শ্রীনগর সরকারি কলেজের ইতিহাস 

  মো.জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ: ৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:৪৯ |  আপডেট  : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ২৩:৩৯

১৩২৬ বঙ্গাব্দে (১৯১৯ খৃ.) শ্রী যোগেন্দ্র নাথ গুপ্ত প্রণীত ও সম্পাদিত ‘বিক্রমপুরের বিবরণ’ প্রথম খন্ড পাঠ করে জানতে পারলাম ভাগ্যকুলের প্রখ্যাত কুন্ডু পরিবারের শ্রীযুক্ত হরেন্দ্র লাল রায় ছিলেন  তেজস্বী, নির্ভীক ও উদারচেতা ব্যক্তি। শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উদার ও মুক্তহস্তে দান করতেন। ভাগ্যকুলে তিনি ১৯০০ সালে ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এর পূর্বে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত নূরপুর উচ্চ বিদ্যালয় ১৮৪৮ সালে পদ্মার ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যায়। পরে তিনি মুন্সীগঞ্জে ‘হরেন্দ্রলাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করেন। শেষ পর্যন্ত কলেজটি চালু করা যায়নি। এ প্রসঙ্গে লেখক আফসোস করে লিখেছেন- ‘কন্তু হায়! যে রূপে হউক পূর্ববঙ্গবাসীর স্বভাবসিদ্ধ দলাদলির  গোলযোগে পড়িয়া কলেজটির মুকুলেই বিলুপ্ত প্রাপ্তি হয়। ইহা যে কতদূর ক্ষতির কারণ হইয়াছে, তাহা বর্তমান সময়ে বিক্রমপুরবাসী মাত্রই উপলব্ধি করিতেছেন।’ লেখক আক্ষেপ করে লিখেছেন- ‘বর্তমান দুর্দিনে তাঁহারা (ভাগ্যকুলের জমিদাররা) যদি দেশে কলেজ স্থাপন করেন, তাহা হইলে দরিদ্র দেশের লোকের পক্ষে শিক্ষার পথ উন্মুক্ত হয়।’ (সূত্র: সিরাজুল ইসলাম খান সূর্য -এর সাক্ষাত্কার ও বিক্রমপুরের বিবরণ পৃষ্ঠা-৯৩)।

১৯১৯ সালে প্রকাশিত এ বই হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে ধারণা করা যায়, শ্রীযুক্ত হরেন্দ্র লাল রায় মুন্সীগঞ্জ সদরে নিজের নামে কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যেগ নিয়েছিলেন ১৯১৯ সালের আগে। অধ্যক্ষ নিয়োগও দিয়েছিলেন। পরে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ যাত্রা শুরু করে ১৮৯৯ সালে। প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন সত্যেন্দ্র নাথ বসু। যা থেকে ধারণা হয় এ সময়ে মুন্সীগঞ্জে কলেজ করার উদ্যাগ নিয়েছিলেন হরেন্দ্র লাল রায়।

নাম নিয়ে হোক বা অন্য যে কারণেই হোক ১৯১৯ সালের আগে মুন্সীগঞ্জে ‘হরেন্দ্রলাল কলেজ’ না হওয়ায় বিক্রমপুরের ম্যাট্রিক পাস করা ছাত্রদের কলেজ শিক্ষা অনেক পিছিয়ে পডে। সে আমলে ঢাকা বা কলকাতায় গিয়ে কলেজে পড়ার আর্থিক সঙ্গতি বেশির ভাগ ছাত্রের ছিল না।

মুন্সীগঞ্জে কলেজ না হওয়ায় স্থানীয় শিক্ষিত মানুষের মনে দারুন বেদনা ও ক্ষোভ জমা ছিল। তাদের মনের এ ক্ষোভ প্রশমনের সুযোগ করে দেয় মুন্সীগঞ্জের তৎকালীন উকিল সতীশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের নিকট লিখিত তাঁর পিসাতো ভাই আশুতোষ গাঙ্গুলির একটি চিঠি।

সুদেব চন্দ্র পালের এক লেখা পড়ে জেনেছি- আশুতোষ গাঙ্গুলি এম এ পাস করে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে বিভাগে অফিসার পদে যোগ দেন। ছুটিতে গয়া ভ্রমনে গিয়ে এক সাধুকে হাত দেখান। সাধু তাঁকে চাকুরি ছেড়ে ব্যবসা করার পরামর্শ দেন। সাধু বলেছিলেন, লৌহ জাতীয় ব্যবসায় উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম ব্যবসার মুনাফার এক অংশ জনহিতকর কাজে দান করার জন্যও সাধু বলেছিলেন। কলকাতা ফিরে মিঃ গাঙ্গুলি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে টাটা কোম্পানির এজেন্সী নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম চালানে প্রত্যাশার দ্বিগুণ মুনাফা হয়। তিনি প্রাপ্ত মুনাফা থেকে এক লক্ষ টাকা দিয়ে গয়ায় পূণ্যার্থীদের জন্য একটি ভবন নির্মান করার চিন্তা করেন। পিতা জীবিত না থাকায় মুরুব্বি হিসেবে মামা ও মামাতো ভাইর মতামত চেয়ে ঢাকায় ও মুন্সীগঞ্জে চিঠি লিখেন। মামাতো ভাই সতীশ চন্দ্র ভট্টাচার্য পত্র পেয়ে চলে যান মুন্সীগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেট শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের ভাগ্নে ও জামাতা ওয়াজির আলী সাহেবের বাসায়। ওয়াজির আলী ও সতীশ ভট্টাচার্য মুন্সীগঞ্জের এসডিও এ জি গাঙ্গুলির সাথে আলোচনা করে স্থির করেন এক সপ্তাহের মধ্যে আশুতোষ গাঙ্গুলিকে মুন্সীগঞ্জ আসার জন্য জরুরি টেলিগ্রাম প্রেরণের।

টেলিগ্রাম পেয়ে যথাসময়ে আশুতোষ গাঙ্গুলি মুন্সীগঞ্জ আসেন। এসডিওর অফিসে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সভা হয়। সভার সিদ্ধান্ত নিয়ে আশুতোষ গাঙ্গুলিকে অনুরোধ করা হয়- গয়ায় ভবন নির্মানে টাকা না দিয়ে ওই এক লক্ষ টাকা দিয়ে মুন্সীগঞ্জে উচ্চ শিক্ষার জন্য একটি কলেজ করে দেওয়ার জন্য।

আশুতোষ গাঙ্গুলি সম্মত হন। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে স্থির হয়, আশুতোষ গাঙ্গুলির পিতা হরমোহন-এর ‘হর’ আর মা গঙ্গামনির ‘গঙ্গা’ যুক্তকরে কলেজের নামকরণ হবে “হরগঙ্গা কলেজ বিক্রমপুর”।

হরগঙ্গা কলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে  মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম সম্পাদিত   “বিক্রমপুরঃ ইতিহাস ও ব্যক্তিত্ব” গ্রন্থ থেকে জানা যায়- “১৯৩৮ সালে টঙ্গীবাড়ীর রাউতভোগের প্রখ্যাত পন্ডিত ও টোলের অধ্যাপক হরমোহন গাঙ্গুলি ও গঙ্গামনির সুযোগ্যপুত্র আশুতোষ গাঙ্গুলির আর্থিক দানে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। আশুতোষ গাঙ্গুলি ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করে পুনেতে অফিসার পদে চাকুরিতে যোগ দেন। পরে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের আহবানে চাকুরি ছেড়ে কলকাতা এসে লোহার ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় উন্নতি হলে তিনি এক লক্ষ টাকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মামা বিক্রমপুরের বিখ্যাত পন্ডিত ও ঢাকা সারস্বত সমাজের সভাপতি রাজমোহন বিদ্যারত্ন ও মামাতো ভাই মুন্সীগঞ্জের উকিল শ্রীযুক্ত সতীশ চন্দ্র ভট্টাচার্যর মতামত চেয়ে পত্র লিখেন। মামা ও মামাতো ভাইয়ের পরামর্শে আশুতোষ গঙ্গুলি এক লক্ষ টাকা দান করে বাবা মার নামে ‘হরগঙ্গা কলেজ’ করার সিদ্ধান্তে নেন। ১৯৩৮ সালে বাংলার প্রধান মন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক মুন্শীগন্জে এসে কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।”(সূত্রঃ প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা১৪৯)।

আশুতোষ গাঙ্গুলির দানের টাকায় কলেজের জন্য জমি ক্রয়, দালান নির্মান, চেয়ার, টেবিল, বে  বানানোসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু হয়ে যায়। মুন্সীগঞ্জে হরগঙ্গা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মহকুমার শিক্ষার্থী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলা সমূহের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পায়।
হরগঙ্গা কলেজ প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর পরে ১৯৭০ সালে শ্রীনগর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রীনগরে কলেজ করার প্রথম চিন্তা করেন ষোলঘর ভূঁইয়াপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার ও শিক্ষানুরাগী মমতাজ উদ্দিনআহমদ। ষাটের দশকে তিনি শ্রীনগর ডাকঘরে শ্রীনগর কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি হিসাব খোলেন। রশিদ বই ছাপিয়ে কলেজের জন্য চাঁদা আদায় করে তিনি হিসাবে জমা রাখতেন। কিন্তু তিনি পৃষ্ঠপোষকতা ও জনসমর্থনের অভাবে সফল হতে পারেননি (সূত্র: শ্রীনগর কলেজ চার দশক উদযাপন স্মরণিকা)।

০৩ অক্টোবর ১৯৬৭ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় খাদ্য, কৃষি ও পূর্তমন্ত্রী এ এইচ এম শামস-উদ-দোহা’র ষোলঘর একেএসকে উচ্চ বিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষে পঠিত মানপত্রে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি কাজী হারুনুর রশিদ শ্রীনগর থানা কেন্দ্রে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি করেন।

১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রীনগর খেলার মাঠে মুসলিম লীগ আয়োজিত জনসভায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় যোগাযোগমন্ত্রী খান-এ-সবুর খান প্রধান অতিথি হয়ে আসেন। শ্রীনগরের মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ তাঁকে দিয়ে থুরাপাড়ায়‘ শ্রীনগরআব্দুল মোনায়েম খান কলেজ’ নামে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করান। ২৬ জানুয়ারি ঢাকার সকল দৈনিক পত্রিকায় কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়।

১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার আন্দোলন পূর্ববাংলায় গণ জোয়ার সৃষ্টি করে। গণ আন্দোলনে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে। ওই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রীনগর খেলার মাঠে থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত বিশাল জনসভায় আওয়ামী লীগের সংগ্রামী নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেণ ভাষণ দেন। সভা শেষে তার নেতৃত্বে শ্রীনগরের ছাত্র-জনতা কুখ্যাত মোনায়েম খানের নামে কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর ভেঙ্গে নিঃশ্চিহ্ন করে দেয়। ছাত্র-জনতা কলেজের নতুন নামকরণ করেন ‘ শ্রীনগর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি কলেজ’।

শ্রীনগরের লালা বসু জমিদারেরা এলাকায় কোন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেননি। শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রণীতও সম্পাদিত ‘বিক্রমপুরের বিবরণ’ প্রথম খন্ডে শ্রীনগরের যে বিবরণ দেওয়া আছে তাতে কোন স্কুলের তথ্য নেই। এক মাইল দূরের গ্রাম ষোলঘরে একাধিক স্কুলের তথ্য আছে এ গ্রন্থে। ষোলঘরে একটি উচ্চ ইংরেজি স্কুল, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং  বেশ কয়েকটি পাঠশালার কথা উল্লেখ আছে। উচ্চ ইংরেজি স্কুলটির অবস্থা ভাল ছিল। ছাত্রসংখ্যা ৪০০। স্কুলটি ১৯০২ খৃষ্টাব্দে স্থাপিত হয়। এই সংশ্রব শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার বসু চৌধুরী মহাশয়ের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ যোগ্য । প্রধানত তাঁহারই উদ্যেগে স্কুলটি স্থাপিত হয় এবং তিনিই সহস্র প্রকার অসুবিধা ও বাধার মধ্য দিয়া স্কুলটিকে বাঁচাইয়া আনিয়াছেন। ইনি এই গ্রামেরই অধিবাসী এবং ভূস্বামী। এই স্কুল স্থাপনকার্য্যে হেডমাষ্টার মহাশয় ব্যতীত শ্রীযুক্ত অবিনাশ চন্দ্র ঘোষ এম,এম,এস, শ্রীযুক্ত প্রভাত চন্দ্র ঘোষ, শ্রীযুক্ত শশীভূষন সেন ও শ্রীযুক্ত কুলদাপ্রসন্ন ঘোষ প্রধান উদ্যেগে ছিলেন। এন্ট্রাস স্কুল স্থাপিত হওয়া অবধি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যেও শিক্ষা বিস্তারিত হইতেছে। দুইটি সাহাযুবক বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছেন।  মৎস্যজীবী, তন্তবায়, কর্মকার প্রভৃতি শ্রেণীর অনেক ছেলে স্কুলে অধ্যয়ন করিতেছে (সূত্রঃ প্রাগুক্ত পৃষ্ঠাা-৯৯-১০০)। ( চলবে)

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত