মানবজাতিকে গোঁড়ামি ও কুসংস্কারমুক্ত করাই ব্রাহ্মসমাজের কাজ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৩, ১৪:২৫ |  আপডেট  : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:০৮

ব্রাহ্মসমাজ বা ব্রাহ্মসভা উনবিংশ শতাব্দীতে স্থাপিত এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন যা বাংলার পূনর্জাগরণের পুরোধা হিসেবে পরিচিত। কলকাতায় ২০ আগস্ট, ১৮২৮ সালে (৬ ভাদ্র ১২৩৫ বঙ্গাব্দ) হিন্দুধর্ম সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ও তার বন্ধুবর্গ মিলে এক সার্বজনীন উপাসনার মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ শুরু করেন। তাদের উপাস্য ছিল "নিরাকার ব্রহ্ম", তাই থেকেই নিজেদের ধর্মের নাম রাখেন ব্রাহ্ম।

রামমোহনের ধর্মীয় সত্য অনুসন্ধানের তৃষ্ণা তাকে উদার মন নিয়ে সকল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মের শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়নে প্রণোদিত করে। এভাবে তিনি শুধু সংস্কৃত ভাষায় হিন্দু ধর্মশাস্ত্রসমূহ, যেমন বেদ , অধ্যয়ন করেই ক্ষান্ত হননি; তিনি আরবি ভাষায় কুরআন এবং হিব্রু ভাষা ও গ্রিক ভাষায় বাইবেল পাঠ করেন। বিভিন্ন ধর্ম অধ্যয়ন তার মনে দৃঢ়প্রত্যয় জন্মায় যে, যেহেতু প্রত্যেক ধর্মেরই উদ্দেশ্য অভিন্ন, যথা, মানব জাতির নৈতিক পুনর্জাগরণ, তাই পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক ধর্মের পুনর্ব্যাখ্যা ও পুর্নমূল্যায়ন প্রয়োজন। সুতরাং তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে, তার পক্ষে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে অন্য কোন ধর্ম গ্রহণের পেছনে কোন যুক্তি নেই। তিনি প্রত্যেক ধর্মের গোঁড়ামি, শাস্ত্রীয় আচারপালন ও কুসংস্কার বাদ দিয়ে সর্বজনীন নৈতিক উপদেশাবলি গ্রহণ করবেন। কিছুদিন যাবৎ অনেকটা অন্ধের মতো অবসন্ধানের পর ১৮২৮ সাল নাগাদ তার ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা কিছুটা স্পষ্ট রূপ লাভ করে। ঐ বছরের আগস্ট মাসে তিনি ব্রাহ্ম সভা (পরবর্তীসময়ে ব্রাহ্ম সমাজ) অর্থাৎ ঈশ্বরের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও এ নব প্রতিষ্ঠিত সমাজের তাত্ত্বিক দাবি ছিল যে, এটাকে সর্বজনীন ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, তবুও এটা হিন্দুধর্মের একটি শাখায় পরিণত হয় এবং সেভাবেই বিরাজমান। এ নতুন ধর্মবিশ্বাসের ধর্মীয় মতবাদসমূহ ব্রাহ্ম সমাজের ট্রাস্টের দলিলে লিপিবদ্ধ আছে।

১৮৩৩ সালে ইংল্যান্ডে রামমোহন রায় মারা যাওয়ার পর ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনটি বাধার সম্মুখীন হয়। রামমোহনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী দ্বারকানাথ ঠাকুরের (১৭৯৪-১৮৪৬) পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) কাজটি হাতে নেন। তার নেতৃত্বে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনটি নতুন মাত্রা ও বৈশিষ্ট্য পরিগ্রহ করে। তিনি ১৮৩৯ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন যা এই নতুন ধর্মমত প্রচারে ভীষণভাবে সচেষ্ট হয়। তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা নামে একটি সংবাদপত্রও প্রকাশ করেন যেটি এ নতুন ধর্মবিশ্বাস প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সংস্কার সাধনের পক্ষেও জনমত গড়ে তোলে। এ সময়ে হিন্দুধর্মের বিপক্ষে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারকদের অত্যধিক আক্রমণাত্মক প্রচারণা চলছিল। ব্রাহ্ম সমাজের মধ্য থেকে আমূল সংস্কারের সমর্থক শ্রেণীটি বেদ যে অভ্রান্ত এ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬)। ঐ সময় পর্যন্ত বেদ যে অভ্রান্ত সেটা ব্রাহ্ম ধর্মীয় বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে বিবেচিত হতো। ১৮৪৭ সালের দিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ সমীক্ষার পর ব্রাহ্ম নেতৃবৃন্দের মনে দৃঢপ্রত্যয় জন্মে যে, বেদের অভ্রান্ততার মতবাদ আর গ্রহণযোগ্য নয়। তাই একেশ্বরবাদী ধারণা সংবলিত উপনিষদের নির্বাচিত অংশসমূহের ওপর ভিত্তি করে ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাস পুনর্নিমাণের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ব্রাহ্ম সমাজের সংশোধিত মতবাদটি ১৮৫০ সালে ‘ব্রাহ্ম ধর্ম’ অথবা ‘এক সত্য ঈশ্বরের পূজারীদের ধর্ম’ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এটা উল্লেখ করতে হয় যে, যদিও বেদকে অস্বীকার করা হয়, তবুও ব্রাহ্ম আন্দোলনের অপরিহার্য হিন্দু চরিত্র ধরে রাখা হয়। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর অনেকটা মৃতপ্রায় ব্রাহ্ম সমাজে দেবেন্দ্রনাথ নতুন জীবনের সূচনা করেন। কেশবচন্দ্র সেনের (১৮৩৮-১৮৮৪) প্রগতিশীল নেতৃত্বে আন্দোলনটি আরও ব্যাপক ভিত্তি লাভ করে। তিনি ১৮৫৭ সালে ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করেন এবং এক বছরের মধ্যে দেবেন্দ্রনাথের ডান হাতে পরিণত হন। কিন্তু প্রধানত বর্ণপ্রথা পালন ও সামাজিক সংস্কারসমূহকে কেন্দ্র করে তাদের দুজনের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। যেখানে দেবেন্দ্রনাথের পদ্ধতি ছিল কিছুটা রক্ষণশীল, সেখানে কেশবচন্দ্র সেন জাতিভেদ প্রথা পুরোপুরি বিলোপ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন এবং সমাজ সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে যান, বিশেষত স্ত্রীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনে। ১৮৬৮ সালে কেশবচন্দ্র সেন ভারতের ব্রাহ্ম সমাজ নামে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে অন্য সংগঠনটি আদি ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিতি লাভ করে। বোম্বাই, মাদ্রাজ ও অন্যান্য স্থানে বক্তৃতা-সফরের মাধ্যমে কেশবচন্দ্র সেন ভারতের বৃহৎ অংশব্যাপী ব্রাহ্ম সমাজের বাণী ছড়িয়ে দেন। প্রধানত তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করার ফলে ১৮৭২ সালে সিভিল বিবাহ আইন পাস হয়। এটি ধর্মীয় আচারাদি পালন ব্যতিরেকে অযাজকীয় বিবাহ অনুষ্ঠানের বিধান প্রবর্তন করে। আইনটি একবিবাহকেও বাধ্যতামূলক করে এবং কনে ও বরের বয়সের নিম্নসীমাও যথাক্রমে ১৪ ও ১৮ বছরে নির্ধারিত করে দেয়।

১৮৫৮ সালে তরুণ কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিলে এই একেশ্বরবাদী আন্দোলন বৃহত্তর আকার লাভ করে। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের সামাজিক রক্ষণশীলতার প্রশ্নে একমত না হলে নিজে ' ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ' (১৮৬৬) গঠন করেন এবং তখন থেকে দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ 'আদি ব্রাহ্মসমাজ' নামে পরিচিতি লাভ করে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত