(এক আ-তেল-এর 'নূর' দর্শন)
ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু...
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২১, ২০:৩৩ | আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৮
ঝর্না রহমান
-------------------
কয়দিন যাবৎ রেহানা মারিয়াম নূর-এর নূর বা জ্যোতিতে ফেসবুক উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছিল! এক-একজন নূর দর্শন করেন এবং তাদের এক-একরকম অনুভূতি আর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আমি এসবের অনেকগুলোই পড়েছি! মূলত কান থেকে ফিরে আসার পর এই সিনেমাখানি নিয়ে এত আলোচনা শুনেছি যে শুধু সে-সব বাণী দু কান উপচেই পড়েনি, ছবিটি দেখার জন্য একেবারে ফিদা মকবুল হোসেন হয়ে গিয়েছিলাম! আর ছবি দেখার আগে 'আন্তর্জাতিক মান' বোঝার জন্য নিজের ভেতর যেটুকু ইনটেলেকচুয়ালিটির খুদকুঁড়ো আছে তা কুড়িয়ে কাঁচিয়ে জড়ো করে নিয়েছিলাম, যেন ছবিতে একটি পাতা পড়ার শব্দের তাৎপর্যও অমনোযোগিতার আড়ালে হারিয়ে যেতে না পারে। শুনেছিলাম, এ ছবিতে খালি নীল রঙের ভেতর এক প্রতিবাদের নীলাগ্নিগিরি জ্বালিয়ে তোলা হয়েছে। শুনেছি নায়িকা বাঁধন এক দুর্দান্ত বিদ্রোহী নারীসত্তার ধ্বজা উড়িয়েছে, শুনেছিলাম এখানে নির্মাতা আনপ্যারালাল এক শিল্পের ভুবন সৃষ্টি করেছেন যা দেখে ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও বিস্ময়াভিভূত দর্শক প্রথমে হাততালি দিতে ভুলে যায়, তারপরে হল ফেটে পড়ে! তো এই স-ব কিছুর জন্য পঞ্চেন্দ্রিয়, অষ্ট অঙ্গ, মন-মনন চেতন-অবচেতন সব জাগ্রত করে গতকাল ছবিটি দেখতে গেলাম বসুন্ধরার যমুনা ফিউচার পার্কে ব্লকবাস্টার হলে। সঙ্গী আমার সহকর্মী বন্ধু সাইদুন্নাহার। আমরা দুজন বাংলা আর ইংরেজি সাহিত্যের মানুষ। সারাজীবন ছাত্র পড়িয়ে দুবছর হল রিটায়ার করিয়েছি। আমাদের পরিণত মস্তিষ্কের আকাঙ্ক্ষা আর মেধাবী বিকেল এ ছবি কেমন করে পূর্ণ করে তুলবে, তাই ভেবে আনন্দিত!
শো টাইম ছিল বিকেল ৪.৪০। শনিবার ছুটির দিন, এত বিখ্যাত ছবি, নিশ্চয়ই ভিড় হবে, তাই একটু আগেই, চারটার সময় আমরা টিকেট কাউন্টারে হাজির হলাম। কিন্তু কাউন্টার ঢুঁ ঢুঁ! কোনো লাইন নেই! সর্বনাশ, আজ শো বন্ধ নাকি! নাহ, ভেতরে একজন টিকিট মাস্টার আছেন! তিনি রেহানার টিকিটই বিক্রি করেন বটে! দুখানা সেরা কাতারের টিকিট নিলাম, যাতে পর্দায় চোখ রাখতে এতটুকু অসুবিধা না হয়! দশ মিনিট আগে 'নূর' মহলের দরজা খোলা হল। ঢুকে একটু ঘাবড়ে গেলাম! আমরা দুই আঁতেলই এসেছি! আর কেউ নেই! তারপর অবশ্য একজন দুজন করে কয়েকজন এলেন। জাতীয় সংগীতের সময় দণ্ডায়মান দর্শককূলের মাথা গুনলাম। পঁচিশ! যাক, করতালির শব্দ শোনা যাবে এবার। তারপর শুরু হল সিনেমা।
একটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক রেহানা মারিয়াম নূরের অপর এক শিক্ষক কর্তৃক এক ছাত্রী ডাক্তারের শারীরিক লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লড়াইয়ের কাহিনি। মধ্যে আরও দুটি টুকরা জুড়ে গিয়েছে এখানে, পরীক্ষা হলে স্কেলে পয়েন্টস লিখে আনার অপরাধে এক ছাত্রীকে এক্সপেল করা আর নিজের শিশুকন্যাকে স্কুলে ছেলে সহপাঠির চিমটি কাটা নিয়ে (সংকটটি অস্পষ্ট সংলাপের কারণে ভালো বোঝা যায়নি) প্রতিবাদ হিসেবে মেয়েকে জোর করে স্কুলে কালচারাল অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে যেতে না দেয়া।
তনমনচোখকান প্রখর করে সিনেমা দেখছি। কিন্তু চোখের ওপর ঘসা কাচের মত ঘোলা পর্দা। সব দৃশ্য অস্পষ্ট। অন্ধকার। ভাবলাম, এখন ভবনের করিডোর দেখানো হচ্ছে, একটু পরেই আলো আসবে। একটু পরেই চেহারা ভালোভাবে দেখা যাবে। একটু পরেই ডায়লগগুলো স্পষ্ট শোনা যাবে! কিন্তু সিনেমা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও বিশ্বাস হচ্ছিল না একটা গোটা চলচ্চিত্র কোনো একটি ভবনের ভেতরে আধো আলো আধো অন্ধকারে শুধু একটা লোক চলাচল-করিডোরে, শুধু কোনো রুমের অস্পষ্ট এক কোণে বা শিক্ষক চেম্বার বা ক্যান্টিন বা ওয়েটিং রুমের [কষ্টকল্পিত] কোনো একপাশে শুট করে শেষ হয়ে যেতে পারে! লেখক তসলিমা নাসরিন বলেছিলেন এ ছবিতে কোনো বাইরের দৃশ্য নেই। নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা নেই। ঠিক বলেছেন! সত্যি দম বন্ধ হয়ে আসে। সারাটা ছবি আমার মত আ-তেল [আঁতেল নই], মূর্খ, নাদান দর্শককে রীতিমত অসুস্থ করে তোলে। সারাক্ষণ এই নীল ধোঁয়া মাখা অন্ধকার পর্দায় ছায়া ছায়া মানুষ, ঘোলা ঘোলা চেয়ার টেবিল মশারী আমার চোখের ওপর খুব চাপ সৃষ্টি করেছে। আধঘণ্টায়ই মাথা ব্যথা হয়ে গেছে। শ্রবণকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমি এ ছবির অর্ধেক ডায়লগই প্রথমত অদ্ভুত হাংলাবাংলা আর বাংলিশ উচ্চারণের কারণে বুঝিনি। বাকিটা বুঝিনি কখনো বেশি আলতো থ্রোয়িং, কখনো আশেপাশের অসহ্য কোলাহলের কারণে। সিনেমাটি আমার কাছে প্রথমেই অর্ধেক নম্বর হারিয়ে ফেললো অপ্রয়োজনে তথাকথিত মৌখিক নাগরিক ভাষা করতেসি, খাইতেসি, আসবা, দিবা, খাইসো, নিসো এই টাইপের ভাষার কারণে। এই ভাষা, এই কোলাহল, এই আলতো জড়ানো প্রক্ষেপণ ইত্যাদি কারণে মনে হচ্ছিল, এখানে যদি বাংলা বা ইংরেজি সাবটাইটেল থাকতো [কানের দর্শক বড় ভাগ্যবান, তারা নিশ্চয়ই ইংরেজি সাবটাইটেল পেয়েছিলো!] তা হলে সুবিধা হত! তবে, হয়তো আমার মত নির্বোধ দর্শকদের জন্যই এখানে 'প্রিন্সিপাল ম্যাডাম' বলে একজন নারী চরিত্র আছেন, যিনি স্বাভাবিক উচ্চারণে প্রমিত বাংলায় কথা বলেন আর স্বাভাবিক অভিনয় করেন! কিন্তু যেখানে ছাত্রছাত্রী শিক্ষকশিক্ষিকা সবাই 'বাংলা'য় কথা বলেন, সেখানে প্রমিত বাংলায় কথাবলা এই নারীকে মনে হয়েছে ভিন্নগ্রহের মানুষ।
সে যা-ই হোক, এ সিনেমা দেখে যে জ্ঞান আমি লাভ করলাম তা হলো, রেহানা মারিয়াম নূর মানসিকভাবে অসুস্থ একজন নারী [ইমুর ভিডিও প্র্যাকটিসে অবশ্য এই স্বীকারোক্তি আছে, আমার মায়ের মাথাটা খারাপ আছে!]। সে প্রতিবাদী, কিন্তু অস্বাভাবিক। সারা ছবিতে তার রাগান্বিত খামোশ মূর্তি [একমাত্র হাসি কন্যার সাথে জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি খেলার সময়, তাও শুধু হাসির শব্দ, চেহারা স্পষ্ট নয়]! এ ছবির কাহিনিকে চিত্রনির্মাণ বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছে প্রামাণ্য চিত্র। মর্ষকামী পুরুষের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদ দেখানো মূল উদ্দেশ্য বলে শুধু সেটুকুর পেছনেই ক্যামেরা ঘুরেছে। আর ক্যামেরা! উহ, ক্যামেরা কেন এত দোলে?? আগেরদিন, শুক্রবারেই, ভোর ছটার দিকে ঢাকায় তুমুল এক ভূমিকম্প হয়েছে। তখনও বিছানায় ছিলাম। ঢেউয়ের মত দুলছিল খাট। সারাদিন শরীরের ভেতর সেই দুলুনি ছিল। রেহানায় দুঘণ্টাব্যাপী ক্যামেরার দোলনা দোলানো দৃশ্য দেখে আমার শরীরে আবার সেই দুলুনি ঢুকে গেছে! আমি হয়তো নিতান্ত মূর্খ, জানি না, ক্যামেরাকে দুলিয়ে দৃশ্য ধারণ করার মাজেজা! এটি নিশ্চয়ই একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড! সারা সিনেমায় দুটি প্রতীকী দৃশ্যই আমার ভালো লেগেছে, এক, অ্যানির জামার বুকের ছিঁড়ে যাওয়া অংশে রেহানার সেফটিপিন লাগিয়ে দেওয়া, দুই, অপরাধী শিক্ষকের কক্ষের বন্ধ দরজায় রেহানার নক ক্রমে উচ্চগ্রামের কিল মারায় পৌঁছানো (যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে একজন শিক্ষক আর একজন শিক্ষকের দরজা এমব করে ঘুষাতে পারেন কি না আমার জানা নেই, তবুও প্রতীক বলে মেনে মেওয়া আর কী)। আর বাকি সব বোরিং, ক্লান্তিকর। একের পর এক বিষয় আমাকে ক্লান্ত করে চলে।
১. সারাক্ষণ মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে ঘাড় নুয়ে চলা রেহানা আমাকে ক্লান্ত করে। সে একবারও মাথা সোজা করে হাঁটে না।
২. সারা ছবিতে রেহানার সাইড প্রোফাইল অথবা একটু পেছন থেকে ওড়নাঢাকা পুরো মাথাসহ ঘাড়নামানো মুখের একফালি খাড়া নাক আর খামোশ ঠোঁট আমাকে ক্লান্ত করে। একবারই, লিফট থেকে বের হওয়ার পর তার সোজা মুখ দেখা যায়।
৩. রেহানার অসংখ্য ফিসফিসে দাঁত খিঁচানো ফোনালাপ আমাকে ক্লান্ত করে। আর সেসব আলাপ অধিকাংশই অস্পষ্ট।
৪. অপ্রয়োজনে দীর্ঘ আরোপিত দৃশ্য আমাকে ক্লান্ত করে। যেমন হাসপাতালে রেহানার আত্মীয়ার নারীবাদী আলাপ, রেহানার প্রায় পঁচিশবার মুখে পানির ঝাপটা দেয়া, কিংবা নেপথ্যে হামদনাত, আজান ইত্যাদি।
৫. নিজের জেদকে প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা কিন্তু শিশুকন্যার সরল জেদকে কঠিন হাতে দমন করার দৃশ্য আমাকে ক্লান্ত করে। কান ধরিয়ে উঠবস, কঠিন ধমক, রুমে আটকে রাখা ইত্যাদি।
৬. একমাত্র পরীক্ষা হলে ডিউটি দেওয়া ছাড়া রেহানার আর কোনো পেশাগত দায়িত্ব নেই। নিজের পরিবারের কে খেলো, কী বাজার হবে, ভাইকে কত টাকা দেবে, মেয়েকে কে আনবে সারাক্ষণ এসব দায়িত্বের পরাকাষ্ঠা আমাকে ক্লান্ত করে।
৭. অসংখ্য খাপছাড়া দৃশ্যান্তর সংলাপ আমাকে ক্লান্ত করে।
৮. পারস্পরিক কথোপকথন দৃশ্যে শুধু একজনের ওপর ক্যামেরা স্থির থাকা আমাকে ক্লান্ত করে।
ছবি শেষ হয়েছে একটি চরম অমানবিক দৃশ্য দিয়ে। অবোধ শিশুর প্রতি এই প্রতিহিংসামূলক মনোবৃত্তির ভেতর দিয়ে রেহানা আপা আমাকে কি বোঝাতে চাইলেন বুঝলাম না। শুধু ইমু বাচ্চাটার জন্য মন খারাপ আর একরাশ ক্লান্তি নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে এলাম।
ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু....
(*বি.দ্র. আমি একজন আমজনতার দর্শক হিসেবে ছবিটি দেখে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছি, এর মানে এই নয়, সবারই একরকম লাগবে। এ ছবি তো উচ্চ প্রশংসিতও বটে! কাজেই পরের মুখে ঝাল না খেয়ে আপনারাও দেখুন। ছবি নির্মাতা ও অভিনেতা অভিনেত্রীরদেরও অভিনন্দন জানাই।)
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত