একটি রূপকথার গল্প

জলপরী শাপলাবতী

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ৮ অক্টোবর ২০২১, ১০:১০ |  আপডেট  : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০২

ঝর্না রহমান
----------------
 
অনেক অনেক আগে ছিল একটা গ্রাম। একটা না, একসাথে জড়াজড়ি করা কয়েকটা গ্রাম। গ্রাম জুড়ে ছিল বিল। বিল ভরতি কেবল পানি আর পানি। সেই পানি কখনো শেষ হত না। বিল জুড়ে ছিলো শাপলার মাতামাতি। কত রঙের শাপলা! লাল শাপলা, সাদা শাপলা! নীল শাপলা। পলকাটা বড় পাতা! ছোট ছোট গোল পাতাওয়ালা। ডাঁটির মাথায় ফুটতো এইটুকুনি তারার মত শালুক ফুল। তার আর এক নাম ছিল চাঁদমালা ফুল। এত এত শাপলার কারণে সেই বিলকে লোকে বলতো শাপলার বিল। শাপলার বিলের জলতলে ছিল পদ্মরাণীর প্রাসাদ। অনেককাল আগে, শাপলারও আগে, সেই বিলে ফুটতো পদ্ম! পদ্মরাণীর পদ্ম! একবার টানা ছয়মাস মেঘে ঢাকা থাকলো আকাশ, চাঁদের মহল থেকে জোছনার পরীরা আর নামতে পারলো না পদ্মবিলে, ফলে সব পদ্ম ঝুপুত করে ঘাড় নামিয়ে পানিতে ডুবে গেল। সেই থেকে পদ্মরাণী থাকেন জলতলে প্রাসাদে আর পদ্মডাঁটার মূলে ঘুমিয়ে থাকা শাপলারা উঠে এলো জলের ওপরে। 
 
বহুকাল পরে, একদিন রাত্তিরে দূরের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার একটি ধারা বিলের জলের সাথে গল্প করতে এলো। বিলের ওপরে তখন চাঁদের আলোয় নেচে বেড়াচ্ছিল ঢেউয়েরা। ঊর্মি নামের একটা রুপুলি ঢেউকে ঝরনার বড় পছন্দ হলো। কারণ, তার যে একটা নদীপুত্র আছে! পুত্রের নাম বিয়াস! ওর সাথে দারুণ মানাবে ঊর্মিকে। পদ্মরাণী আর শাপলাবিলও অমত করলো না। বিয়ে হয়ে গেল! বিয়ের পরে জলপুত্র জলকন্যারা আর জল থাকে না, মানুষে রূপান্তরিত হয়! যথাসময়ে ওদের ঘরে এলো এক মেয়ে! জলের মত কোমল তার দেহ, জলধোয়া স্নিগ্ধ চেহারা। জলে নামলে মেয়েকে আর ওঠানোই যায় না। তা তো হবেই! ও যে শাপলা বিলের ঊর্মি আর বিয়াস নদের কন্যা, আর পাহাড় ছোঁয়া ঝরনাধারার নাতনি! কাজেই কন্যার নাম রাখা হল নীরাজনা! নীর মানে জল, জলেভেজা মেয়ে! 
নীরাজনা বড় হতে থাকে। ও ভালোবাসে জল, জলের মাছ আর জলপরী! কাচের পাত্রে রাখা পোষা মাছকে যত্ন করে আধার খাওয়ায়। রঙতুলি নিয়ে বসলেই আঁকে বর্ষার জল থই থই নদী আর মৎস্যকন্যার ছবি! নীরাজনার কেন যেন মনে হয়, সেও আসলে একজন মৎস্যকন্যা, একজন জলপরী। কীভাবে যেন মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েছে! 
 
একদিন দুদিন করে বছর গড়িয়ে যেতে থাকে। ওদিকে পদ্মরাণী আর শাপলাবিল দুজনেই নীরাজনাকে না দেখে দুঃখে শুকিয়ে যেতে থাকে। কারণ তারা জানে, নীরাজনা হলো শাপলাবিলের জলপরী শাপলাবতী। শাপলাবতী যেদিন বিলের জলে হাত ছোঁয়াবে, জল থেকে শাপলা তুলে মালা গেঁথে সাজ করে জলের আয়নায় মুখ দেখবে, সেদিন আবার শাপলাবিল জল থইথই ভঙ্গিমায় নেচে উঠবে। সারা বিল ভরে যাবে শাপলাফুলের হাসিতে। একদিন নীরাজনার দাদির কাছে পদ্মপাতায় চিঠি লিখে পাঠায় পদ্মরাণী। নাতনীকে একটিবার দেখিয়ে নিয়ে যাও না গো! নয় বছর পেরিয়ে গেল, একটিবার দেখলাম না! আমরা তো শুকিয়ে মারা পড়লাম! 
 
চিঠি পড়ে ঝরনা-দাদি ভাবেন, তাইতো! নয়ে না হলে তো নব্বইয়েও হবে না! এ তো গুরুজনেরই কথা! জলদি সব ব্যবস্থা করলেন। বিলের জল তখন অনেক কমে গেছে। তাই ঘাটে আর ময়ূরপঙ্খি নাও পাওয়া গেল না। তবে যন্ত্রের নৌকা আছে! কানে তালা লাগানো ভটভটি! দাদি বলেন, তাই সই, চল! জলকুমুদের কুঞ্জে এসে যন্তর বন্ধ করলেই হবে। তখন পদ্মরাণী তার দুটি চোখের কলি জলের ওপরে মেলে দেবেন জলপরী নাতনীকে দেখার জন্য!
নৌকোয় বসে দাদি তক্কে তক্কে থাকেন। জলকুমুদের ঝোপের কাছে আসতেই বললেন, এখন যন্তরমন্তর বন্ধ করো! এখানে নৌকা থামাও!
তিনি একটা শাপলা টেনে তোলেন। তারপর সেটা দিয়ে দ্রুত হাতে মালা বানাতে থাকেন। নীরাজনা তখন একমনে বিলের জলে ফড়িং গুগলি আর ব্যাঙাচির খেলা দেখছিল। হঠাৎ একটা পুচকে সাপও জলের ঢেউয়ের মত কোমর বাঁকিয়ে নাচতে শুরু করে। নীরাজনা চেঁচিয়ে ওঠে, দাদি, দেখো, সাপ! ও ঘাড় ফেরাতেই দেখে দাদির হাতে শাপলা। মুটুস মুটুস করে শাপলার ডগা ভেঙে ভেঙে মালা গাঁথছেন! দাদির ততক্ষণে মালা বানানো শেষ। নীরাজনাকে কাছে ডেকে যত্ন করে পরিয়ে দেন মাথায়! কী সুন্দর দেখাচ্ছে! ঠিক যেন এক রাজকন্যা!
 
নীরাজনা খুব খুশি! বলে, আমিও মালা বানাতে চাই! দাদির কাছ থেকে দ্রুত শিখে নেয় মালা বানানোর কায়দাকানুন। তারপর মনোযোগ দিয়ে নিজেই মালা বানাতে থাকে। একটুক্ষণের মধ্যেই দিব্যি বানিয়ে ফেলে মাথার টায়রা, কানের দুল গলার মালা আর কোমরের মেখলা! আরও লাগবে হাতের কাঁকন আর বাজুবন্দ! এসব বানাতে শাপলার ডাঁটা লাগবে আরও! যত্ন করে গহনা বানাতে থাকে ও। এক এক করে সব গহনা বানিয়ে নীরাজনা সাজ করে! আনন্দে বাতাসে উড়তে থাকে চুল। নেচে ওঠে ওর সারা দেহ! নীরাজনা নাচের মুদ্রা তুলে নৌকোর একপাশে দাঁড়ায়। সজ্জিত নীরাজনাকে দেখে হাততালি দিয়ে ওঠে বিলের জল। হেসে ওঠে গোধূলির রঙমাখা ঢেউ। নীরাজনা তখন বাবার পাশে বসে জল দেখছিল। বাবাও মুগ্ধ চোখে দেখে মেয়েকে! সেই মুহূর্তে কুমুদঝোপের পাশ থেকে কে যেন মুগ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, জলপরী শাপলাবতী!
নীরাজনা অবাক হয়ে বলে, কে কথা বলে বাবা?
বাবা সেদিকে একঝলক চেয়ে বলে, ফুলের কলিরা কথা বলছে মা!
তাই? আমাকে বলছে?
হ্যাঁ, তুমি তো জলপরী নীরাজনা! আর আজ শাপলা ফুলে সেজেছো, তাই শাপলাবতী!
দাদি শুধু মুচকি হাসেন। কারণ তিনি জানেন নীরাজনা আসলে কে! আর কে-ই বা তাকে ডাকছে!
শাপলাবতী তখন নৌকোর বাতায় বসে গভীর মনোযোগে চেয়ে আছে জলের দিকে। আর দূরে পদ্মরাণীর চোখের দুটো কলি জলের ওপরে আস্তে করে পাপড়ি মেলে দেয়, চেয়ে চেয়ে দেখে শাপলাবতীকে! কী সুন্দর!

ঝর্না রহমান

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত