বিস্মৃত তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কথা

  মহিউদ্দিন খান মোহন

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৪, ১৪:০৭ |  আপডেট  : ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:৫০

আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার পর প্রথম সোচ্চার হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র; যার উৎপত্তি হয়েছিল তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন সেন্টারে। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রটি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এর মূল অফিস ছিল আগ্রাবাদে। আর এক কিলোওয়াটের একটি ট্রান্সমিশন কেন্দ্র ছিল কর্ণফুলী নদীর অপর পারে কালুরঘাট সেতু পার হয়ে।

পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের খবরে ওই ট্রান্সমিশন কেন্দ্রে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তারা তৎপর হয়ে ওঠেন একটা কিছু করার জন্য। তাঁদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রাম কেন্দ্রের নিজস্ব লেখক ও শিল্পী বেলাল মোহাম্মদ। তিনিই তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান স্মারক ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যায় বেলাল মোহাম্মদের লেখা বই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম মাইলফলক।

সাংবাদিক জাহীদ রেজা নূর তাঁর সাম্প্রতিক এক লেখায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠন বলে অভিহিত করেছেন (আজকের পত্রিকা, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৩)। তাঁর এই মন্তব্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। কেননা, ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর নিস্তব্ধ বাংলাদেশের প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

এই বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠালগ্নে ঘটেছিল এক মর্মান্তিক ঘটনা। সে ঘটনায় তিনজন মুক্তিপাগল তরুণ প্রাণ হারিয়েছিলেন। বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীরা যখন বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত, তখন তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মাহমুদ হোসেন নামে ফ্রান্সপ্রবাসী এক বাঙালি।

তিনি ছিলেন সংস্কৃতিসেবী। সেবার এসে উঠেছিলেন চট্টগ্রামের হোটেল আগ্রাবাদে। বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল হোটেলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে। গান রেকর্ডিংয়ের জন্য কালুরঘাট ট্রান্সমিশন সেন্টারে যাওয়া-আসার সুবাদে বেলাল মোহাম্মদসহ সেখানকার অনেকের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ২৭ মার্চ মেজর জিয়ার ঘোষণার সময় তিনি সেখানে ছিলেন। মাহমুদ হোসেন একটি পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন বেলাল মোহাম্মদকে। পরিকল্পনাটি ছিল বর্ডার ক্রস করে ভারতে গিয়ে সামরিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা। তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী ভাস্করপ্রভা ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মোরারজী দেশাইয়ের (পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী) ভাতিজি। শ্বশুরকুলের প্রভাব খাটিয়ে সামরিক সাহায্য পাওয়ার কথা ভাবছিলেন তিনি।

মাহমুদ হোসেন তাঁর পরিকল্পনার কথা বেলাল মোহাম্মদকে নিয়ে মেজর জিয়াকে বলেন। জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘আর্মস অ্যামুনেশন আমাদের খুবই দরকার। আপনার মিশনের সাফল্য কামনা করি।’ এরপর মাহমুদ হোসেন মেজর জিয়াকে বলেন, ‘বর্ডার ক্রস করতে হবে তো! আপনি শুধু একটি স্লিপ লিখে দিন যে আমরা আপনার লোক, ওতেই হবে।’ অফিশিয়াল প্যাড ও সিলমোহর ছাড়াই জিয়া সে স্লিপ লিখে দিয়েছিলেন। সেই চিঠি নিয়ে মাহমুদ হোসেন, ফারুক চৌধুরী এবং ওসমান গণি নামে আরেকজন রওনা করেছিলেন ভারতের উদ্দেশে। এ বিষয়ে বেলাল মোহাম্মদ তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সেই ২৭ মার্চ রাতেই তাঁরা ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে এগিয়েছিল তাঁদের গাড়ি।

পথে পুলিশ ফাঁড়িগুলোর সামনে প্রহরা। একটা লম্ব বাঁশ রাস্তার এপাশ-ওপাশ পাতা। গাড়ি থামাতে হয়, পরিচয় বলতে হয়। তারপর ছাড়া পাওয়া যায়। বাঁশের এক প্রান্ত ওপরে ঠেলে দিয়ে গাড়ি গলিয়ে নেবার পথ করে দেওয়া হয়। ফাঁড়িতে ফাঁড়িতে এমনি যাত্রাবিরতিতে সময় নষ্ট হয়। মাহমুদ হোসেনের জন্য এ ছিল অসহ্য। তিনি তাই জোরে গাড়ি হাঁকিয়ে দিয়েছিলেন। এপাশ-ওপাশ পাতা বাঁশ ভেঙে এগিয়ে গিয়েছিল গাড়ি। পরের ফাঁড়িতে টেলিফোনে খবর চলে গিয়েছিল।

মাহমুদ হোসেনের পুষ্ট শরীর ও দীর্ঘ চুল চকিতে দেখা গিয়েছিল। সন্দেহ হয়েছিল অবাঙালি বলে। পরের ফাঁড়ি হারবাংয়ে আটক করা হয়েছিল তাঁদের। তারপর জিজ্ঞাসাবাদ। গাড়ির মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল অনেক টাকাকড়ি। বিদেশি মুদ্রাও। মেজর জিয়াউর রহমানের দেওয়া পরিচয়পত্র হয়েছিল উপেক্ষিত। ওখানে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরাও উপস্থিত হয়েছিলেন। মাহমুদ হোসেনকে সিআইএর দালাল বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। গুলি করা হয়েছিল তিনজনকে। দুজনকে ও ড্রাইভারকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।’ (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র; পৃষ্ঠা-৪৮-৪৯)

নিহত ফারুক চৌধুরীর বাড়ি বিক্রমপুরের লৌহজং উপজেলার নওপাড়া গ্রামে। ফারুক চৌধুরীর ছোট ভাই ফেরদৌস-উল-হক চৌধুরী সম্প্রতি আলাপচারিতায় আমাকে বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে ফারুক চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। অনার্সসহ স্নাতকোত্তর পাস করার পর তিনি দৈনিক ‘দ্য পিপল’-এ কর্মজীবন শুরু করেন।

ফারুক চৌধুরী ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ হোটেলে সহকারী মহাব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন। সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহী ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের শিল্পী-কলাকুশলীদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁদের মধ্যে বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দীপ, রঙ্গলাল দেব, বেগম মুশতারী শফী অন্যতম। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের পর বন্ধু মাহমুদ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম বেতারের আগ্রাবাদ কেন্দ্রটি দখলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তাঁরা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র চালু ও স্বাধীনতা ঘোষণার খবর পেয়ে সেখানে যান এবং অন্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজে অংশ নেন।

ফেরদৌস-উল-হক চৌধুরী জানান, সহকারী মহাব্যবস্থাপক হিসেবে ফারুক চৌধুরী আগ্রাবাদ হোটেলের একটি প্রাইভেট কার ব্যবহার করতেন। ২৭ মার্চ সেই গাড়ি নিয়েই বেলাল মোহাম্মদ, ফারুক চৌধুরী ও মাহমুদ হোসেন পটিয়ায় মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়েছিলেন। ২৭ মার্চ রাতে ফারুক চৌধুরী, মাহমুদ হোসেন ও আগ্রাবাদ হোটেলের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ওসমান গণি সেই গাড়ি নিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য যাত্রা করেন। তাঁরা মেজর জিয়ার কাছ থেকে একটি চিঠি এবং দুজন সিপাহি নিয়ে রওনা করেন। ২৯ মার্চ চিরিঙ্গা সেতুর কাছে তাঁদের হত্যা করা হয়। যে দুজন সিপাহিকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাঁরাই এসে সেই নৃশংস ঘটনার কথা পরবর্তী সময়ে জানান। নিহতদের দাফন করা হয় ‘মৌলভীর টেক’ নামের এক স্থানে।

স্বাধীনতার পরে আপনার ভাইকে কোনো স্বীকৃতি বা আপনাদের পরিবারকে কোনো রকম সাহায্য করা হয়েছে কি না—জানতে চাইলে ফেরদৌস-উল-হক বলেন, ‘স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু প্রেরিত ২ হাজার টাকা আমার মা পেয়েছিলেন। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী এ তিন মুক্তিসেনার আত্মত্যাগের কথা মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রসহ অনেক বই-পুস্তকে উল্লেখ করা হলেও তাঁদের “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তবে আমরা আশা করছি, বিলম্বে হলেও সরকার এই তিনজনকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেবে।’

ফেরদৌস জানালেন, স্বাধীনতার কয়েক বছর পরে তাঁদের মেজ ভাই গিয়েছিলেন বড় ভাইয়ের কবর দেখতে। কিন্তু তত দিনে নদীভাঙনে তা বিলীন হয়ে গেছে। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, কবর বিলীন হয়ে যেতে পারে, তবে এ দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁরা যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন, সেই ইতিহাস কখনোই বিলীন হবে না। স্বাধীনতাযুদ্ধের এমন বীর সেনানীদের উদ্দেশ করেই প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা খান আতাউর রহমান তাঁর ‘আবার তোরা মানুষ হ’ চলচ্চিত্রে সংযোজিত ‘এক নদী পেরিয়ে’ গানে লিখেছেন—‘হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা র’বে না,/ বড় বড় লোকেদের ভিড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে/ তোমাদের কথা কেউ ক’বে না/ তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা, তোমাদের এই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না’...।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত