মৃত্যুর আগমুহূর্তেও আমার চাওয়া একটি ভালো চিত্রনাট্য: সুরেখা সিক্রি 

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৫৪ |  আপডেট  : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪:৪২

ভারতের ৬৬তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মঞ্চ। সেরা সহ–অভিনেত্রীর নাম ঘোষণা করা হলো। ‘বাঁধাই হো’ সিনেমায় অসাধারণ অভিনয়ের জন্য সুরেখা সিক্রি। তিনি এলেন একটা হুইলচেয়ারে বসে। মঞ্চ পর্যন্ত আর যেতে হয়নি পুরস্কার নিতে। মঞ্চ থেকে পুরস্কার এনে দেওয়া হলো দর্শকসারিতে বসা তাঁর হাতে। হুইলচেয়ারে বসা সুরেখা আর পুরো হলরুমের সবাই দাঁড়ানো। হাততালি থামার আর নাম নেই। অবশ্য এর আগে আরও দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছুঁয়ে দেখেছেন সুরেখা। ১৯৮৮ সালে ‘তামাস’ ছবিতে আর ১৯৯৫ সালে ‘মাম্মো’ ছবিতে। বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক যিনি বানাচ্ছেন, সেই শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। আজ সেই সুরেখা সিক্রির জন্মদিন। ৭৬ বছর আগে, ১৯৪৫ সালের এই দিনে উত্তর প্রদেশে জন্মছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন এয়ারফোর্সের অফিসার, মা শিক্ষিকা। মঞ্চ, ছোট পর্দা আর বড় পর্দা—তিন রূপের অভিনয়েই জাদু দেখিয়েছেন সুরেখা।

 বরাবরই লেখক হতে চেয়েছিলেন সুরেখা। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করলেন। সুরেখার বোন তখন কলেজে, নাটক করত।

 ‘কিং লিয়ার’ নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে এক শিক্ষক তাঁকে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার (এনএসডি) ফরম এনে দেন। কিন্তু সেই ফরম বাড়ি নিয়ে এসে সুরেখার ছোট বোন বললেন, তিনি এখানে পড়তে চান না। কলেজের শিক্ষক নিজ হাতে ফরম দিল বলে কথা! তাই সুরেখার মা সুরেখাকে বললেন, ‘তাহলে তুই-ই ফর্ম পূরণ করে দে। সুযোগ পেলে পড়লি, না পেলে না পড়লি। স্যার ফরম দিলেন, তাঁর তো একটা সম্মান আছে?’ মায়ের কথায় সুরেখা নিজের নামে ফরম পূরণ করে জমা দিলেন।  

১৯৬৮ সালে এনএসডিতে ভর্তি হন সুরেখা। ওম পুরী, রঘুবীর যাদব সুরেখার এনডিসির বন্ধু। অভিনয়, লাইটিং, মেকআপ, কস্টিউম—তিন বছরের কোর্স শেষে তাঁর মনে হলো তিনি কিছুই শেখেননি। সুরেখার মনে হলো, একজন অভিনয়শিল্পী হওয়ার জন্য শিল্পের বোধ আর অনুভব থাকা জরুরি। তবে এনএসডি থেকে তিনি কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আর নিয়মানুবর্তিতা শিখেছিলেন। শিখেছিলেন, একটা সবজি বা আলুও সুন্দর করে নিজের সমস্তটা দিয়ে কাটতে হয়। এনডিসি থেকে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মঞ্চে কাজ করতে শুরু করলেন সুরেখা। ১৯৭১ সালে এনডিসি রেপ্যার্টরি কোম্পানিতে যোগ দেন সুরেখা। তা ছাড়া এফটিআইর (ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া) বেশ কিছু প্রোডাকশনে কাজ করেছেন তিনি। ১৯৮৯ সালে তাঁকে সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

বছরের পর বছর ধরে মঞ্চে কাজ করার পর সুরেখা এলেন মুম্বাই। সেখানে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে কাজ শুরু করেন টেলিভিশন সিরিয়ালে। ‘বালিকা বধূ’তে একটা নেতিবাচক চরিত্র করে তিনি দারুণ জনপ্রিয়তা পান। এ জন্য ২০১১ সালে তাঁকে ছোট পর্দার সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ইন্ডিয়ান টেলি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। 

‘বালিকা বধূ’ ছাড়াও ‘এক থা রাজা এক থা রানি’, ‘পারদেশ মে হ্যায় মেরা দিল’, ‘মা এক্সচেঞ্জ’সহ বেশ কিছু সোপ অপেরায় দর্শক তাঁকে মনে রাখবে। ১৯৭৮ সালে ‘পরদেশ মে হ্যায় মেরা দিল’ থেকে শুরু করে ‘পরিণতি’, ‘নাজার’, ‘লিটল বুদ্ধা’, ‘নাসিম’, ‘সরদারি বেগম’, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’, ‘কালি সালোয়ার’, ‘রাঘু রোমেও’, ‘শির কোরমা’, ‘ঘোস্ট স্টোরিজ’ এ রকম বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি।  

সুরেখা আরেক অভিনয়শিল্পী হেমন্ত রেগেকে বিয়ে করেন। তাঁদের এক সন্তান রাহুল সিক্রি ছবি আঁকেন। হেমন্ত ২০০৯ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। বলিউডের গুণী অভিনেতা নাসির উদ্দিন শাহর প্রথম স্ত্রী ছিলেন সুরেখার সৎ বোন মানারা সিক্রি। মানারা নাসির উদ্দিনের চেয়ে বয়সে ১৫ বছরের বড় ছিলেন। আর তখন মানারার নাম ছিল পারভীন মুরাদ। কেননা, তিনি এর আগে একজন মুসলিমকে বিয়ে করে দীর্ঘদিন ইরানে ছিলেন। বিচ্ছেদের পর সন্তান নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। নাসির উদ্দিন আর মানারা মাত্র এক বছর সংসার করেছিলেন। আর তারপরই তাঁরা আলাদা হয়ে যান।

সম্প্রতি ভারত সরকার মহামারিকালে ১০ বছরের কম এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের শুটিংয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর তীব্র সমালোচনা করে সুরেখা বলেন, ‘এ রকম সিদ্ধান্তের মানে আমাদের আত্মনির্ভরশীল হতে না দেওয়া। লকডাউনের শুরুতে আমি দীর্ঘদিন অসুস্থ্ ছিলাম। হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলাম। আমি কোনো আয়ই করতে পারিনি। উল্টো চিকিৎসাবাবদ আমার সব সঞ্চয় শেষ। এখনো আমাকে কাজ করতে না দেওয়া মানে আমার রুজিরুটি আটকে রাখা। এমনিতেই আমাদের নিয়ে চরিত্র লেখা হয় কম। 

অনেক পরিচালক, প্রযোজক আমাকে ছাড়া শুটিং করতে পারছেন না। আমি তো সরকারের নির্দেশ অমান্য করে কাজ করতে পারি না। কিন্তু এ রকম সিদ্ধান্ত হলে আমাদের নিয়ে ভাবা, চরিত্র লেখা আরও কমে যাবে।’

২০২০ সালের শুরুতে স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সুরেখা। তখন খবর বের হয়েছিল, সুরেখা সিক্রির নাকি চিকিৎসার অর্থ নেই। সুস্থ হয়ে ফিরে সুরেখা প্রথম সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘আমার যথেষ্ট টাকা আছে। অন্তত চিকিৎসা করার মতো। আমি কোনো অর্থ সাহায্য চাই না। আমি কেবল চাই ভালো চিত্রনাট্য। আর মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমার প্রথম চাওয়া হবে সেটাই।’ এর আগেও একবার সিনেমার শুটিংয়ে বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যাপক আঘাত পেয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে সোজা গিয়েছিলেন শুটিংয়ে।  

‘বাঁধাই হো’তে সুরেখার কানে কম শোনা বুড়ি দাদির চরিত্রটাকে বলা হচ্ছে বলিউডের বড় পর্দার সর্বকালের সেরা পারফরম্যান্সগুলোর একটি। এ সম্পর্কে এই অভিনেত্রী ‘বলিউড হাঙ্গামা’র ফরিদুন শাহরিয়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বুড়োরা কেমন হয়? তারা সংসারে কিছুটা অবহেলিত। তাই তার কথা কেউ শুনছে কি শুনছে না, তাতে তেমন কিছু আসে যায় না। নিজের যা বলায় জোর গলায় বলে যায়। এই চরিত্রটা বলে যে আমাদের বিনোদন কনটেন্টে এ ধরনের বৃদ্ধ চরিত্র কত জরুরি। আরও বলে, বৃদ্ধ চরিত্র লিখলেই সিনেমা বা নাটক “বোরিং” হয়ে যাবে না। বয়স্করা তো আমাদের পরিবার, সমাজের অংশ। আমাদের সিনেমায় কেন তারা থাকবে না? তাদেরও তো নিজেদের পর্দায় দেখতে ইচ্ছা করে।’

ভারতীয় বিনোদনজগতের গুণী অভিনেত্রী সুরেখার প্রিয় পরিচালক শ্যাম বেনেগাল। বললেন, ‘উনি খুব শান্ত মানুষ। অল্প কথায় অনেক কথা বলেন, বোঝান। আর কারও ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না। আশা করি, ওনার সিনেমায় আমার অভিনয় ওনার ভালো লেগেছে।’ প্রিয় অভিনয়শিল্পীদের নাম জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘পুরুষের ভেতর আল পাচিনো আর নতুনদের ভেতর আয়ুষ্মান খুরানা। আয়ুষ্মান যে কেবল ভালো অভিনেতা তা নয়, ও খুব বুদ্ধিমান। এই বয়সেই ও বেশ বিচক্ষণ। বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা। আরও ২০ বছর পর ও কত পরিণত হবে, তাই ভাবি। আর নারীদের ভেতর আমার কঙ্গনা সেন শর্মাকে অত্যন্ত মেধাবী আর পরিশ্রমী অভিনেত্রী বলে মনে  হয়।’

 এই সাক্ষাৎকারে সুরেখাকে বলা হয় তিনি তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী বড় পর্দায় চরিত্র বা পুরস্কার পাননি। শুনে সুরেখা হেসে বলেন, ‘আমি বরাবরই নেটওয়ার্কিংয়ে খুব কাঁচা। আমাকে যারা বুঝে কাজ দিয়েছে, সেই কাজগুলোই করা হয়েছে। তবে থিয়েটারেই আমি আমার প্রাণ উজাড় করে দিয়েছি। একজন অভিনয়শিল্পীর অন্তত ১০ বছর থিয়েটার করা জরুরি। সেটাই শিল্পীর আসল জীবন। তাই বড় পর্দায় বড় রোল না পেলেও আক্ষেপ নেই। তবে হ্যাঁ, প্রতিনিয়ত নানান চরিত্রে কাজ করে যাওয়া জরুরি।’ 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত