অসীম পাথার (সত্যি ঘটনা) 

  অনুপা দেওয়ানজী

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২১, ০৯:৪৮ |  আপডেট  : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:৩৮

হার্ট স্পেশালিষ্ট ডাঃ কুনাল( ছদ্মনাম) যখন জানলেন রোগীর বাড়ি  শুধু যে খুলনা  তা নয় খুলনার যে  গ্রামে ভদ্রলোকের  বাড়ি সেই গ্রামে তাঁরও বাড়ি।  

মুহুর্তে তিনি তাঁর ছোট্ট বেলার দিনগুলিতে  ফিরে গেলেন। যেখানে কেটেছে তাঁর দূরন্ত শৈশব।  সেই গ্রাম, সেই পুকুর,  গ্রামের সেই স্কুল, ছোট্ট বেলার বন্ধু।সব যেন একে একে ছবির মতো মনের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগলো।

ভাবতে ভাবতে  ৭১ য়ের মার্চের দিনগুলিতে   এসে সেই ছবি গুলি হঠাৎ দুমড়ে মুচড়ে  অব্যক্ত এক যন্ত্রনার ছবির ফ্রেমে আটকে গিয়ে বুকটা তাঁর টন টন করে উঠলো।   
   
তখন তাঁর বয়েস সবে আট।মনে ছাব্বিশে মার্চের সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাবা মায়ের মুখে শুনেন  আগের রাতে বারোটায় নাকি ঘুমন্ত ঢাকা শহরের বুকে  শুরু হয়ে গেছে নির্বিচারে মানুষ হত্যা। 
আর তারপর দিন থেকে সারা দেশ জুড়ে  পাকবাহিনী আর রাজাকারের সম্মিলিত ভাবে নিষ্ঠুর গণহত্যা   আর অরাজকতা। 
 যে যেদিকে পারে নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে, একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়  হন্যে হয়ে  দিগ্বিদিকে  ছুটছে।

 শহর ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ে, কোথাও যখন নিরাপদ নয় তখন অসহায় আর কপর্দকহীন অবস্থায় সবাই সীমান্তের ওপারে বাঁচার  আশায় ছুটছে।

কুনালদের গ্রামেও যখন পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দৌরাত্ম্য শুরু  হোলো।গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে হানা দিয়ে   লুটপাট  আর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে  তরুণ ছেলেদের  আর মেয়েদের পাক বাহিনীর হাতে তুলে  দেয়া , হত্যা, সন্ত্রাস ও অবর্ণনীয় এক  নারকীয় এক অবস্থার সৃষ্টি করে তারা পাশবিক এক উল্লাসে  মেতে  উঠলো তখন

 কুনালের বাবা সেই পরিস্থিতিতে তাদের সেখানে থাকা আর নিরাপদ মনে করলেন না।তিনি তাকে আর তার মাকে এক আত্মীয়ের সাথে  সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কোলকাতায় তার মামার   কাছে পাঠিয়ে  দেবার ব্যবস্থা  করলেন। 
 মনে আছে বাবা বলেছিলেন তিনি যেভাবেই হোক নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন।

কিন্তু বাবা তাদের কথা দিলেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর রক্ষা করতে পারেন নি। রাজাকার বাহিনীর প্রধান যিনি ছিলেন তিনি   নিজে  তার বাবাকে দিয়ে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বাবার অর্ধেক শরীর সেই গর্তে পুঁতে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে   খুঁচিয়ে  নিজের হাতে তাঁকে গুলি করে মেরেছিলেন।

বাবার অপরাধ ছিলো তিনি মুক্তিবাহিনীদের  সহযোগিতা করতেন।
ভাবতে ভাবতে  আজকের প্রতিষ্ঠিত হার্ট স্পেশালিষ্ট  ডাঃ কুনালের চোখ দুটি নিজের অজান্তেই বুঝি  অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।

 বাবার স্নেহ সে পায়নি। মামাদের স্নেহেই সে বড় হয়েছে। 
বাবার ইচ্ছে ছিলো ছেলে তাঁর ডাক্তার হবে।সে আজ কোলকাতার বিখ্যাত এক হাসপাতালের প্রতিষ্ঠিত একজন ডাক্তার। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও তার খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে। ডাক্তার কুনাল সেনকে আজ সবাই এক  নামেই চেনে।
শুধু বাবা তার এই সফলতা দেখে যেতে পারেন নি। 

পরদিন রোগীর ওপেন হার্ট সার্জারি। সফল অপারেশন শেষে ডাঃ কুনালের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। 

রোগী যেদিন রিলিজ নেবেন সেদিন তিনি নিজে এলেন তাঁর সাথে দেখা করার জন্যে। খুলনার কোন এক গ্রামের  কুনাল নামের ছেলেটি  নিজের কাহিনী বলতে বলতে যখন তার বাবার নাম বললেন তখন রোগী চমকে উঠলেন। এ তো সেই ছেলে যার বাবাকে তার রাজাকার বাবা নিজের হাতে গুলি করে মেরেছিলেন!গ্রামের সবাই এই কাহিনী জানে।
সে নিজেও তা জানে। 

কিন্তু আজ সেই কাহিনী শুনে তিনি নিজেকে কিছুতেই  আর স্থির রাখতে পারলেন  না। হত্যাকারী পিতার অপরাধের গ্লানি মাথায় নিয়ে  অনুশোচনার অনলে দগ্ধ  হয়ে ডাক্তারের দুটি হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে শিশুর মতো তিনি কেঁদে চললেন।
তার হত্যাকারী পিতার সন্তানের প্রাণ যে সেই হতভাগ্য পিতার সন্তানের জন্যেই আজ রক্ষা পেয়েছে। তিনি কিভাবে  এর মূল্য পরিশোধ করবেন? 
 ডাঃ কুনালের দুটি চোখ থেকে তখন গড়িয়ে পড়ছিলো অব্যক্ত দুঃখের এক নীরব অশ্রু ধারা। 

৭১য়ের পরবর্তী  প্রজন্মের দুটি সন্তান  একে অপরের হাতে হাত রেখে কেঁদেই চলেছে।
 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত