প্রকৃতির অভিশাপ

  শাশ্বত স্বপন

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২১, ১০:৫২ |  আপডেট  : ৩ মে ২০২৪, ১৬:৪৫

আপনার গ্রামের কথা একটু ভাবুন, আপনার বাড়ির কোন একটা ঘরের পেছনে একটা ডোবা বা একটা পুকুরও ছিল বা  এখনও আছে। আপনাদের অনেক বড় বাড়ি আর অনেক বড় পরিবার হলে একটা দীঘিও থাকতে পারে। আপনার বাড়ির পাশে হয়তো দুই তিনটে বাড়ি থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। আপনাদের ডোবা বা পুকুর বা দীঘি যখন খনন করা হয়, তখন আপনাদের ছোটরা খেলা করেছে, 'এই গাঙ্গে কুমির নাই, নাইয়া ধুইয়া বাড়ি যাই।' খননকৃত সেই মাটি দিয়ে আপনার ঘর বা উঠানের সমতল ভিত্তি গড়েছেন, সেখানে দাগ কেটে কোট বানিয়ে  ছোটবেলায় এক্কা দুক্কা, কুত্ কুত্ খেলা করেছেন।  কদম ফুল, বরুন ফুল দেখে খুশি হয়ে পুকুর পাড়ে রোপন করেছিলেন, ভরা বর্ষায় পাড় ভেঙ্গে সে গাছ জলে চলে যায়, বছরের পর বছর ধরে জলে পড়ে থাকা সেই পঁচা গাছের গুঁড়ির ভেসে  থাকা অংশে অন্য কোন গাছের চারা গজিয়ে উঠে।

 আপনার বাড়িরপূ্র্ব-পশ্চিম বা উত্তর-দক্ষিণের দুইটি ঘরের ফাঁকা জায়গায় আম-জাম-কাঠাল-পেয়েরা-পেঁপে-কাচামরিচ-বেগুন-লেবু আরো কত কি গাছ ছিল বা আছে, তাই না? পুকুরের চারদিকে হিজল-করচ, আবার কেউ কেউ কলাগাছ রোপন করে। একটি ঘরের পেছনে অথবা পাশেই তো পুকুর, তার আশেপাশে একটু দূরে একটি বাঁশের তৈরি পায়খানা, না হয় তিন-চারটা সেনেটারী চাকতি দিয়ে তৈরি একটি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ির পয়ঃনিষ্কাশন লাইনটা পুকুরের দিকেই থাকে। মনে আছে অবশ্যই, পায়খানার চারিদিকেই কিন্ত জঙ্গল, কত নাম না জানা গাছ জন্মে, তবে ভেরেন্ডা, ডোলকলমী, হেলেন্চা, বড়ুই গাছ, সেই বড়ুই গাছের উপর পরজীবি স্বর্ণলতা,  মনে পড়ে? বৃষ্টিস্নাত সেই স্বর্ণলতা কি চিকচিক করত! কাক-দোয়েল-চড়ুই-কোকিল-মাছরাঙ্গা-ডাহুক-বাবুই-শালিক আরো কত পাখি! পাখির বাসার খুঁজে কত দূরে চলে যেতাম,  কত উপরে মগডালে উঠে যেতাম, তাই না?

 

 আরেকটু স্মৃতিতে যাই, ভাটিবাংলার মানুষ আমরা, বর্ষার পানিতে পুকুর ডোবে যায়, উঠানেও পানি চলে আসে, মাঝে মাঝে রাস্তাটাও ডুবে যায়। বর্ষার স্রোতে পুকুরে নানা রকম মাছ আর জলজ উদ্ভিদে পূর্ণ হয়ে উঠে। এক বর্ষাকালীন সময়েই, গুল্ম লতা পাতা সবই পানিতে ডোবে মরে যায়, বর্ষা শেষে আবার গজে উঠে। বর্ষার পানি নদীতে, সমুদ্রে চলে যাবার পর, পলি মাটিতে আপনাদের কয়েক বিঘা জমি তখন উর্বর, বীজ বুনলেই ফসল, এখন তো সেখানে ইটের ভাটা, অথবা ইট পাথরের দালান- কোঠার জঙ্গল, তাই না?

 ভাটিবাংলায় এক সময়ে মানুষেরা বেশ শান্তিতে ছিল, সেই শান্তির কথা অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাই  দিনে দিনে অন্য দেশের, অন্য জেলার বহিরাগতরা বসতি গড়তে লাগল। বহিরাগত স্রোতের সাথে শান্ত লোকালয়গুলোতে বিভিন্ন মতবাদের লেবাস নিয়ে ভণ্ডরা পীর-আওলিয়া-সাধু-সন্যাসী-পাগল বেশে দোজখ- নরকের ভয় দেখাতে থাকে। আপনারা ক্ষেতে তখন বীজ বুনছেন, আর ভণ্ডরা আপনার মনের মাঠে বীজ বুনেছে, বুনছে। এভাবেই এক সময় আপনারা ধর্মের নামে অধর্মের নেশায় আশক্ত হয়ে ছিলেন, কেউ আবার বেশি আসক্ত হয়ে যায়, তখন কষ্টকর উৎপাদন বাদ দিয়ে ধর্ম ব্যবসায় আপনিও নিমর্জিত হয়েছেন। 

 সেই যাই হোক, আমরা এবার আপনার বাড়ির ইকো সিস্টেমের দিকে তাকাই। ঘরে ভাত খেয়ে কাঠের ফাঁক দিয়ে নিচে খাবার ফেলছেন না? শীতকালে, হাঁস-মুরগী ও এদের বাচ্চারা খেয়ে ফেলে, বর্ষাকালে মাছেরা খায়। যে ছিটালে বা ময়লার ভাগাড়ে অধিকাংশ ময়লা ফেলেন, তা কিন্ত পায়খানার কাছেই। সেখানে দিনের বেলা আপনাদের কুকুরেরা খাবে, মুরগীরা খাবে, বিকাল- সন্ধ্যা- রাতে বিড়ালে খাবে, ইঁদুরে খাবে। আর রাতে, বিশেষ করে কাক জ্যোৎন্সায়, কাক ভোরে শিয়াল-বাগডাসা-মেছো বিড়াল--এরাও খায়। মনে পড়ে, খাদ্য সংকটে পড়ে, বিশেষ করে বর্ষাকালে, বাঘডাসা বা শিয়ালেরা হা্ঁস-মুরগী বা তাদের ছানা চুরি করার জন্য উত্ পেতে জঙ্গলের কাছে বসে থাকত। আবার দিনের বেলা হাঁস মুরগীর বাচ্চা ছুঁ মেরে নেবার জন্য ক্ষেতের উপর উড়াল দিয়ে চিল-শকুনেরা হানা দিত। আর অতি ক্ষূদ্র ক্ষূদ্র খাবারের কথা তো ভুলেই গেলেন। নিরিহ গা বাওয়া পিঁপড়ে আর লাল বিষ পিঁপড়ে সারাদিন দলে দলে এসে সেই ক্ষূদ্র খাবারগুলো মুখে পুড়ে নিয়ে যেত। তারপর, গা ঘিন ঘিন করা তেলাপোকা, মনে আছে, তেলাপোকাগুলোকে পিষে মেরে ফেললে, পিঁপড়েরা খেয়ে সাবাড় করে দিত, মাঝে মাঝে কোথা থেকে রেলগাড়ির মত শত পায়ে চলা লাল পোকা, ছুলেই জিলাপির মত গোল হয়ে যায, তারপর কানচোরা পোকা, আরো কত পোকা, দেখতাম ঘরের বেড়া, পাটাতনের ফাঁকে ফাঁকে, বিশেষ করে লাকড়ির ঘরটাকে পোকার সংখ্যা বেশিই ছিল। 

 ও, ব্যাঙের কথা তো ভুলেই গেছি। পুকুরের সোনা ব্যাঙ আর  ঘরের কুনো ব্যাঙ কোটি কোটি পোকা মাকড় বিশেষ করে মশা খেয়ে আপনাদের বাড়ির ইকো সিস্টেমটা সচল রেখেছিল। উঁইপোকার কথা মনে পড়ল, পাটখড়ির গায়ে মাটি জমা করে কি যে করত! টিকিটিকি, রঙ বদলানো গিড়গিটি তারাও কত পোকামাকড় মেরে খেত। টিকটিকির লেজ, ডিম নিয়ে কত কি করেছি!

দিনের বেলা আপনাদের পঁচা মরা প্রাণিজ বস্তুকে কুকুর ,কাক, শুধু কুকুর কাক কেন, চড়ুই, বাবুই, শালিক --কত পাখিই তো খুটে খুটে খেত। আর রাতের বেলা ইঁদুর, বেড়াল, শিয়াল, বাঘডাসা, গেছোবিড়াল –এরা বাকি সব বর্জ্য খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখত। দাদার কাছে, দাদুর কাছে হাতি-বাঘের গল্প শুনেছেন? কোন সময় এখানে ঘন জঙ্গল ছিল, জঙ্গলে নাকি হাতি বাঘ, ভল্লুক  ইত্যাদিও ছিল, তাদের পূর্ব পুরুষরা দেখেছে, শিকার করেছে, মেরেছে এবং নিজেরাও শিকার হয়েছেন। 

তারপর রবি সষ্যের সময়ে ইঁদুর কিন্ত অত্যাধিক বেড়ে যায়, বাসা থেকে ফসলের মাঠ পর্যন্ত ইঁদুর আর বিড়ালে ছুটাছুটি কে না দেখেছে। মাঝে মাঝে কুকুরেরা মিলে বিড়ালদেরকে দাওয়া করলে উপায়ান্ত না পেলে বিড়াল কাঁটাওয়ালা মান্দার গাছে উঠে যায়। রাতে বিড়াল ইদুরকে তাড়া করত, কখনও কখনও বড় ইঁদুর, চিকা একা বা একত্রে মিলে বিড়ালকে তাড়া করত। ধান ক্ষেতে গভীরে, যখন ধান প্রায় পেকে আসত, হঠাৎ চোখে পড়ত বাবুই নাকি ঘুঘু পাখির বাসা,  বাসাতে কখনও ডিম কখনও পাখির বাচ্চা দেখা যেত। 

 লাকড়ির ঘরটার কথা মনে আছে? খড়ের স্তুপ? লাকড়ির ঘরে, গোয়াল ঘরে, খড়ের স্তুপে আর জঙ্গলে সাপ দেখতে পাওযা যেত, ফণিমনসা, দুধরাজ,  গোখড়া, শঙ্খিনী, আর পুকুরে দেখা যেত ডোরা সাপ --এরা সবাই ইঁদুর, ব্যাঙ খেয়ে বেঁচে থাকে, মাঝে মাঝে মুরগীর ছানাও খায়।  

চলুন একটু ফসলের মাঠে যাই, দিনের শেষে, সন্ধ্যায় শুরু হত হুক্ক হুয়া ডাকে, বিশেষ করে, রাতে শিয়ালের সংখ্যাটা বেশি  থাকবেই, একদল আরেক দল দৌঁড়ানি দিত, মারামারি হত, আর সেকি চিৎকার, বাসার কুকুরগুলো হুক্কা হুয়ার  বিপরীতে ঘেউ ঘেউ করতে থাকত। তবে যেদিন পঞ্চায়েত কবরে কারো লাশ দাফন হয়, তখন কয়েকদিন বাড়ির ত্রিসীমানায় তাদের কম দেখা যায়। শিয়ালেরা আখের ডগা ভেঙ্গে রস খায়, রস যা খায়,  তার দশগুন ডগা ভেঙ্গে রেখে যায়, পরদিন সেগুলো কেটে ফেলে দিতে হয়। খাল পাড় ধরে সারারাত মরা কোন প্রাণির দেহ, মরা তাজা মাছ খুঁজতে থাকে।

 কখনও সারা রাত হাঁস-মুরগীয় খোয়ারের পাশে, বা কাছের জঙ্গলে চোরের মত বসে থাকে, কুকুরের আওয়াজ পেলেই, দে ছুট!  রাতের বেলা কখনো কখনো শিয়াল বা বাঁঘডাসা মুরগি টেনে নিয়ে যাচ্ছে আওয়াজ পেলে লাটি টেটা নিয়ে আপনি আমি, সবাই ক্ষেত পর্যন্ত চলে যেতাম। কখনো মরা মুরগী পেতাম, কখনো পেতাম না। দিনের বেলাও শিয়াল বাঘডাসা বাড়ির পাশে ঝুপের মধ্যে উত্ পেতে লুকিয়ে থাকত, সুযোগ বুঝে মুরগী বা মুরগীর ছানা নিয়ে লুকিয়ে পড়ত। সেই শিকার হওয়া মুরগীর আওয়াজ পেলে, পাড়ার সবাই মিলে দা-কাচি-লাঠি-টেটা নিয়ে জঙ্গলে খুঁজতে থাকতাম, কুকুরগুলোও আমাদের সাথে দৌঁড়াত, পাড়ার ছোটরা পেত আনন্দ, অর্জন করত অভিজ্ঞতা। আপনার গ্রামটাও তো এ রকমই ছিল, তাই না?

চলেন, একটু স্কুল বা কলেজে যাই। কত বড় জায়গা, কত ছাত্র-ছাত্রী, কত শিক্ষক! এখানে একটা/ দুইটা বড় পুকুর, আর একটা খেলার মাঠ থাকবেই। স্কুল কলেজের পাশে বনাদী গাছ বা জঙ্গল থাকে। বিকালের পরে স্কুলের সীমানায় নিরবতার কারণে শিয়ালের সংখ্যাটা বেশিই থাকে। তারপর যে রাস্তা ধরে স্কুলে আসলেন, তার কোন এক পাশে বা দুইপাশে সরু খাল থাকে, খালের এক পাশে হয়তো একটা সামাজিক কবর থাকতেও পারে। আপনাদের বাড়ির পুকুরের কিনারাতে আর এই খালের কিনারাতে কাকভোরেও শিয়ালদের দেখা যায়। আপনারা যে ভাগারে মরা গরু ছাগল ফেলে দিয়ে আসেন, ঋষিরা চামড়া তোলে নেবার পর ভাবছেন, কোন প্রাণিগুলো তা খেয়ে সাবাড় করে?

যে জমি, যে জঙ্গল পরিষ্কার করে আপনি বসতি গড়ে তোলেছেন, স্কুল-কলেজ গড়ে তেলেছেন, প্রকৃতির এই জায়গাগুলোতে আমরা সহ উপরে বর্ণিত সব প্রাণির বসবাস করার অধিকার ছিল। কিন্ত আমরা ক্ষমতা বলে অধিকাংশ দখল করে, ওদের জন্য সামান্যই বাকি রেখেছি। তবু তো গ্রামে রেখেছি, শহরে তো কল্পনা করাও যায় না। 

আপনার বাড়ির পাশে তালগাছের পাতায় বাবুই বাসা দেখেছেন, মনে আছে? কত বাসা, কি নিঁখুত বাসা বানায়! কোন ইন্জিনিয়ার ওদের কিছু শিখায় নাই। সাপের বাচ্চা জন্মের পরই সাঁতরাতে পারে, নিজেই খেতে পারে। শিয়াল কুকুরের বাচ্চারাতো জন্মের কিছুক্ষনের মধ্যেই হাঁটতে, দৌঁড়াতে পারে। ওরা খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না, আমাদের মুখপানে চেয়ে থাকে। নইলে মানুষের চেয়ে মাঝে মাঝে মনে হয়, এই সব প্রাণিগুলোই বেশি ভাল।  

আপনাদের বাসার কাছে কাচা রাস্তার উপর কয়েক ভচর হল নতুন পাকা রাস্তা তৈরি হয়েছে। রাস্তাটা বর্ষাকালে পানিতে তলিয়ে যায়,  তাই বছর বছর মেরামত করতে দেখেন।,হঠাৎ রাস্তায় ইট-সিমেন্ট-পীচ ভেদ করে জীবনের জয়গান দেখেছেন? নতুন কোন বৃক্ষের জেগে উঠা? মনে পড়ছে? 

চলুন, আপনার বাড়ির পেছনে পুকুরে যাই। সেচ দিয়ে সব পানি বিরান মাঠে ছড়িয়ে দেন, কাঁদা কাঁদা হলে লাঙ্গল চালাতে সুবিধা হয়। পুকুর জল শূন্য করতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল নির্বিষ ডোরাসাপ। আপনাদের বীর পুঙ্গমরা পিটিয়ে মেরে তক্তা বানিয়ে দিয়েই থেমে থাকেনি, তারপর মরা তক্তা সাপটিকে চাকু দিয়ে ফালা ফালা করে, পাশের জঙ্গলে ফেলে গেল।  জঙ্গলের জমিনওয়ালা, যে নিজের জঙ্গলে মাত্র আগুন দিয়েছে, সেখানে ছুড়ে মেরে  এক বীর পু্ঙ্গম দেখাতে চাইছে, সে কত বীর, কত মহৎ! ও বলা হয়নি, আপনার বাড়ির দুইশত হাত পশ্চিমে নতুন প্রতিবেশি চলে আসছে, তাই জঙ্গল কেটে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন জ্বালিয়ে প্রকৃতির আজে-বাজে, অপ্রয়োজনীয় সাপ-ব্যাঙ-আরজিনা-শিয়াল-ইঁদুর-নানান পোকামাকড়ের সব বসতি পুড়িয়ে মেরে পরিষ্কার করে দিয়েছে। পরিষ্কার করতে গিয়ে পাখির বাসা, সেই বাসায় থাকা পাখির ডিম দেখে প্রতিবেশি কত মানবিক গল্প বলেছিল, মনে আছে? আমরা এমনি মানবিক! যে প্রাণিগুলো নিজেরাই এক একটা খাদক, বড় প্রাণিটা ছোটটাকে খেত, মৃত্যুর এত ভয় সত্ত্বেও তবু প্রাণিগুলো মানুষের কাছে থাকতে চাইত না, নিজেরাই খাদ্যচক্র শৃংখলের মধ্যে একত্রে সাবধানে থাকত, লোকালয়ে রাত না হলে আসতে চাইত না। কারণ তাদের কাছে বড় জানোয়ার ছিলাম আমরা। 

সব মাছ তোলা হলে বাচ্চাদের খেলা চলতে থাকত। পুকুরের ব্যাঙ আর কাউট্রা নিয়ে লাঠি দিয়ে পিটাপিটির সে কি খেলা! এ না হলে কি মানুষের বাচ্চা! বড় হলে ছাগল-ভেড়া-গরু-মহিষ মারবে কিভাবে? এখন থেকেই তো শিখতে হবে। বড়রা হাসছে, আমিও, মানুষ তো।

বাড়িতে নতুন জামাই আসছে, তার ইচ্ছা কই মাছ ভাজা খাবে এবং নিজেই মাছ ভাজবে। গতকাল তার শখ হয়েছিল গৃহপালিত ছাগল ছানা মানে কচি মাংশ খাবে। কি আর করা, শ্বশুর মশাই আবদার পুরণ করেছিল। তবে ছোট ছেলেটা তার আদরের ছাগল ছানার জন্য খুব কেঁদেছিল। তাই নতুন জামাই  ছোট শ্যালককে মেলা থেকে ডুগডুগি কিনে দিয়েছে। নতুন জামাই আবার মরা কই খাবে না, তাই গরম তেলে মসলা মাখা তাজা কই সে নিজেই ভাজতে লাগল, তার বউ তাকে সাহায্য করতে লাগল। গরম তেলে কই মাছের লাঠালাফি দেখতে কি মজা! হ্যাঁ, কচি ছাগলের মাংস, আর গরম তেলে ভাজা কৈ আমিও খেয়েছি। কি যে স্বাদ! আহ! মানুষ তো, কি বলেন? 

কয়দিন ধরে রাতে ঘরে তেলাপোকা ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে গেল। মশা তো পারলে সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। নেবে না কেন? সাপ- ব্যাঙ তো প্রায় সবই মেরে ফেলেছি, ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে টিকটিকির সব ডিম নষ্ট করে ফেলেছি। বিরান জলমগ্ন মাঠে মশাসহ যে পোকামাকড় ছিল সব তো বাড়িতে চলে আসবেই। 

ইঁদুরের গর্ত পানিতে ডুবে গেছে, বাচ্চাসহ কিছু ইঁদুর আশে পাশের জঙ্গলে গেছে, বাকিরা সব এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। বাঘডাসা, শিয়ালগুলো দূরে কোথাও গেছে, রাতে হয়তো লোকালয়ে আসবে,  এখন মাছ, মুরগীর সাথে তারা ইঁদু্রও খেতে পারবে। 

 ইঁদুর রাতের বেলা জামাকাপড় কাটে; রান্না তরকারী খেয়ে ফেলে;  কলা, আলু সব নিয়ে যায়, সেই সাথে তেলাপোকা বিভিন্ন ময়লা খেয়ে, পায়ে মুখে মেখে ঘরের সব খাবার ছুয়ে যাচ্ছে,  খাচ্ছে।  বর্ষার কারণে ঘরের সব জায়গায় তেলাপোকা, পিঁপড়ে সহ নানান পোকা-মাকড়। 

 ইঁদুর, তেলাপোকাসহ পোকামাকড়ের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে গৃহকর্তা পরদিন ইঁদুরের বিষ ও তেলাপোকার বিষ, পোকামাকড়ের বিষ, সেই সাথে ইঁদুরের ফাঁদকল বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসছে। রাতে ইঁদুর, তেলা পোকার বিষ রান্নাঘর সহ আরো কিছু জায়গায়  ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। সকাল বেলা গৃহকর্তার দুই বছরের নাতি ঘুম থেকে উঠে দেখে মা নাই, তাই হামাগুড়ি দিয়ে, টিনের বেড়া, দরজা ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে রান্না ঘরে চলে যায়। সে জানে মা নানী রান্না ঘরেই থাকে। তারা তখন সবাই প্রতিবেশির বাসায় গেছে বাঘডাসার ছানা দেখতে।  গতরাতে প্রতিবেশির বড়ছেলে নাকি বাঘডাসার ছানা ধরেছে। বাঘডাসা সেই রাত থেকে আউৎ আউৎ করে ডেকে চলেছে, সকালে আর ডাকেনি, কেউ বলছে একটু আগে বাঘডাসা পাটাতনের নিচে ছিল, কুকুরের চিৎকারে পালিয়েছে।

 এদিকে আপনাদের ঘরের বাচ্চা প্রতিদিন রান্নাঘরে মা আর দাদীর হাতে অনেক কিছু খায়, আজও চিনি ভাত দেওয়া মজাদার খারাপ খাচ্ছে। তারপর হাসপাতাল। না মরে যায়নি। বাড়ি ফিরে শুনে ছোট ছেলে ইঁদুরের কল নিয়ে খেলতে গিয়ে হাত কেটে রক্ত বের হচ্ছে। 

মোবাইল নেটওয়ার্ক বেশী পাওয়ার জন্য লিমিটের চেয়ে বেশী নেটওয়ার্ক টাওয়ার বসালে পাখির ক্ষতি হয়। পাখি ফসলের ক্ষতিকারক কীট পতঙ্গ খায়। পাখি কমে গেলে সেই কাজ ব্যাহত হয়, গাছ-ফসলের ক্ষতি হয়। তখন ফল, ফসলে বেশী কীটনাশক, কেমিক্যাল দিতে হয়, খাবারও বিশাক্ত হয়ে যায়।  আজকাল আপনার, আমার গ্রামের তিন-চার তলা বাড়িতে কতগুলো নেটওয়ার্ক টাওয়ার বসানো  আছে? 

আপনাদের গ্রামে কয়টা বটগাছ, পাকুর গাছ, তালগাছ, গাবগাছ, খেজুর গাছ ছিল, মনে আছে? ছোট বেলায় যা দেখেছি বড় বেলায় তার চেয়েও কম, তাই না? হিন্দুরা বটগাছটাকে ধর্মীয় কারণে গুরুত্ব বেশি দেয়, তাই হিন্দু গ্রামে বা পাড়ায় এক বা একাধিক বটগাছ দেখা যায়, বটগাছের জন্মই হত পুরনো দালানে বা ভাঙ্গা মন্দিরকে আশ্রয় করে। শুধু ছায়া দেয়, ফল খাওয়ার যোগ্য নয় বলে, এই কারণে কেউ বটগাছ রাখতে চায় না, তারপর ভুতের বিষয়তো আছেই। 

    

 বটফল খেয়ে হাজার হাজার ছোট বড় প্রাণী বেঁচে থাকে। তারপর আশ্রয়ের জন্য, বিশ্রামের জন্য কত –পোকামাকড় নির্ভরর্শীল, তা কয়জন জানে?  একটা প্রাচীন ফলবান বট গাছে প্রায় এক হাজার হরিয়াল জাতীয় পাখি বাঁচতে পারে; এছাড়া কোকিল, বসন্ত বৌরিসহ যাবতীয় ফলখেকো পাখিরা তো আছেই, আছে নানা ক্ষুদে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা। আরো আছে হাজার  জাতের পোকামাকড়, যাদের জীবন পুরাপুরি এই গাছের উপরেই নির্ভরশীল।  একটা বটগাছকে কেন্দ্র করে বিশাল এক ইকো সিস্টেম গড়ে ওঠে। সেই পাখি, প্রাণীরাই আবার বটের বীজ ফলের মাধ্যমে দূরদূরান্তে নিয়ে  গাছের বংশবিস্তারে সাহায্য করে। একটা গ্রামে বট, পাকুড়, পলাশ, শিমুল, মান্দার, কদম, ঢাকি জাম, তাল, পেয়ারা, ডুমুর, বহেরা, লটকন,আমলকী, হরিতকী, হিজল, করচ, কামরাঙা, ছাতিম, কাঠবাদাম, সজনে গাছগুলো থাকলে সেই গ্রাম পাখির জন্য আদর্শ গ্রাম।

 গরমকালে সবাই গরম নিয়ে চিন্তিত থাকে, আর আবহাওয়া বার্তা শুনে, " কবে বৃষ্টি হবে ?"। কিন্তু গরম কেন, বৃষ্টি কেন হচ্ছে না, তার কয়েকটা কারণ জেনেও জানে না। লোভ-লালসা আর আর্থিক কারণে অনেক বছর যাবত দেশে এবং পুরা বিশ্বে অনেক গাছ কাটা হচ্ছে। কিন্তু নিয়মিত ভাবে গাছের চারা লাগানো হচ্ছে না, লাগালেও যত্ন নেওয়া হচ্ছে না, চারা মরে যাচ্ছে । অক্সিজেন কমছে, কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাড়ছে। গাছ কম, তাই কার্বন ডাই অক্সাইড বেশী, অতিরিক্ত কলকারখানার ধোঁয়া , যানবাহনের ধোঁয়ার মধ্যে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন গ্যাস এর জন্য গ্রিন হাউজ এফেক্ট বাড়ছে, তাপমাত্রাও বাড়ছে। 

ডোবা, পুকুর, খাল, নদীর আয়তন কমছে কারণ সেগুলো ভরাট করে বিল্ডিং বানানো হচ্ছে, তাপ শোষন করার পর্যাপ্ত পানি আজকাল কোন গ্রামেই পাবেন না।  পানি কমলে, বৃষ্টি কমবে, গরম বাড়বে। ইকোসিস্টেম নষ্ট হলে, গরম বাড়লে বিভিন্ন রোগ বাড়ারও আশংকা থাকে। শুধু মাত্র কাগজের টাকার কারণেই পৃথিবীর ইকোসিস্টেম শেষ করে দিচ্ছে সবাই। 

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত