পরীকাণ্ডে লম্পটরা যেন পার পেয়ে না যায়  

  শরীফা বুলবুল

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২১, ১২:৫৯ |  আপডেট  : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০১

নারীকে নিয়ে কোনো ঘটনা ঘটলেই এক শ্রেণির পুরুষের মুখোশ খুলে পড়ে। এতোদিন ধরে যারা সাধু-সন্ন্যাসী ছিল, তারা হঠাৎ শয়তানে রূপ নেয়। তাদের আর চেনা যায় না। হোক সে রাস্তার ভবঘুরে কিংবা সমাজের এলিটপুরুষ; হোক সে রিকশাওয়ালা কিংবা অফিসের বড়কর্তা। লাম্পট্যে তারা যেন ভাই ভাই। যাদের চোখে নারীর সুন্দর শরীরের পরতে পরতে যৌনতা ছাড়া আর কিছুই নেই। এরা নারীর ট্যালেন্টকে প্রচণ্ডরকম ভয় পায়। সুন্দরী বোকাদেরই এরা পুজা করে। পরীমনির ঘটনা না ঘটলে চারপাশের অতিকাছের ছদ্মবেশি, মুখোশধারী পুরুষদের গোপন লাম্পট্যের চেহারা বোঝাই হতো না।

অথচ একাত্তরে পাক হায়েনাদের যে পৈশাচিকতা আমরা দেখেছি তা কখনওই মনে করতে চাই না। এটাও মনে করতে চাই না শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের এগিয়ে যাওয়ায় কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াক। এদেশটা পুরুষদের একার না, অর্ধেক নারীরও। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরে নারীদের দীপ্ত ভূমিকা কে অস্বীকার করে? স্বাধীনতার পর থেকেই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন নারীরা। প্রায় তিন দশক ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষ পদে নারীই রয়েছেন। তারাই এক হাতে ঘর-বাহির সামলাতে পারে। রক্ষণশীলতার আগল ভেঙে তাদেরই দীপ্ত পদচারণা নাটক-সিনেমা-সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে বহুদূর এগিয়ে দিয়েছে। অথচ কি আশ্চর্য, নারীর পাহাড়সম এই সংগ্রাম লম্পটদের চোখেই পড়ে না। তারা পড়ে আছে কোন নারী রাত দুপুরে বের হয়ে কোথায় গেল সেই হিসাবে। 

আচ্ছা বলুন তো, নারীরা আজ কোথায় নেই? মাটি থেকে আকাশ, মুদী দোকান থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান একাই সামলাচ্ছে তারা। তাদের শ্রমের ওপর ভর করেই বৈদেশিক রিজার্ভ ফুলে ফেঁপে ওঠে।  গণমাধ্যমেও আজ বহু নারী নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় থেকে পুরুষদের পরিচালিত করছে। নারীর এই এগিয়ে চলাকে আজ কারা থামিয়ে দিয়ে চায়? এর পেছনে কার বা কাদের হাত এটা গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়।

এই যে পরীমনি নিয়ে আপনাদের রাতের ঘুম হারাম হয়েছে। পরীমনিকে কবরে পাঠানো অবধি আপনাদের ঘুম আসবে না। আচ্ছা বলুন তো, মাথায় ঘোমটা দিয়ে কি সে অভিনয় করবে? শুটিং স্পটে যে শত শত চোখের সামনে পরিচালকরা তাকে স্বল্প বসনা হতে বাধ্য করেন, সেটা কি শুধু তার প্রয়োজনে? সিনেমার মুনাফা কার পকেটে যায় বেশি? কতো প্রযোজক, পরিচালকের লাম্পট্য যে নায়িকাদের মুখ বুজে সহ্য করতে হয় সেই ইতিহাস কি লেখা হয় কখনও? আবার মাফিয়াদের ডাকে সাড়া না দিলে নায়িকাদের প্রাণনাশের যে আশংকা থাকে তা কি কেউ জানে? তো এতোই যখন সাধু আপনারা, তাহলে সরকারকে সিনেমা শিল্পের গেটে তালা লাগাতে বলেন। প্রয়োজনে আন্দোলন করেন। তাহলেই তো লম্পট এলিটদের ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রবান পুরুষ হিসেবে সুরক্ষা দিতে পারবেন। 

আচ্ছা বলুন তো, বার বার নানাভাবে প্রতারিত হওয়া গ্রামের মেধাবী অসহায় স্মৃতিমনিকে শহরের অভিজাত এলাকার চোখ ধাঁধানো পরীমনি বানিয়েছিল কারা? তারা কি ধোয়া তুলসীপাতা? তাদের বিষয়ে আপনাদের মুখে কুলুপ আঁটা কেন? তাদের নিয়ে একটা শব্দও খরচ করছেন না। আপনারা জানেন না? নিষ্পাপ কোনো মেয়েকে একমাত্র চরিত্রহীন অ্যাখ্যা দিলেই সমাজ তাকে ভোগ করার অধিকার দিয়ে থাকে! যারা আজ পরীমনিকে বেশ্যা বলছেন তারা নিশ্চয়ই তাকে ভোগ করার জন্য মুখিয়ে আছেন। তার মানে কী দাঁড়াল, আপনারা ধর্ষক লম্পটকে ছাড় দিয়ে পরীমনিদের পিষে ফেলতে চান। ভোগ করার কামনাবাসনা ভেতরে পুষে রাখেন সুযোগের অপেক্ষায়! এই তো? হ্যাঁ, আপনারাই পারবেন ধর্ষকবান্ধব সমাজ গড়তে। 

তবে এটা ধ্রুব সত্য যে, চরিত্রহীন বা লম্পটরা কখনওই ট্যালেন্ট নারীদের সহ্য করতে পারে না। সাহসী আর সত্যভাষী নারীদের দেখলেই তারা হীনমন্যতায় ভোগে। সুন্দরী হলে তো কথাই নেই, লাম্পট্য লম্ফঝম্ফ শুরু করে। পরীদের ছুঁতে ব্যর্থ হলেই তাকে বেশ্যা, যৌনকর্মী অ্যাখ্যা দিয়ে বিকৃত যৌন সুখ অনুভব করেন। সিনেমা বা সংস্কৃতি অঙ্গনের নারীরা তাদের কাছে যৌনবস্তু। ঘর থেকে বেরুনো নারীদের ওপরও তারা হামলে পড়ে। কি গণপরিবহণ, কি অফিস- সুন্দরী নারী দেখলেই লালা ঝরে। এদের মগজ ময়লা-আবর্জনায় ঠাসা। ঘরের শিশু থেকে তরুণী- কেউ নিরাপদ নয় এদের কাছে। আর এরাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে সংগ্রামী, সাহসী, একরোখা নারীদের চরিত্রের সার্টিফিকেট দেয়া শুরু করে। এমন কেন?

পরীমনি যেন সঠিক বিচারটা পায়, তার সঙ্গে যেন সম্মানিত নাগরিকের মতো আচরণ করা হয়, তার কী অপরাধ সেটা যেন তাকে জানতে দেয়া হয়, তার বিরুদ্ধে যেন মিডিয়া ট্রায়াল না হয়, তার চরিত্র নিয়ে হায়েনারা যেন হামলে না পড়ে, প্রমাণ হওয়ার আগেই তাকে বেশ্যা বা রাতের রানী বলা না হয়-- এসবের দাবিতে স্ট্যাটাস দিলেই বিপদে পড়তে হচ্ছে। কোত্থেকে লম্পটরা এসে হাউ কাউ শুরু করে দিচ্ছে। তাদের মধ্যযুগীয় বয়ান শুনলে গা গুলিয়ে বমি আসে। মনে হয় না, এরা কোনো নারীর গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে। এদের বাড়িতে কোন মেয়ে আছে বলে বিশ্বাস হয় না। মওকা পেয়ে এসব হাউ কাউয়ে ঘি ঢালছে পরীর শরীর উপভোগে ব্যর্থ হয়ে ধরা পড়ায় শঙ্কায় থাকা লম্পটদের ভাড়াটেরা। যাদের নাম প্রকাশের দাবি উঠলেই চারদিকে লম্ফঝম্ফ শুরু হচ্ছে। 

এমনকি কতিপয় বিশিষ্ট সাংবাদিকও ইনিয়ে বিনিয়ে, ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে পরীমনির শাস্তি দাবি করে চলেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় পরীর বিপক্ষে জনমত গড়ছেন। তারা কি তাহলে তথাকথিত এলিট লম্পটদের কাছ থেকে বাড়ি বা গাড়ি উপহার পেয়েছেন?
 
তবে, বিবেক বন্ধক দিয়ে তারা যে যা-ই উপঢৌকনই নিক না কেন, আমরা যারা বিবেক বন্ধক দেইনি তাদেরই সতর্ক থাকতে হবে, রুখে দিতে হবে সকল অনাচার। পরীকাণ্ডে পর্দার আড়ালের লম্পটরা যেন কিছুতেই পার পেয়ে না যায়। যুদ্ধ করেই পরী ফিরুক, প্রমাণ করুক সে সাহসী।

লেখকঃ সাংবাদিক  ও কবি

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত