলীর মাধ্যমে রহমান স্যারকে আওয়ামী লীগে যোগদানের প্রস্তাব পাঠালে তিনি সবিনয়ে অসম্মতি প্রকাশ করেন।

স্যারের হাত ধরেই একতা, নতুন কথা, জয়ধ্বনি, গণসাহিত্য আর সংবাদ পড়তে পড়তে তার ছাত্র হিসাবে আমার বন্ধুদের সাথে ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করি। এ নিয়ে এর আগে লিখেছি।

স্যার শেষ জীবনে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যখন একদল স্বাপদের দল লুটপাট, নারী ধর্ষন আর হিংস্রতা নিয়ে লৌহজংয়ের মাটিকে দূষিত করছিল তখনো তিনি বয়োবৃদ্ধ হয়েও সমাজে তার প্রতিবাদের ভাষা নরম না করে উচ্চস্বরে চিৎকার করেছেন। কেউ শুনুক আর নাই শুনুক।

রৌদ্র, বৃষ্টি উপেক্ষা করে স্যার শেষ বয়সেও কাজলকে নিয়ে লাঠি হাতে তার প্রিয় ছাত্রদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পত্রিকা পৌঁছে দিতেন।

স্যারের বড় ছেলে মাহাবুব উল আলম দীদার ভাই একজন লেখক ও সংগঠক। তিনিও শিক্ষকতা করেই জীবনের শেষ সময় অতিক্রম করছেন।

বড়দা দীদার ভাইকে যখন ঢালী মোয়াজ্জেম ভাই বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি করার জন্য একটা চিরকুট দিলেন, সে চিরকুট নিয়ে আমি ও রশীদ মোড়ল তার কলমা বাড়িতে যাই। এই জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামীলীগ নেতা ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেনকে ধন্যবাদ যে তিনি সংকীর্ণ রাজনৈতিক গন্ডীর বাইরে গিয়ে একজন বাম রাজনৈতিক ব্যক্তিকে সংগঠনের প্রয়োজনে নিয়ে আসতে কোন দ্বিধা করেননি।

সময়টা তখন অসময়, কজন ছিলেন শুদ্ধতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদকে গড়ার। দীদার ভাই একজন তার উদাহরণ, ভয়কে জয় করে আমাদের সাথে মত পথের ভিন্নতা নিয়ে শুধু বঙ্গবন্ধু আর অসাম্প্রদায়িকতার জন্য এসেছিলেন সংগঠন করতে।

আসলে দীদার ভাইর সাথে এর আগে আমার কোন ঘনিষ্ঠতা ছিলো না কারন বড়দা হিসাবে দুরত্ব বজায় ছিলো। যতটা ছিল লেখক কবি, রাজনৈতিক নেতা নূহ-উল-আলম লেনিন ভাইর সাথে। লেনিন ভাই আমার আরেক শিক্ষাগুরু বলা চলে, সেই ছাত্র ইউনিয়নের দিনগুলোতে।

লেনিন ভাইয়ের অনুজ ভাইদের বিশেষ করে মনোয়ার রফিকুল উল আলম ভাই, শহিদ, কাজল এদের সাথে সখ্যতা ছিল বেশী। পরবর্তী সময়ে দীদার ভাইর সাথে আমি বঙ্গবন্ধু পরিষদ লৌহজং থানা শাখায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, দাদা সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে কী কী করনীয় তা ঠিক রহমান মাষ্টারের ডুপ্লিকেট বা রুপান্তর বলা চলে।

অসময়ের বাংলাদেশে সাহসী যোদ্ধা। এ সুযোগে দীদার ভাইকেও শ্রদ্ধা।

আমার রহমান স্যার আজ দুর বহুদুর।তিনি অসময়ের সাথে, অশান্তির সাথে, দানবদের সাথে, শোষকদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সনের ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেবল যুদ্ধ করেই গেলেন।

স্যারের যুদ্ধ ছিল শোষণহীন সমাজব্যবস্থায়, ছিলো বৈষম্য মুক্ত জীবন, ছিলো অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বাংলাদেশ, ছিলো রবীন্দ্র নজরুলের ভাবধারার মানসিকতা, লালন-রাধারমন-জসীমউদ্দিন-আব্বাসউদ্দীন-শাহ আবদুল করিমের সংস্কৃতির পথেই হাটা।

আমরা কী এখন সেই পথেই হাঁটছি? নাকী এখন পঙ্গু হয়ে বসে পরেছে আমাদের গতি প্রকৃতি? এসব ভাবায় বৈকী? স্যার কীছুই করার নেই যে আমার। শক্তি নেই, সংগঠন নেই, নেই সেই তারুন্য! হতাশ, ভগ্নহৃদয় নিয়ে তবুও স্বপ্ন দেখি একজন শেখ মুজিবের, একজন মনি সিংয়ের, একজন রহমান মাষ্টারের, হয়তো সে স্বপ্ন , স্বপ্নই থাকবে ।

শেখ মুজিবের দেখানো পথেই ১৯৭১। রাজনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধুই তো বলেছিলেন এখন অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধ । হয়তো তিনি থাকলে রহমান স্যারের স্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা পেতাম! কতটা ভয়ংকর উচ্চারণ বিশ্ব আজ দু ’ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের দলে। এমন কথা তো রহমান স্যার তার চেতনা আর মননে দীর্ঘদিন লালন করে আসছিলেন। এ উচ্চারণ ই কাল হোল, সাম্রাজ্যের মহারাজা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসি শক্তি কেড়ে নিল গোপালগঞ্জের শেখ মুজিবকে।

জাতির স্বপ্ন আর আমার রহমান স্যারের শোষণ উৎপীড়ন মুক্ত বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে পরে গেল! পরিশেষে, আজ কেন জানি, আবার আমার স্যারের হাতের বেতের বাড়ি খেতে ইচ্ছা করছে । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।

সত্যি জাতি আজ আধামরা অবস্থায় আই,সিইউ তে আছে। একটা ঝাঁকুনি প্রয়োজন। স্যার, আপনার চেনা সেই লৌহজং-এ এখন মাদকের ভয়াবহ দাপট, আপনার সেই প্রগতির পতাকা তরুণেরা হাতে নিতে পারে না, কারণ ওদের হাতে এখন নেশার বোতল, ট্যাবলেট।

একটা প্রজন্মকে ধ্বংস করতে হলে এরকম কুমতলব রাজনৈতিক ধান্দা বাজি বক্ররেখাই একে দেই আমরা, আমাদের স্বার্থে। ধিক রাজনীতি - ধিক-! সমগ্র বাংলাদেশ ১০ টন ট্রাকের মত, সমগ্র বাংলাদেশ এখন মাদকের রমরমা। লজ্জিত স্যার! সত্যি বলতে কষ্টের হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা এখন তলানিতে, আমরা রাজনীতি এখন নিয়ে এসেছি, ব্যক্তি, গোষ্ঠী স্বার্থে । সেই চিকামারা রাজনীতি নেই। আছে বিশাল বিশাল তোড়ন আর ব্যানার রাজনীতি!

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, দুরে কোথাও দুরে দুরে আমার মন বেড়ায় ঘুরে ঘুরে। সত্যি স্যার, আপনাকে তো পাবো না, তাই মনের দুঃখ বোধ নিয়েই ঘুরে ঘুরে জীবন নিয়ে চলেছি, কার কাছে বলবো এ দুঃখ, এ যন্ত্রণা?

আপনাকে পেলে আবারো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতাম, চরণে ধরিতে দিও গো আমারে, নিও না, নিও না সড়ায়ে।

ভাল থাকুন স্যার। লাল সালাম, বিনম্র শ্রদ্ধা !

লেখক- সম্পাদক, গ্রামনগর বার্তা.কম 

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত