মায়ের সহযোগিতায় ছেলের মানবপাচার ব্যবসা
প্রকাশ: ৮ অক্টোবর ২০২১, ২০:১৬ | আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৭:২২
ছেলে থাকেন বিদেশে আর মা দেশে বসে করেন সহযোগিতা। মা ও ছেলের রমরমা মানবপাচারের ব্যবসা চলছে মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের চরনাচনা গ্রামে। ইতোমধ্যে তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন লিবিয়াসহ কয়েকটি দেশে।
ভুক্তভোগী একাধিক পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার চরনাচনা গ্রামের মৃত বারেক ফকিরের ছেলে মিজান ফকির (৩৬) এলাকার দালাল হিসেবে পরিচিত। প্রায় ৪ বছর ধরে লিবিয়ায় বসবাস করে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত আছেন মিজান। তার এ কাজে দেশে বসে সহযোগিতা করেন মা রিজিয়া বেগম (৬০)। এ পর্যন্ত তাদের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত যুবক লিবিয়ায় গেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই নৌপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে পোহাতে হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। অনেকে বন্দি হয়েছেন আইন-শৃক্সখলাবাহিনীর হাতেও। তাদের লোভের শিকার হয়ে হারিয়েছেন সহায় সম্বল। ভুক্তভোগী কালিকাপুর ইউনিয়নের চরনাচনা গ্রামের মজিবর পুস্তির ছেলে সানোয়ার পুস্তি, নাজমুল পুস্তি, একই গ্রামের সেলিম পুস্তির ছেলে রোমান পুস্তিসহ অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
একাধিক ভুক্তভোগীরা আরো জানান, মিজান ফকিরের দালালি কাজে ভূমিকা রাখেন তার মা রিজিয়া বেগম। তিনিই মূলত গ্রাম থেকে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক লোক সংগ্রহ করেন। তাদের লোভের ফাঁদে ফেলে পাতেন প্রতারণার কৌশল। প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকায় চুক্তি করেন। পরবর্তীতে তাদের পাসপোর্ট ও টাকা পাঠিয়ে দেয় লিবিয়ায় অবস্থান করা মিজান ফকিরের কাছে। মিজান সুযোগ বুঝে লিবিয়া নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে স্পিডবোটের মাধ্যমে ইতালির উদ্দেশে রওনা দেন নৌপথে। গভীর সমুদ্রপথে অনেকেই কোস্টগার্ডের কাছে ধরা খেয়ে আবার লিবিয়ায় ফেরত আসে। এরপর পুনরায় টাকা দাবি করে মিজান। তাদের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে অসহায় এসব পরিবার জায়গা-জমি বিক্রি করে আবারও টাকা দেয় মিজানের মায়ের কাছে। এভাবেই প্রতারণার জাল পেতে অবৈধ মানবপাচার ব্যবসা করছে মা ও ছেলে।
এমনই একজন সদর উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের হবি খালাসির ছেলে আসাদ খালাসি। যিনি মিজান ফকির ও তার মায়ের মাধ্যমে লিবিয়ায় গিয়ে তিউনিসিয়ায় আটকা পড়ে আছেন। বর্তমানে তিউনিসিয়ায় দালাল চক্রের হাতে রয়েছেন আসাদ। হবি খালাসি দাবি করেন, ‘তাদের কাছ থেকে মিজান ফকিরের মা গেল ১০ মাস আগে লিবিয়া হয়ে ইতালি নেয়ার জন্য ৬ লাখ টাকা নেয়। তাদের কথা মতো সব টাকা দেয়ার পরে লিবিয়ায় যান আসাদ। কিন্তু সেখানে থেকে নৌপথে স্পিডবোট মাধ্যমে একবার ইতালিতে যাওয়ার পথে কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়ে। সেখান থেকে তিউনিসিয়ায় আসাদকে পাঠিয়ে দেয়। পরে আসাদ মিজানের সহযোগিতায় তিউনিসিয়ায় একটি দালাল চক্রের কাছে রয়েছেন। কবে আসাদ ইতালি যেতে পারবে সেটাও জানি না।’
চরনাচনা গ্রামের জাফর পুস্তি নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘মিজান ফকির অনেক দিন ধরে লিবিয়ায় বসে ইতালিতে লোক নেয়। তাদের খপ্পরে পড়ে অনেকেই অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। তার মা দেশ থেকে পাসপোর্ট আর টাকা সংগ্রহ করে। তাদের মা-ছেলের খপ্পরে পড়ে অনেকেই দুর্ভোগে পড়েছেন। আগে তাদের আর্থিক অবস্থা করুণ ছিল, এখন বাড়ির পাশে বালু ভরাট করেছে, শিগগিরই বিল্ডিং বাড়ি তৈরি করবেন। তাদের প্রতারণা থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, ‘গ্রামের মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে মা-ছেলে রমরমা ব্যবসা করছে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ মামলা দিতেও ভয় পায়। কারণ তাতে বিদেশে বসে মিজান ভয়-ভীতি দেখায়। সেখানে ভুক্তভোগীদের ওপর নির্যাতন চালানোর সম্ভাবনা থাকে। আইনশৃক্সখলা বাহিনীর এসব বিষয় নজরে আনা উচিত।’
এসব অভিযোগে ব্যাপারে রিজিয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছে লোকজন। আমাদের এলাকায় অনেক শত্রু রয়েছে। তারা আমাদের ভালো চায় না। আমার ছেলে মিজান লিবিয়া থাকে, মাঝে মাঝে কিছু লোকজন লিবিয়া দিয়ে বিদেশে গেলে তাদের খাওয়া-দাওয়া আর থাকার জন্য সহযোগিতা করে। এজন্য তো আমরা দালাল হয়ে যায়নি।’
এ ব্যাপারে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল জানান, ‘আমরা মানবপাচার রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছি। কোনো ভুক্তভোগী পরিবার লিখিত অভিযোগ দিলে তাৎক্ষণিকভাবে মামলা আমলে নিয়ে তদন্ত করা হয়। যদি কালিকাপুর গ্রামের ওই মা-ছেলের ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দেয়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া পুলিশ নিজে এসব মামলা সরাসরি করলে অনেকাংশে পজিটিভ ফলাফল আসে না।’
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত