ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক জ্যোৎস্নায় কাক ভোর

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক:

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২১, ১৫:০৩ |  আপডেট  : ৬ মে ২০২৪, ১৩:২৫

পর্ব- ১
সকাল বেলা।
 হাঁস-মুরগী আর বিচিত্র পাখিদের কলরব চলছে। এ বাড়ির গোয়াল ঘরের গরুটি সেই ভোর থেকেই একটানা হাম্বা, হাম্বা করে চিৎকার করছে। গোয়াল ঘরটার পিছনে বিশাল ঘন বনঝোপ। ভুলেও কেউ রাতে তো দূরের কথা, দিনেও যেতে সাহস পায় না। অনেকে বলে, বনঝোপে গোখরা, দুধরাজ, শঙ্খিনী, চন্দ্রবোড়া ইত্যাদি বিষধর সাপ থাকে; শিয়াল, বাঘডাসা, বেজি, ইঁদুর ইত্যাদি প্রাণিতো আছেই। গোয়াল ঘরে গরুর দুধ পান করতে এসে দুধপেয় সাপ প্রায়ই গণপিটুনীতে মারা যায়। সাপকে গরুর দুধ পান করতে কেউ দেখছে কিনা, তা বলে না।  জমিদারী প্রথা শেষ হবার পর থেকেই এই এলাকার ঘন জঙ্গল কেটে, আগুণে পুড়িয়ে স্থানীয় বর্ধিত পরিবারগুলো, নদীভাঙ্গা  ও বিল এলাকার জলডুবা মানুষেরা বসতি গড়তে শুরু করে। এ রকম একটি বিস্তীর্ণ ঘন বনঝোপ এই বাড়ির গোয়াল ঘরের পেছনের মজা পুকুর থেকে কিছুটা দূরে তখনও অক্ষত ছিল । তবে অনেকেই যে সব প্রাণিকূলের কথা বলে, সে সব প্রাণিদের  সব প্রজাতি তখন আর ছিল না। এক সময় চিতা বাঘ, বন বিড়াল, শুকরের  আনাগোনা ছিল।  এই পরিবারের সদস্যরা কোনদিন চিতা বাঘ দেখ নাই, দেখেছে বন বিড়াল বা গেছো বিড়াল। চায়না আর কোরিয়ানরা কোথায় যেন শিল্পকারখানা খুলেছে, ব্রীজ বানাচ্ছে । তাদের কারণে গ্রামে সোনা ব্যাঙ, শিয়াল, কুকুর, সাপ কমতে শুরু করেছে, শুকর আর নাই বললেই চলে।  এ পরিবারটা যখন তাদের বসতি গড়ে তখন এই ঘন বনজঙ্গল দৈর্ঘে প্রায় এক কিলোমিটার, প্রস্থে আধা কিলোমিটার ছিল, তারপর ছিল বিল। এখন এই বনজঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে বসতিপাড়া বনটাকে বেশ কয়েকটা ঘন বনঝোপে পরিণত করেছে। দিনকে দিন চারদিক থেকে বনটাকে মানুষ গিলে খাচ্ছে।  

 গোয়াল ঘরটার পেছনে কচুরীপানায় ভরা মজা পুকুরটা থেকে কিছুটা দূরে বনঝোপের গাব গাছের একটি ডাল আর একটি শিকড়ের মাঝে একটি নারী সেই ভোর থেকেই দুই হাত ঝুলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে একটা চেয়ার কাঁত হয়ে পড়ে আছে। গাব গাছের নিচের জায়গাটি খানিকটা ফাঁকা, সেই ফাঁকা জায়গার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট গাছও আছে। ছোট গাছগুলো থেকে ডাহুক, ঘুঘু পাখিরা বিপদাপন্ন সুরে উড়াউড়ি করছে, একবার উড়ে গাব গাছের ডালে যাচ্ছে, আবার গাবগাছ থেকে ছোট গাছগুলোর  ডালে আসছে। গাবগাছের কাছে শিয়ালদের চিৎকারে পাখিরা ভয় পাচ্ছে। ভোর বেলা শিয়ালের পাক্কা হুয়া ডাকে এ বাড়ীর সকলের মনে অজানা আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল। এ বাড়ীর একটি ঘরের দরজা সেই মাঝ রাত থেকেই খোলা। হ্যাঁ, এই ঘর হতেই চিরতরে একটি মেয়ে বের হয়েছে। এই ঘরটা উত্তরে, এর সাথে গোয়াল ঘর, পাশে আরো দু‘টি ঘর, একটি দক্ষিণে, অন্যটি পশ্চিমে।

দরজা খোলা ঘর হতেই প্রথমে এক বিধবা বৃদ্ধার ভাঙ্গা গলার স্বর শোনা গেল। বৃদ্ধা রাম নাম জপতে জপতে তূলসী তলায় খানিকক্ষণ ধ্যান করে দক্ষিণ ঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগল,  ‘ওরে কালীপদ, কালী কই? ঘুম থিকা উইঠ্রা দেহি দরজা খোলা। পায়খানার দরজাও খোলা। এই সাত সকালে মাইয়াঠা কই গেল? কোনহানে তো দেকতাছি না। রাইতে মাইয়াডা  ভাতও খায়নি।  ওরে কালীপদ, দরজা খোল।’  কালী রাতের বেলা বৃদ্ধার সাথে ঠাট্টা করতে করতে ঘুমানোর ভান করেছে, আসলে ঘুমায়নি। বৃদ্ধার ডাকা ডাকিতে দরজা খুলে বের হল একজন পুরুষ, একজন স্ত্রীলোক ও একজন বালক। রাতের ঘটনা কালীর  মা-বাবাকে বৃদ্ধা সব বলল। সকলের সন্দেহ হল, শুরু হল খোঁজা। কালী--, কালী--, ধ্বনিতে প্রতিধ্বনি হচ্ছে বারবার। যখন দেখা গেল গরুর গলায় দড়ি নেই, তখন সবাই গাছে গাছে খুঁজতে লাগল।

অবশেষে, বনঝোপের গাব গাছের নীচে পাখি, বেজি, শিয়াল এর চিৎকার আর মাত্রাতিরিক্ত চলাচল লক্ষ্য করে সবাই ঝোপের দিকে এগোল। সবাই দেখল, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা, ভোরের প্রকৃতিতে অদ্ভূত ভঙ্গিতে দাঁড়িযে থাকা এক নারীকে। গাব গাছের মোটা শিকড় আর মোটা ডালের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ার লোকজন চিৎকার-চেঁচামেচি আর ধরাধরি করে তাকে দাঁড়ানো থেকে মাটিতে ভাসমান গাবগাছের শিকড়ে শুইয়ে দেয়। কালী এখন এই ঘনঝোপের গাব গাছের মাটির উপর ভাসমান মোটা শিকড়ে মাথা রেখে বীভৎস শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। হ্যাঁ, কালী। এই গল্পের কালী। চিরশায়িতা কালী এই বন ঝোপের গাব গাছের নীচে।

না, অনার্যদের দেবী কালী নয় বা সে রকম কোন রূপকথার গল্পও নয়--এ পৃথিবীর কালী--অভিশপ্ত এক মানবী--কালো যার গায়ের রং--কদাকার যার সাড়া অবয়ব--দ্রোহে যে পরাজিত হয়েও জয়ী। পরম স্রষ্টা নারী হাওয়ার বেশী দোষ বলে হয়তো নারী জাতির নরক স্থান পৃথিবীতে তৈরী করেছেন। নারীকে করেছেন বেদনার প্রতিমূর্তি, সহ্যধারী, কান্নার প্রতীক। আবার করেছেন হিংস্র বাঘিনী। তবুওতো অভিশপ্ত নারী জাতি। আর এমনি এক অভিশপ্ত নারী কালী--যার আসল নাম ঊষা। যে ঊষারা নারীত্বের সীমাহীন জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বিষাক্ত সময়ের করাল গ্রাসে ধর্ষিতা হয়ে আঁধারের মাঝে আত্মহত্যার মাধ্যমে সঁপে দেয় অভিশপ্ত জীবন। কালী এমনি এক সময়ের বাস্তব উপমা--নারী জাতির চির চেনা মানবী--একটি প্রতীক--একটি জীবন্ত লাশ।

গ্রীষ্মকাল।
 সূর্যের সাথে যুদ্ধ করে মেঘেরা হেরে গেছে। ফলে সমস্ত মেঘ  হিমালয়ে একত্র হয়ে আবার আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে গ্রাম বাংলার মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির । নদী-নালার পানি রেখা একবারে তলায় ঠেকে গেছে। অসংখ্য ফল গাছের ফুলের রেণু রৌদ্রতাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে ক্ষেতের ফসল কেমন যেন, হাহাকার করছে। বেলা বাড়ার পর থেকেই সূর্যের প্রচন্ড তাপ পৃথিবীর বুক জুড়ে দগ্ধ কেয়ামতের সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। নিরব নিথর দুপুরবেলা রাখালেরা গাছের ছায়ার গরুগুলিকে বেঁধে গামছাটা শীতল ঘাসের উপর বিছায়ে শুয়ে পড়ে। কৃষক গাছের ছায়ায় বসে লুঙ্গি দিয়ে দেহের ঘাম মুছে, মাথার বিড়া দিয়ে বাতাস করছে। তাদের হাত-পা মুখ লাল হয়ে আছে রৌদ্রতাপে। এদের দেখে মনে হয় যেন, এরা আগুন থেকে উঠে এসেছে। গাছে গাছে পাখিরা থেমে থেমে ডাকছে। আর অদূরে গরু-ছাগল-ভেড়া-সবাই একটানা ডেকে চলেছে। এর মাঝে দু’একটা ছেলে-মেয়েকে গোবর কুড়াতে দেখা যাচ্ছে। কিছুদূরে দক্ষিণে বড় রাস্তা দিয়ে একটা ছোট ট্রাক যেতেই  ধূলা-বালি উড়ে অন্ধকার হয়ে গেল। পথের পাশে বড় বড় গাছের ছায়ায় লুঙ্গি গামছা বিছায়ে পথিক বিশ্রাম করছে। ধূলা-বালি নাকে-চোখে লাগতেই ট্রাক ড্রাইভার এর চৌদ্দ গোষ্ঠীর নাম ধরে পথিকরা গালি দিতে লাগল। একজন বৃদ্ধ ও একটি বাচ্চা ধূলো ঝড়ে পড়ে কাশতে লাগল। চারদিক হঠাৎ নিরব হয়ে গেলে দূর হতে দুই-একটি ঘুঘুর ঘু-ঘু ডাক শোনা যায়। মনে হয়, এরা যেন বৃষ্টির জন্য স্রষ্টার কছে মিনতি করছে। চৌচির মাঠ-ঘাট আর ফসল ক্রমাগত মোনাজাত করে চলেছে স্রষ্টার কাছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, কখনও বড়দের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হচ্ছে--আল্লা মেঘ দে-পানি দে--ছায়া দেরে তুই--আল্লা মেঘ দে...।

ঠিক এমনি মুহুর্তে চৌরাপাড়ার  দশ-বারো জন কিশোরী-যুবতী এবং তিন-চার জন মধ্যবয়সী মহিলা ‘কুলা ঠাণ্ডা করতে’ কালীদের বাড়ি ঢুকল। কালী উত্তর ঘর থেকে জগ নিয়ে ঘাটে গেল। ঘাট থেকে জল ভরে এনে উঠানে প্রায় সবটুকু ঢেলে দিল আর জগটা ঢেলে দেওয়া পানির কাছে রাখল। মহিলারা তাদের কোলার অগ্রভাগের দুই প্রান্ত মাটির উপর ভাসমান পানিতে ঠেকাল। তারপর গান শুরু করল। ‘আল্লা মেঘ দে-পানি দে-ছায়া দেরে তুই--আল্লা মেঘ দে...।’ একটি গান শেষ হলে আরেকটি গান শুরু হয়। ‘পূর্ব-পশ্চিম ছাইরা কন্যা আকাশ পানে চায়, পানির জন্য কন্যা খালি বুক চাপরায়...।’ গান শেষে একজন মহিলা আমগাছের কচি ডাল এক কিশোরীর হাতে রাখা জগে ডুবিয়ে ডালটি উঠাল। তারপর ডাল আর ডালের কচি পাতায় লেগে থাকা পানি উত্তর-দক্ষিণ, পশ্চিম--এই তিন ঘরের দরজায় ছিটিয়ে দিল। কালীর মা শেফালী সিঁদুরের কৌটা থেকে আঙ্গুলে সিঁদুর নিয়ে কুলাগুলির অগ্রপ্রান্তে মেখে দিল। তারপর কালীর ঠাকুরমা তুলসী দুই টাকার নোট, চাউল, পিয়াজ, মরিচ কুলাগুলির একটির উপর রাখল। কুলা নিয়ে সবাই অন্য বাড়িতে চলে গেল। কালী, মিলন ওরা দু’জন ওদের পিছু পিছু গেল। বিকাল ৩টা পর্যন্ত ওরা দলটার সাথে বাড়ি বাড়ি ঘুরেছে আর সুযোগ পেলেই কালী ওদের সাথে গান ধরেছে। এর মধ্যে দলের এক কিশোরীর সাথে কালীর ভাব হয়ে গেছে। কালী জেনে নিয়েছে, ওর নাম লতিফা। লতিফা মিলন আর কালীকে দাওয়াত দিয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাবেলা যেন, সে ওদের বাড়ি যায়। কালী লতিফাকে বলেছে, মা, ঠাম্মা, বাবা বকবে।

সূর্য্য পশ্চিম দিকে হেলতে আরম্ভ করলে পরাজিত মেঘেরা সদলবলে দক্ষিণ দিক থেকে প্রচন্ড বেগে ছুটতে আরম্ভ করে। মুহুর্তের মধ্যে শুরু হয় ধূলোঝড়। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বজ্রপাতের ঝিলিক মারা আলোতে দিগন্ত হঠাৎ আলোকিত হয়ে ছবি তোলার মত ফ্লাশ হয়ে চোখের স্মৃতিপটে জমা পড়ে। পথের ধূলিকনা ও নদীর তীরের বালুকারাশি বিক্ষিপ্ত হয়ে চারদিক ঢেকে ফেলে। কালী আর মিলন বাড়ির দিকে ছুটতে আরম্ভ করে। কালীর ঠাকুরমা তুলসী দক্ষিণের সুপারী গাছের কাছে এসে অস্থির চিত্তে কালীকে ডাকছে। মিলন আর কালী দৌঁড়ে বাড়ীর দিকে আসছে। প্রবল বাতাসে তাদের কথা অস্পষ্ট শোনায়। পথে যেতে যেত কে একজন বলে গেল, ‘এই পোলাপাইন, বাড়িত যা, রাস্তায় ঠাডা পইরা একজন মরছে।’ কে বজ্রপাতে মারা গেছে, লোকটা তাকে চিনে না, আর ঝাপসা চোখে তারাও মৃত্যু সংবাদ দেওয়া লোকটাকেও চিনতে পারেনি। দু‘জনে ভয়ে কাঁদতে লাগল--
- ঐ কালী, ঐ দেক, তোর ঠাকমা তোরে ডাকছে। তুই তাত্তাড়ি যা, আমি বাড়িত যাই।
- ঐ মিলন, ঠাম্মার হাতে লাটি নারে?
- না, সুপারী গাছ ধইরা খাড়ই আছে।
বাতাসের প্রচণ্ড প্রবাহে ধূলিকণা তাদের চোখ-মুখে আঘাত করছে। ফলে তারা চোখ মিটমিট করে হাঁটতে থাকে। ধূলো ঝড়ে একটু দূরের জিনিসও ঝাপসা লাগে। কালী দৌড়ে তুলসীর সামনে এসে নাকিয়ে নাকিয়ে কাঁদতে লাগল। তুলসী ওর হাত ধরে চড় দিতে দিতে উত্তর ঘরে নিয়ে গেল।
প্রবল বাতাসে গাছের ডাল-পাতা ঝরে পড়ছে। গোয়াল ঘরের গরু ডাকছে। মোরগ-মুরগীগুলি দক্ষিণ ঘরের পাটাতনের নীচে ভয়ে জড়ো-সরো হয়ে আছে। কালীর মা শেফালী খোয়াড়ের দরজা খুলে দিতেই সব হাঁস-মুরগী খোয়াড়ে ঢুকে গেল। তুলসী কালীকে বকছে,
- কাইল্লা মাইয়া, হেই দুপুর বেলা  গেছস, অহন আইছস। গাছ-গোছ ভাইঙ্গা পড়তাছে। ঐ তোর মাথার মধ্যে যুদি একটা ডাইল পরত। কোথায় গেছিলি, ক?
কালী তুলসীর পা ধরে বসল। ছোট ভাই জয়ও কাঁদতে শুরু করল ভয়ে ।
- ঐ, তুই কাঁন্দস কে ?
তুলসী জয়কে সান্ত্বনা দিয়ে শেফালীকে ডাকছে
- বৌ, বৌ দক্ষিণ ঘরের জানলা লাগাই দেও। এঁচলা আইতাছে।
- মা, পশ্চিম ঘরের বাইরের ছিকল লাগাইছেন ?
- হ
ঝড়ের তাণ্ডব লীলায় গাছ-পালার শাখা- প্রশাখা ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিছু কিছু উঁচু ভিটার গাছ গোড়া সহ উঠে যাচ্ছে। বাঁশবন ধরাশায়ী, পাখিদের বাসা ভেঙ্গে মাটিতে পরে আছে। হালকা জিনিস-পত্র ঝড়ের বাতাসে উড়ছে।  পাখিরা নিজেদের গতি ঠিক না রাখতে পেরে নিচে পরছে। কালীদের উঠান লতা-পাতা আর বিভিন্ন ময়লায় ভরে গেছে। তুলসী উত্তর ঘর থেকে আর শেফালী দক্ষিণ ঘর থেকে ভগবানকে ডাকছে, হরিবল, হরিবল, ভেন্নার খুঁটি, ভেন্নার ছই, পবন ঠাকুর বয়ে যাও, বয়ে যাও...হরিবল, হরিবল...। ডান হাতে একটি কুলায় চুন মাখা পান-সুপারী-বাতাসা-কলা  আর বাম হাতে একটি পিঁড়ি নিয়ে শেফালী উঠানের মাঝখানে রেখে আসে। দেখে মনে হয়, এই ঝড়ের মধ্যে পবন দেবতা পিঁড়িতে বসে এসব অর্ঘ খাবে আর ঝড় থেমে যাবে। উঠানে রেখে আসার কিছুক্ষণ পরই কুলাসহ সব উড়ে যায়, পিঁড়িটা পশ্চিম ঘরের মাটির দেয়ালে দেখা গেলেও, কুলাটা আর দেখা গেল না। ভয়ে তারা আরো চিৎকার করে পবন ঠাকুরকে ডাকতে লাগল।

হিন্দুদের ঘরে ঘরে শঙ্খের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কালী ঘরের পূর্ব দিকের জানালা খুলে বাইরের অবস্থা দেখতে লাগল। দূর থেকে আজানও ভেসে আসছে। কালী, জানালা খোলা রেখে  মিলনদের বাসার দিকে আগে তাকাল। ঝাপসা লাগে, কিছুই বোঝা যায় না। দীপাদের বাসার দিকে তাকাতেই প্রবল বাতাস এসে জানালায় আঘাত করল। ফটকের আঘাতে কালীর কপাল ফুলে গেল। শেফালী কালীর হাত জোরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে।
 - আহ! তুই জানলা খুলছস কেন? পবন ঠাকুরে ডাক। পবন ঠাকুর-,বয়ে যাও-,বয়ে যাও...
-পবন ঠাকুর বইয়া যাও, শিব ঠাকুর বইয়া যাও, আংগো ঘর ভাইঙ্গা যাইব, ঝড় ঠাকুর থাইমা যাও..
কিছুটা ভিন্ন রকমভাবে প্রার্থণা করাতে ঠাকুরমা কালীর দিকে বাঁকা চোখে তাকাতেই কালী থেমে যায়। ঝড়ের ভয়ে জয় তুলসীর কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে আছে। কালী ব্যথায় কাঁদছে। তুলসি আর শেফালী পবন ঠাকুরকে ক্রমাগত ডেকে চলেছে।
বিকালে যখন সূর্য্য পশ্চিম দিকে হেলতে শুরু করেছে, পূর্বাকাশে রংধনু ভেসে উঠেছে। থেমে থেমে মেঘের গুড়ম গুড়ুম শুনা যাচ্ছে। মেঘের  শব্দে পুকুর হতে অনেক কইমাছ ডাঙ্গায় অল্প জলে সাঁতার কাটছে। কালীদের বাসার দক্ষিণের বিস্তৃত অগভীয় ডোবায়, অনেকটা ছোট ক্ষেতের মত জায়গায় অনেক পানি জমেছে। এই ডোবায় নেমে কিছু ছেলেমেয়ে মাছ ধরছে। কেউ কাগজের নৌকা, জাহাজ বানিয়ে ঐ জলে ভাসিয়ে হাত তালি দিয়ে আনন্দ করছে। জয় ডোবার পাশে বসে আছে। গত দু’দিন ধরে তার জ্বর। এখন একটু কমেছে। মাছ দেখে সে চিৎকার করে উঠল, দিদি, ঐ দেখ কবিরাজ। গেল গেল দিদি, ধর, ধর…।
এই এলাকায় কই মাছ বেশ জনপ্রিয়। তাই কই মাছকে ভালোবাসার খাতিরে কবিরাজ বলা হয়। স্থানীয় কবিরাজের কাছে কোন অসুখ নিয়ে গেলে তিনি অসুখ সাড়ার পর কই, সিং মাছ দিয়ে ভাত খেতে বলেন। তাই হয়তো কই, সিং মাছকে পথ্যক হিসাবে কবিরাজ বলে ডাকা হয়।
শেফালী উঠান ঝাড় দিচ্ছে। তুলসী ঘরের ভিতরটা পরিষ্কার করছে। কিছুক্ষণ আগে কালীপদ দোকান থেকে এসেছে বাড়ির অবস্থা দেখার জন্য। অদূরে হাবিবুর তাকে ডাকছে-
- ঐ কালীপদ, সব ঠিকতো?
- না দাদা,  ঝড়ে গরুঘরের চাল উড়াইয়া লইয়া গেছে পুকুর পাড়ে। পায়খানাটাও ভাইঙ্গা গেছে।
বৃদ্ধ নিতাই শীল কালীপদ আর হাবিবকে ডাকছে। পশ্চিমের ঘাট থেকে শেফালী জল আনার জন্য ঘরের বাইরে আসতেই হাবিব আর নীতাই শীলকে দেখতে পায়। তার মাথার ঘোমটা আধ হাত নীচে নেমে আসে। হাবিব শেফালীকে দেখে এমন ভান করল যেন, সে দেখে নাই। মনে মনে বলে উঠল, এত সুন্দর বউ অথচ মেয়েটা কত কালো। নিজের জড়তা দূর করার জন্য সে নিতাই শীলকে বলল,
- কি খবর জ্যেটা?
- ভাল না, তোরা এই দিকে আয়। আরে, আম গাছের বড় ডাল ভাইঙ্গা গরু ঘরটার উপরে পড়ছে। গরু ঘরও ভাঙ্গছে, গরুটার ঠ্যাংও মনে হয়, ভাঙ্গছে।
কালীপদ আর হবি ছোটবেলা থেকে নিতাই শীলকে পছন্দ করে না। নিতাই শীলের উঠানে  খেলতে গেলে বকা দিত। গাছ থেকে কিছু চুরি করেও খাওয়া যেত না। কত নালিশ যে নীতাই শীল অভিভাবকদের কাছে করেছে! তার মুখের ভাষাও খারাপ। অতিরিক্ত রেগে গেলে অভিশাপ দেওয়া শুরু করে। কালীপদ ফিসফিস করে বলছে,
- যাক, তোমার ঠ্যাংতো ভাঙ্গে নাই?
- কিছু কইলি কালীপদ?
- না গো জ্যেটা, কইলাম ডাইলগুলি সরানো দরকার। গরুর পা ঝাড়ন দরকার। কি কন, হবি ভাই?
-হ্যাঁ, ঠিক কইছস। জ্যেটার বাড়িত তো  আর কোন পুরুষ লোক নাই।
                                                                                                                       (চলবে)
 

 

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত