সিরাজুল ইসলাম  চৌধুরী

সমাজ রুপান্তরের এক আলোকবর্তিকার নাম

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২২, ১০:৫৬ |  আপডেট  : ১৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৫

মুজিব রহমান
----------------------- 
     
                                                                                               
 
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একাধারে প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ, প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবি, জাতির বিবেক ও দিকনির্দেশক তথা সমাজ রুপান্তরের এক আলোকবর্তিকার নাম। এই মনীষীর জন্ম   জন্ম: ২৩ জুন ১৯৩৬ ,বাড়ৈখালি, শ্রীনগর, পিতা: হাফিজ উদ্দিন চৌধুরী ,মাতা: আসিয়া খাতুন,স্ত্রী: ড. নাজমা জেসমিন চৌধুরী, লেখিকা। পিতার সরকারি চাকরির কারণে তাঁর শৈশব কেটেছে রাজশাহী ও কলকাতায়। সেইন্ট গ্রেগরী স্কুল থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মেট্রিক ও নটরডেম কলেজ থেকে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (সম্মান) ও এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্র জীবন থেকেই ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন। ছাত্রফ্রন্টের হয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি এমএ পরীক্ষা দিয়েই মুন্সিগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দেন। এরপর কিছুদিন জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ১০ মাসের বৃত্তি পেয়ে তিনি ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করেন। ১৯৬৫ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে দুই বছর ৮ মাসে লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। ২০০২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। তিনি ‘সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুলেন এবং পত্রিকা প্রকাশনা ও বই প্রকাশ করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে অধ্যাপকশিপ তৈরি হলে তিনি সেখানে অধ্যাপক পদে যোগ দেন। দুই মেয়াদে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চার বছর দায়িত্ব পালন করেন। এরপরও কিছুদিন অনারারি অধ্যাপক পদে ছিলেন। তিনি ২০০৮ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক পদে রয়েছেন।
 
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি আর্মিদের হত্যার তালিকায় তাঁর নামও ছিল। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে থাকা তাঁর এক আত্মীয় তাঁকে সতর্ক করে দেন। টিক্কা খান যাওয়ার আগে ছয়জন শিক্ষককে সতর্ক করেছিল যার একজন ছিলেন তিনি। তিনি বুঝতে পারেন, দেশ স্বাধীন না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর আসা হবে না। বারবার ঠিকানা বদল করায় পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে খুঁজে না পাওয়ায় তিনি রক্ষা পেয়ে যান।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কর্তৃক দুবার উপাচার্য হওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের শর্ত মেনে নিতে না পেরে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত। সম্পাদনা করেছেন ‘পরিক্রমা’, ‘সাহিত্যপত্র’, ‘সচিত্র সময়’, ‘সাপ্তাহিক সময়’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা’, ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টাডিস’ প্রভৃতি। তাঁর সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে সাহিত্য-সংস্কৃতির পত্রিকা ‘নতুন দিগন্ত’। নতুন দিগন্ত প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তার মানুষের লেখালেখির জন্য সুপরিচিত। তিনি আড়িয়াল বিল ও ঢাকার ওসমানি উদ্যান রক্ষার আন্দোলন এবং ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্তেরও প্রতিবাদ করেন। আড়িয়াল বিল রক্ষার আন্দোলন করায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হলে তিনি জামিন নেন। কাব্যিক ছন্দময় গদ্য লেখার জন্য তাঁর প্রবন্ধগুলোও সুখপাঠ্য ও উপভোগ্য হয়ে উঠে। ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি’ নামে তাঁর দুটি গবেষণা গ্রন্থ দুই বাংলাতেই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এছাড়াও তিনি শতাধীক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে অধিকাংশই প্রবন্ধ গ্রন্থ হলেও তিনি উপন্যাস ও কিশোরদের জন্যও লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে আরো রয়েছে- নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবন, সাহিত্যের মেয়েরা, সেক্সপিয়রের মেয়েরা, উত্তরাধিকারের অনিবার্য প্রশ্ন, সাহিত্যের অন্তর্জগত, রাষ্ট্র ও সমাজের মাঝখানে, অবিরাম পথ খোঁজা, পিতার হুকুম, কালের সাক্ষী, রবীন্দ্রনাথ কেন জরুরী, হোমারের অডিসি, বন্ধ করো না পাখা, গণতন্ত্রের অমসৃণ পথ, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি মধ্যবিত্ত, রাষ্ট্র ও সাংস্কৃতিক সামাজিকতা, বিচ্ছিন্নতায় অসম্মতি, সময় বহিয়া যায়, ভাল মানুষের জগৎ, পুঁজিবাদের দুঃশাসন, ছত্রভঙ্গে পূর্বাপর, বিচ্ছিন্নতার সত্য মিথ্যা, অন্বেষণ, অগ্রগতির শর্তপূরণ, নির্বাচিত প্রবন্ধ ও প্রবন্ধ সমগ্র ৭ খণ্ড। তিনি জাতির দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর সুচিন্তিত লেখাগুলো জাতীয় সম্পদরূপে পরিগণিত হয়েছে। জাতিগত দায়িত্ববোধই তাঁর কর্মযজ্ঞের প্রেরণার উৎস। তাঁর প্রতিটি রচনায় একটা নিয়তনিষ্ঠ অধ্যাবসায়ের ছাপ সুষ্পষ্ট। তাঁর প্রতিটি লেখাতেই প্রজ্ঞা আর পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি একজন আদর্শনিষ্ঠ ও নিবেদিত প্রাণ বামপন্থী এবং একনিষ্ঠ প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী। বর্তমানে জাতির বিবেক ও কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন। তাঁর গবেষণালব্ধ প্রবন্ধগুলো দুই বাংলাতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নাগরিক দায়িত্ববোধই তাঁর প্রেরণা। সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কাজ করছেন অনবরত। রাষ্ট্রীয় অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার। নিয়মিতভাবেই লিখছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে।
 
তিনি সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য ১৯৭৫ সালে লেখক সংঘ পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আব্দুর রহমান চৌধুরী পদক, ১৯৮০ সালে লেখিকা সংঘ পদক, ১৯৮৩ সালে মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পদক, ১৯৮৮ সালে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে একুশে পদক, ২০০১ সালে আবদুল রউফ চৌধুরী পুরস্কার, ২০০২ সালে ঋষিজ পদক এবং ২০২২ সালে বাংলা একাডেমির নজরুল পুরস্কার প্রবর্তন হলে প্রথমবার পুরস্কার লাভ করেন। 
 
তাঁর সহধর্মিনী ড. নাজমা জেসমিন চৌধুরী ১৯৭৫ সালে কলেজ অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে বাংলা একাডেমির বৃত্তিধারী গবেষক হিসেবে ‘বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। তিনি ঢাকার শিশু কিশোর নাট্য আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ঢাকা লিটল থিয়েটার সংগঠনে তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। নিজে মঞ্চ নাটক ও টিভির জন্য নাটক লিখেছেন। অনেকগুলো স্বার্থক গল্প লিখেছেন। বড়দের জন্য লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ও উপন্যাসগুলোও জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর গল্প-উপন্যাসের প্রধান সব চরিত্র প্রতিবাদী নারী। তিনি ছিলেন একজন মুক্ত ও স্বাধীন বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার দৃঢ়প্রত্যয়ী রাজনীতিসচেতন মানুষ। তিনি ১৯৪০ সালের ১ ডিসেম্বর কলকাতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের আদি নিবাস ছিল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়। ১৯৮৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
 
তাদের দুই কন্যা রওনাক আরা চৌধুরী ও শারমীন চৌধুরী। শারমীন চৌধুরী ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি করে বুয়েটের মানববিদ্যা বিভাগের ইংরেজি শাখায় অধ্যাপনা করছেন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত