আগুনে আর কত প্রাণ ঝড়লে টনক নড়বে ?
প্রকাশ: ৫ মার্চ ২০২৪, ১৭:০৫ | আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১৩
এখন চলছে গরমের মৌসুম। যাকে আগুন লাগার মৌসুম বললেও ভুল হবে না। প্রচণ্ড রোদের গরমে আমার সবকিছু শুকিয়ে মুড়মুড়ে হয়ে রয়েছে। যেকোন ভাবে আগুনের স্পর্শ পেলেই আগুন ছড়িয়ে পড়তে দেরি করে না। মুহুর্তের আগুনে কোটি কোটি টাকার সম্পদ মুহুর্তের মধ্যেই নিঃস্ব হয়ে যায়। শুধু সম্পই যে নষ্ট হয় তা নয় ঝরে যায় মানুষসহ অসংখ্য প্রাণীর প্রাণ। আগুন লাগাটা কোন আশ্চর্যজনক ঘটনা না। এটা চিরাচরিত নিয়ম, আগুন লাগতে পারে যেকোন ভাবে। আগুন লাগা থেকে প্রতিকার ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিনিয়ত দেশের কোন না কোন স্থানে আগুন লাগছে। সম্পদ নষ্ট হচ্ছে সাথে সাথে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী মারা যাচ্ছে। এর দায় কে নেবে?
প্রতি বছরই বড় বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। সরকার দেখছে, মানুষ দেখছে সারাবিশ্ব দেখছে। কিন্তু প্রতিকার বা প্রতিরোধের জন্য কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে? দেশের প্রশাসনে যারা কর্তাবাবুু আছেন তারা কি করছেন? যদি মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারেন তাহলে কেন এ দায়িত্ব ভার নিলেন? বেলি রোডের অগ্নিকান্ড ঘটলো সম্পদ গেল মানুষের জীবন গেল। এটা সবাই দেখছে। তারা হলো সাধারণ মানুষ। কিন্তু প্রশাসনের লোকজন কোথায় ছিলেন? আপনাদের কি কোন দায়িত্ব নেই। হোটেল রেস্টুরেন্টের জায়গাতো সেখানে নয়। তাহলে কি করে গড়ে উঠল। যে যেভাবে পারছে যেখানে সেখানে হোটেল রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলছে। প্রশাসনের লোকজন দেখেও না দেখার ভান করে আছে।
গত কয়েকদিন আগে রাতে বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কর্টেজ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত ১১ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের কারো কারো জীবন শঙ্কামুক্ত নয়। নিহতদের মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও নারী-শিশু রয়েছে। এ মৃত্যু দেশের সকল মানুষকে বিষাদগ্রস্ত করেছে। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ভবনের অব্যবস্থাপনা ও অগ্নিনিরাপত্তা না থাকায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়ে শোক ও ক্ষুব্ধতা প্রকাশের সয়লাব বয়ে গেছে। বিষয়টি দেশে তো বটেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও গুরুত্ব পেয়েছে। শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা হয়েছে। এর বেশি সাধারণ মানুষের কিছু করার থাকে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের করার থাকলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ফলে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এবং বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। প্রত্যেক মানুষেরই জীবন মূল্যবান। তবে কিছু কিছু মানুষের জীবন পুড়ে যখন ছাই হয়ে যায়, তখন তা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। বেইলী রোডের অগ্নিকান্ডে নিহতদের পরিচয় জানার পর তা মর্মবেদনা তীব্র করে তুলেছে। আমরা নিহতদের পরিবারের প্রতি শোক জ্ঞাপন করছি।
দেশে বিগত একযুগের বেশি সময় ধরে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের অগ্নিকান্ড ঘটেছে। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকান্ড, ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অগ্নিকান্ড,একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারের আগুনের ঘটনা মানুষের মনে এখনও দগদগে হয়ে আছে। এসব অগ্নিকান্ডের পাশাপাশি আরও অনেক অগ্নিকান্ড ঘটেছে। বলা যায়, রাজধানীতে আগুন লাগার ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে। যখন কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটে, তখনই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, কারণ উদ্ঘাটন করা হয়, তবে তার কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। পুরনো ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকা অনেক আগে থেকেই ‘ডিনামাইট’ হয়ে আছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। এসব এলাকায় রাসায়নিক গুদামগুলোতে কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থে ঠাসা থাকে। রাসায়নিক ও কেমিক্যালের গুদাম সরিয়ে নেয়ার কথা থাকলেও তা সরানো হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অগ্নিকান্ড ঘটার পর যত বড় বড় কথা বলে, কিছুদিন পর তা ভুলে যায়। অগ্নিনিরাপত্তার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। রাজধানীর অসংখ্য বহুতল ভবনে যথাযথ অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই। যেসব পুরনো ভবন রয়েছে, সেগুলোতে আগে থেকেই এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নতুন বিশেষ করে হাইরাইজ ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব ও অপ্রতুলতার কারণেই অগ্নিকান্ডে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বলা বাহুল্য, দোকানপাট ও রেস্টুরেন্ট খোলার ব্যাপারেও রাজউক, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের যথাযথ অনুমোদন নেয়া হয় না। যেকোনো আবাসিক এলাকায় যে কেউ ভবন ভাড়া নিয়ে হুট করে দোকানপাট, ফাস্টফুড বা রেস্টুরেন্ট খুলে বসে। নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করে। বেইলি রোডের যে ভবনটিতে ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটেছে, সে ভবনে দোকান ও রেস্টুরেন্টের কোনো অনুমোদন ছিল না বলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অগ্নিকান্ডের পর রাজউক কেন এ কথা বলছে? জানা থাকা সত্ত্বেও অগ্নিকান্ডের আগে রাজউক কেন ব্যবস্থা নেয়নি? একটি ভবন জুড়ে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে দিনের পর দিন এতগুলো রেস্টুরেন্ট অনুমোদন ছাড়াই চলবে, এটা কিভাবে সম্ভব? এটাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি ছাড়া কী বলা যায়। একে নিছক দুর্ঘটনা বলার উপায় নেই। এর দায়দায়িত্ব শুধু ভবন মালিক নয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপরও বর্তায়। এমনিতেই বলা হয়, প্রতিটি গ্যাসের সিলিন্ডার একেকটি বোমাসদৃশ। যথাযথভাবে এগুলো ব্যবহার নিশ্চিত না করলে, যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। বাসাবাড়ি ও গাড়িতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অগ্নিকান্ড ও নিহত হওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে। বেইলি রোডের ভবনটিতে প্রত্যেকটি রেস্টুরেন্ট সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করা হতো। বলা যায়, পুরো ভবনটিই বোমাসদৃশ হয়েছিল। আগুনের সূত্রপাত এই সিলিন্ডার থেকেই ঘটেছে, যা বিস্ফোরিত হয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই ভবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। তবে সেসব ভবনে যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে। আগুন লাগলে তা নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়। আমাদের দেশে প্রতিটি ভবনে অগ্নিকা-ের পেছনে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দায়ী।
বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকান্ড আবারও প্রমাণ করেছে, রাজধানীর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অতীতের বড় ধরনের অগ্নিকান্ড ভবন মালিকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়াতে পারেনি। এখন এ নিয়ে কিছুদিন কথাবার্তা হবে। তারপর বরাবরের মতো চুপ হয়ে যাবে। এটা যেন মানুষের জীবন নিয়ে একধনের খেলা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে মানুষের জীবনের যেন কোনো মূল্য নেই। জানা যায়, বেইলি রোডের অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ২৫ হাজার করে টাকা দিয়েছে। এটা তাদের সাথে পরিহাস ছাড়া কিছু নয়। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও যাথাযথ তদারকির অভাবে যে জীবন পুড়ে ছাই হয়ে গেল, তার মূল্য কি এই অর্থ দিয়ে চুকানো যায়? এটা কি কোনো বিবেকের পরিচয় হলো? কর্তৃপক্ষ যদি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করত এবং অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারত, তাহলে তার দায় কিছুটা হলেও খর্ব হতো। উন্নত বিশ্বে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে এবং তাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীর দায় না থাকলেও তার দায় নিয়ে মন্ত্রীর পদত্যাগ করার নজির রয়েছে। কয়েক বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় সাগরে ফেরি ডুবে যাওয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। আমাদের দেশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা থাকলেও নানা উসিলায় দায় এড়িয়ে যায়। এই দায় এড়ানোর মানসিকতা থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যতক্ষণ না বেরিয়ে আসতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অগ্নিকান্ডের শঙ্কা থেকেই যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরেকটি বড় ধরনের অগ্নিকান্ড ঘটার আগেই সচেতন হতে হবে এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। গণপূর্ত, রাজউক, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা করে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো অজুহাত গ্রাহ্য করা যাবে না। জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে। নতুন-পুরনো প্রত্যেক ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ভবন মালিকদের এ ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক করতে হবে।
অগ্নিকাণ্ড অন্যান্য দেশেও হয়ে থাকে। কিন্তু সেখানে মানুষ অধিক সচেতন বলে মানুষের প্রাণহানি কিংবা সম্পদের ক্ষতি কম হয়। যেকোনো কাঠামো সেটি রেস্তোরাঁ কিংবা কারখানা—অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা জোরদার করতে পারলে দুর্ঘটনা কমানো যায়। একই সঙ্গে ভবন ব্যবহারকারীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটি স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী ব্যবহারকারীর জন্য সত্য। প্রতিটি ভবনের নিরাপত্তার জন্য ভবনটি যাঁরা নির্মাণ করেন, তাঁদের সজাগ থাকতে হবে। আইন মেনে চলতে হবে। প্রতিটি ভবনে ফায়ার সেফটি প্ল্যান ও বহির্গমনের পরিকল্পনা বা ব্যবস্থা থাকতে হবে। কর্মীদের প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডারের মতো দাহ্য পদার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আরও বেশি সজাগ থাকতে হবে। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকেও নিয়মিত তদারক করতে হবে। সেটি অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি কারখানা বা ভবন পরিদর্শন বিভাগকেও। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি।
লেখক- সাংবাদিক ও কলাম লেখক
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত