বিপন্ন শকুনের বিলুপ্তিরোধে সচেতনতা  

  নির্তেশ সি দত্ত

প্রকাশ: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:৫৯ |  আপডেট  : ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০৬

পার্সি ধর্মাবলম্বীদের প্রথা অনুসারে তাদের সম্প্রদায়ের কোনো সদস্যে মারা গেলে মৃতদেহ সৎকারের উদ্দেশ্যে শকুনকে উৎসর্গ করে নির্দিষ্ট স্থান রেখে আসে যাতে শকুন মৃতদেহ খেয়ে বেঁচে থাকে। পার্সিয়ানরা বিশ্বাস করে, প্রকৃতির মাঝে মৃতদেহকে উৎসর্গ করে মারা যাওয়ার পরও পৃথিবীর খানিকটা উপকারে নিজেদের নিয়োগ করার মধ্যেই নিহিত মানব জীবনের পরিপূর্ণতা। পার্সিরা যে স্থানটিতে মৃতদেহ রেখে আসে, সেই সৎকার স্থানটিকে বলা হয় ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’৷ টাওয়ার অফ সাইলেন্স জায়গাটি একটি ছাদবিহীন সুউচ্চ কাঠামো, নিচে একটি দরজা থাকে এবং ভিতরে থাকে কয়েকটি তাক। এক সময় টাওয়ার অফ সাইলেন্সের আশেপাশে প্রচুর শকুন বাস করত। এখন শকুনের অভাবে পার্সিয়ানদের মৃতদের সৎকার করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শকুন এখন একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী

গতকাল ৩ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস। শকুন বাঁচাতে সচেতনতার জন্য পৃথিবীব্যাপী প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার ‘আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস’ পালন করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সাল থেকে শকুনের পরিচর্যা নিয়ে কাজ করছে।

শকুন লাল তালিকাভূক্ত মহা বিপন্ন প্রাণী।পশুচিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধের ব্যবহারে এবং বিরূপ পরিবেশ, নিরাপত্তার অভাব ও খাদ্যসংকটে শকুন বিলুপ্তির পথে। শকুনের প্রধান খাদ্য মৃতপ্রাণী। যেহেতু পশুচিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয় এবং ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ ব্যবহৃত প্রাণী মারা গেলে তাদের দেহে ওই ওষুধ থেকে যায় এবং সেইসব মৃতপশু শকুন খেলে সেই ওষুধ শকুনের পেটে চলে যায়। শকুন তা হজম করতে পারে না, কিডনি ফেইলর হয়ে পশু খাওয়ার এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে শকুনটি মারা যায়। ডাইক্লোফেনাক বা কিটোপ্রোফেন শকুনের কিডনি বিকল করতে সময় নেয় তিন মিনিট। 

পৃথিবীতে শকুন আছে প্রায় ২৬ লক্ষ বছর ধরে। শকুন বড় ডানাওয়ালা বৃহদাকার পাখি, এটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী শিকারি পাখিবিশেষ। এদের মাথা, ঘাড় এবং গলায় পালক নেই, তাদের ঠোঁট খুব ধারালো।

শকুনকে বলা হয় প্রকৃতির ঝাড়ুদার। এরা মৃত প্রাণী খেয়ে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে। এনথ্রাক্স, জলাতঙ্কসহ বহু রোগজীবাণু খেয়েও এরা হজম করে ফেলে। এরা ময়লার ভাগাড় থেকে খাবার খুঁজে খায়। অনেক উপর থেকে এরা মৃত পশুর দেহ দেখতে পায়, তারপর সেখানে নেমে আসে, তারপর সেই মৃত পশুর দেহ দ্রুত সাবাড় করে দেয়। তাদের পাকস্থলীর জারণ ক্ষমতা অসাধারণ, মৃত পশুর দেহ তো বটেই, তাদের হাড় পর্যন্ত হজম করে ফেলতে পারে শকুন।

এক সময়ে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই দেখা মিলত বৃহদাকার এই পাখিটির। কিন্তু এখন সিলেট এবং সুন্দরবন এলাকাতেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় শকুনের দেখা মেলে। সারা পৃথিবীতে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। বাংলাদেশে এক সময় সাত প্রজাতির শকুন ছিল। কিন্তু এর মধ্যে রাজ শকুন পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে। এর মানে হচ্ছে গত ৪০ বছরে একটিও রাজ শকুন দেখা যায়নি দেশের কোথাও।

আইইউসিএনের শকুন বিষয়ক দক্ষিণ এশিয়া সমন্বয়কারী সারোয়ার আলম দীপু বলেছেন, এই মূহুর্তে বাংলাদেশে প্রায় ৬ প্রজাতির শকুন রয়েছে। এদের মধ্যে দুইটি প্রজাতি পরিযায়ী, মানে শীত মৌসুমে আসে এবং এপ্রিল মাস পর্যন্ত থাকে। এই দুই প্রজাতি হচ্ছে হিমালয়ান শকুন এবং ইউরেশীয় শকুন। তবে বাংলাদেশে প্রধানত দেখা যায় বাংলা শকুন, শকুন শুমারিতে যে ২৬০টি শকুন পাওয়া গেছে তারা সবাই বাংলা শকুন প্রজাতির।

আইইউসিএন বলছে, এই উপমহাদেশে এক সময় চার কোটি শকুন ছিল, কিন্তু সে সংখ্যা দ্রুত কমছিল। ১৯৭০ সালের শকুন শুমারিতে দেখা গিয়েছিল, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মানে আজকের বাংলাদেশে ৫০ হাজারের মত শকুন ছিল। বাংলাদেশে ২০০৮-০৯ সালে চালানো শুমারিতে দেখা যায় শকুনের সংখ্যা নেমে আসে ১৯৭২টিতে। এর কয়েক বছর পর ২০১১-১২ সালে শকুনের সংখ্যা আরো কমে দাঁড়ায় ৮১৬টিতে।

বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৪ সালের শুমারি বলছে, এই মুহূর্তে দেশটি মোটে ২৬০টি শকুন রয়েছে। সবগুলোই বাংলা শকুন। এ প্রজাতি ছাড়াও দেশে আরো পাঁচ জাতের শকুন দেখা যায়। কিন্তু সেসব প্রজাতির শকুন অনিয়মিত ভিত্তিতে দেখা যায়।

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন আইইউসিএন বলছে, শকুন এখন সংস্থাটির লাল তালিকাভুক্ত প্রাণী। এর মানে হচ্ছে, প্রকৃতি থেকে যদি কোন প্রাণীর মোট সংখ্যার ৯০ শতাংশই হারিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে সেটি রেডলিষ্ট বা লাল-তালিকাভুক্ত প্রাণী হয়। আইইউসিএন বলছে, অক্টোবরে বাংলাদেশে আরেকটি শকুন শুমারি হবে। শুমারি শেষে ডিসেম্বরে বলা যাবে, দেশে শকুনের বর্তমান সংখ্যা কত আর তাদের প্রজননের কী অবস্থা।

শকুন রক্ষায় বাংলাদেশের সরকার বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর কমছে মহাবিপন্ন এই প্রাণীটির সংখ্যা। তাই সরকার পশুচিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেনজাতীয় ওষুধ ২০২১ সাল থেকে নিষিদ্ধ করেছে।

পশু চিকিৎসায় বিশেষ করে গরুর চিকিৎসায় ব্যবহার হওয়া দুইটি ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধের বহুল ব্যবহারের ফলেই মূলত শকুন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়া থেকে। শকুন গবেষক মি. আলম বলছেন, ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ খাওয়া প্রাণীর মাংস খাওয়ার তিন মিনিটের মধ্যে কিডনি বিকল হয়ে মারা যায় শকুন। কারণ শকুনের এনজাইম নাই। এনজাইম হচ্ছে এক ধরণের প্রোটিন জাতীয় পদার্থ যা জীবদেহে অল্পমাত্রায় বিদ্যমান থেকে বিক্রিয়ার হারকে ত্বরান্বিত করে, কিন্তু বিক্রিয়ার পর নিজেরা অপরিবর্তিত থাকে।

তাছাড়া এখন গবাদি পশু পালন এবং চিকিৎসা পদ্ধতিতে গত কয়েক দশকে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, যে কারণে আগের মত সংখ্যায় গরু বা বড় প্রাণী অসুখে মারা যায় না। ফলে শকুনের খাদ্য সংকট হচ্ছে। এছাড়া বনাঞ্চল উজাড় এবং বড় উঁচু গাছপালা কমে যাওয়ার ফলে নিরাপদ আবাসস্থলের ঘাটতি হচ্ছে শকুনের।

মি. আলম উল্লেখ করেন, এর বাইরে শকুনের প্রজনন প্রক্রিয়াও জটিল, যে কারণে এদের বংশবৃদ্ধি হার অত্যন্ত ধীর। শকুন বছরে একটি ডিম পাড়ে, এবং সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যের হার মাত্র ৪০ শতাংশ। ফলে এদের প্রজননের হার খুব ধীর। তবে আইইউসিএন বলছে, এখন হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গায় শকুনের প্রজনন সফলতা বেড়েছে। ২০১৪ সালে এটা ছিল ৪৪ শতাংশ, ২০২০ সালে সেটি বেড়ে ৫৭ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। যদিও বাংলাদেশে এখনো কোন শকুন প্রজনন কেন্দ্র নাই। কিন্তু গবেষকেরা বলছেন, দেশে এখনো শকুনের কৃত্রিম প্রজননের কথা ভাবা হচ্ছে না। বাড়তি খাবার দিয়ে জঙ্গলে তাদের প্রজননে উৎসাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

শকুন রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার এবং আইইউসিএন বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের সরকার বন্যপ্রাণী আইন ২০১২ তে শকুনকে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে একে রক্ষায় বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬ সালে এক দশকব্যাপী অর্থাৎ ২০১৬-২০২৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ শকুন সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে। বন্যপ্রাণী আইন ২০১২ তে শকুন সংরক্ষণ কর্মসূচীতে বলা হয়েছে, সরকার ২০১০ সালে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক, এবং ২০১৭ সালে দেশের দুইটি এলাকায় কিটোপ্রোফেনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর বাইরে ২০১৩ সালে জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

২০১৪ সালে দেশের দুইটি অঞ্চলকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথমটি সিলেট, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু অংশ, এবং দ্বিতীয়টি খুলনা, বরিশাল এবং ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ মিলে মোট সাড়ে ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে।

এছাড়া আইইউসিএনের সাথে সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ২০১৫ সালে শকুনের প্রজননকালীন সময়ের জন্য দুইটি ফিডিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। একটি রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে এবং অপরটি সুন্দরবনে। রেমা-কালেঙ্গায় এক সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি শকুন দেখা যেত।

এছাড়া ২০১৬ সালে অসুস্থ এবং আহত শকুন উদ্ধার ও পুনর্বাসনের জন্য দিনাজপুরের সিংড়ায় একটি শকুন উদ্ধার এবং পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। মি. আলম বলেছেন, এখনো ওই কেন্দ্রে ২০টি হিমালয়ান গৃধিনী প্রজাতির শকুন রয়েছে।
 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত