বরগুনায় পালিত হলো 'গণহত্যা দিবস'
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২১, ১৯:২৭ | আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২১
২৯ ও ৩০ মে বরগুনা গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এ দু’দিনে সংগঠিত হয়েছিলো বরগুনার ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত কালো ঘটনা। মানুষের জন্য নিরাপদ স্থান বলে বিবেচিত বরগুনা জেলখানায় ৭৬ জন স্বাধীনতাকামী নিরপরাধ বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। পাক হানাদার বাহিনীর মেজর নাদের পারভেজের নেতৃত্বে স্থানীয় শান্তি বাহিনীর প্রধান এমএলএ আ. আজিজ মাস্টারের সহযোগিতায় এ নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়।
জেলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার মুক্তিকামী শহীদদের সন্তানরা শনিবার সীমিতভাবে আয়োজন করে জেলহত্যা দিবসের। সকাল ১১টায় শোকর্যালির মাধ্যমে বরগুনার শহীদ স্মৃতিসৌধে উপস্থিত হন তারা। সেখানে আলোচনায় শহীদ পরিবারের সন্তানদের মধ্যে অ্যাডভোকেট ফরহাদ ও হিমাদ্রি শেখর কেশব। উপস্থিত অন্যান্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন বরগুনা আইনজীবী সমিতির সাবেক সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান বাহাদুর, অ্যাডভোকেট শাহ আলম গাজী, অ্যাডভোকেট মোস্তফা কাদের প্রমুখ।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৭১ সনের ২৭ মে মেজর নাদের পারভেজের নেতৃত্বে পাক হানাদার বাহিনী বরগুনায় প্রবেশ করে। তৎকালীন গণপূর্ত ডাকবাংলোয় অবস্থান নেয় বর্বর এ বাহিনীর সদস্যরা। ওইদিনই তারা বরগুনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন এবং মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে বৈঠক করে একটি নিখুঁত গণহত্যার পরিকল্পনা করেন। তাদের সহায়তা করে দেশীয় রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা মুক্তিকামী পরিবারে হানা দিয়ে দিয়ে পুরুষ মহিলাদের হাত পেছন মোড়া করে বেঁধে নিয়ে আসে ক্যাম্পে। সেখান থেকে যুব মহিলাদের পাঠানো হয় ডাকবাংলোয় আর পুরুষদের পাঠানো হয় জেলখানায়। পৈশাচিক নির্যাতন শেষে মেয়েদের পরের দিন ছেড়ে দেয়া হয়। জানানো হয় পুরুষদের দু’দিন পরে ছাড়া হবে। কিন্তু তাঁদের আর দেখা পায়নি পরিবারের সদস্যরা। ২৯ ও ৩০ মে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম জঘন্য এক ঘটনা ঘটে বরগুনার জেলখানায়। কারা অভ্যন্তরে ২৯ মে সকালে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয় ৪২ জন মুক্তিকামী জনতাকে। পরের দিন সকালে একইভাবে আরও ৩৪ জনকে হত্যা করা হয়। এই শহীদদের লাশও স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। জেলখানার পশ্চিম পাশে গণকবরে মাটি চাপা দেয়া হয় তাদের। গুলি খেয়েও যারা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও কোদাল দিয়ে পিটিয়ে হত্যা নিশ্চিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অনেক নারকীয় ঘটনা ঘটেছে তবে জেলখানার অভ্যন্তরে গণহত্যার ঘটনা বিরল।
বরগুনা-১ আসনের ৫ বারের জননন্দিত সাংসদ অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বাবা ধৈর্য্যধর দেবনাথ ছিলেন সেই মহান শহীদদের ভেতরে অন্যতম প্রধান। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিলো ৩০ মে। সেদিন জেলাখানার হত্যাকাণ্ড থেকে ভাগ্যগুণে রক্ষা পেয়েছিলেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, জেলখানা থেকে অনেক লোককে ছেড়ে দেয়া হলেও তখনকার তুখোড় ছাত্রনেতা শম্ভু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে সেসময়ে পটুয়াখালী জেলার সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত, ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর নাদের পারভেজ গ্রেফতার হওয়া ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বাবাকে প্রস্তাব দেন, ছেলেকে ধরিয়ে দিলে আপনাকে ছেড়ে দেবো। কিন্তু বেশ কয়েকবারের চেষ্টাতেও ছাত্রনেতা শম্ভুকে ধরতে না পেরে তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। পাক বাহিনীর মেজর নাদের পারভেজ এবং ক্যাপ্টেন একজন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের পিতা হয়ে সেই শর্ত মেনে নিতে রাজি হন নি তিনি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তখন এক দিকে ছিলো দেশ আর নিজের সন্তান অন্য দিকে মৃত্যু। সেই সংকটময় মুহূর্তে দেশ আর নিজের সন্তানকে নিঃশঙ্ক চিত্তে উপরে তুলে ধরে তিনি মেনে নিয়েছিলেন মৃত্যুর নিষ্ঠুরতম নিয়তিকে। অমানুষিক নির্যাতন শেষে হায়েনারা দুটো গুলি করেছিলো তাঁকে। প্রথম গুলিতে মৃত্যু না হওয়ায় দ্বিতীয় গুলিটি করে নিশ্চিত করা হয়েছিলো মৃত্যু।
এ প্রসঙ্গে বরগুনা-১ আসনের সাংসদ ও মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেন, ১৯৭১ সালের ২৯ ও ৩০ মে বরগুনার ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম কালো অধ্যায় রচিত হয়েছিলো। মুক্তিকামী সাধারণ জনগণকে ধরে নিয়ে এনে তাঁদেরকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়, গুলির পরেও যাঁরা মারা যায়নি তাঁদেরকে কোদাল ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছিলো। সেদিনের সে মহান শহীদদের ভেতরে আমার বাবাও ছিলেন। তিনি আমাকে বাঁচাতে এবং দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে নির্ভীক চিত্তে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। এটা আমার জন্য যেমন অত্যন্ত গর্বের এবং তেমনি কষ্টের। সেদিন আমার বাবাসহ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন তাঁদের প্রতি আমি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত