এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনী

  অরুন্ধতী ঘোষ

প্রকাশ: ৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১৩:২৯ |  আপডেট  : ২১ এপ্রিল ২০২৪, ২১:০৭

আজ আমরা ভারতের স্বাধীনতার ৭৫  বছর উৎযাপন করছি|

এই স্বাধীনতা একদিনে বা একজনের বলিদানে আসেনি| নামি অনামি বহু মানুষের আত্মত্যাগ শুধু নয় তাদের পরিবারের সমপরিমান আত্মত্যাগের মাধ্যমে এসেছে| সেইসব অনামি অর্থাৎ প্রচার বিমুখ সংগ্রামী স্বর্গীয় শ্রী রনেন্দ্র কুমার ঘোষের বড় ছেলে শ্রী অনিরুদ্ধ ঘোষের বড় মেয়ে আমি অরুন্ধতী ঘোষ আজ আমার ঠাকুরদা ঠাকুরমা ও তাদের পরিবারের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরব|

আমার ঠাকুরদা স্বর্গীয় শ্রী রনেন্দ্র কুমার ঘোষ অধুনা বাংলাদেশের  বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার কোলাপাড়ার বাসিন্দা তখন অবিভক্ত ভারত| ১৯২৯ সালে ১৬ বছর ৬ মাস বয়সে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করেন| ১৯৩২ সালে চাকরি করতে শুরু করেন| তখন ভারত উত্তপ্ত, চারদিকে শুধু স্বাধীনতার আন্দোলন| আমার ঠাকুরদা ও সেই আন্দোলনে যোগদান করলেন| এরপর তিনি বিয়ে করলেন  বিক্রমপুরের লৌহজং উপজেলার কনকসার নিবাসী শ্রীমতী সুধারানী দেবীকে| ১৯৪০ সালে তাদের প্রথম কন্যা সন্তান হল| ঠাকুরদা সেইসময় অনুশীলন সমিতিতে নিয়মিত যাতায়াত করতে লাগলেন এবং ভবানীপুরে এসে থাকতে আরম্ভ করলেন| সেই সুবাদে ঠাকুরদার পরিচয় হল ভারতের গর্ব নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে|

১৯৪১ সালের ১৬- ১৭ ই জানুয়ারী নেতাজী যখন অন্তর্ধান হলেন তখন ঠাকুরদাকে বাড়ীতে সবেমাত্র খেতে বসার আসন থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল| সেইসময় নেতাজীর সাথে যারা গোপনে দেখা করেছিলেন তাদের সবাইকে এমনই আকস্মিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল|৬ মাস কি ১ বছর রাজবন্দি ছিলেন|সেইসময় আমার ঠাকুরমা কোলের শিশুকন্যা ও তার বিধবা শ্বাশুড়িকে নিয়ে নিদারুন কষ্ট সহ্য করেছিলেন|এরপর ঠাকুরদাকে ছাড়া হল, দ্বিতীয় কন্যা সন্তান জন্ম নিল তাদের| সেইসময় নেতাজী আবার স্বাধীনতার অন্তিম লড়াইয়ের ঝড় তুললেন দেশের বাইরে থেকে| একে একে আজাদ হিন্দ ফোর্স, INA গঠন করলেন| দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শিখরে| নেতাজী ব্রিটিশ বিরোধী দেশগুলি যথাক্রমে জাপান, জার্মানী,রাশিয়ার সাহায্যের জন্য সেইসব দেশে পাড়ি দিলেন| সেই খবর পেয়ে ঠাকুরদার মতো দেশের অভ্যন্তরীন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ও গর্জে উঠলেন| দেশের বাইরে ভেতরে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রবল চাপে নাজেহাল ব্রিটিশরা ধরপাকড় শুরু করল| ১৯৪৩ সালে হঠাৎ ঠাকুরদা সকালবেলা দাড়ি অর্ধেক কামিয়েছেন এমন সময় পুলিশ সেই অবস্থায় গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলে গেল| বাড়ীতে অসহায়ভাবে পড়ে রইল ঠাকুরমা তার কোলের দুই শিশু কন্যা ও ঠাকুরমার বিধবা শ্বাশুড়ী| বলা বাহুল্য যতবার ঠাকুরদা জেলে গেছেন ততবার চাকরি খুঁইয়েছেন| ভাবতে পারা যায় চারজন পরিবারের সদস্যকে কি পরিমান দারিদ্রতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল| কিন্ত দেশ মাতার পরাধীনতার যন্ত্রনা নিজেদের কষ্টের থেকে অনেক বেশী ছিল তাদের কাছে|জেলের ভেতরে ঠাকুরদা নিয়মিত প্রদীপের আলোয় বই, খবরের কাগজ পড়তেন এবং জামাকাপড় সেলাই ও করতেন| ১৯৪৬ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়| ১৯৪৭ সালের ৯ ই জানুয়ারী আমার বাবার জন্ম হয়| এরপর দেশ স্বাধীন হয়, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিভিন্ন পেনশন ও সম্বর্ধনা দেওয়া হয়, কিন্তু আমার ঠাকু্রদা এই স্বাধীনতা চাননি তাই তিনি জীবিত কালে কোন পেনশন ও সম্বর্ধনা গ্রহন করেননি| নেতাজীর আদর্শে চলা অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন| সেইসময় ঠাকুরদা L.I.C তে কর্মরত ছিলেন| তাঁর আর ও দুই পুত্র সন্তানের জন্ম হয়| কাঙ্খিত স্বাধীনতা পাননি বলে নিজেকে প্রচার থেকে দূরে রাখতেন|অবশেষে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সংসারকে ভাসিয়ে চলে গেলেন| সেইসময় থেকে ঠাকুরমা Freedom fighter pension পেয়েছিলেন আমৃত্যু| 

এইভাবে আমাদের স্বাধীনতা অগনিত মানুষ ও তাদের পরিবারের অক্লান্ত আত্মত্যাগের বিনিময়ে এসেছে| তাদের আত্মত্যাগের ঋণ আমরা কখনো শোধ করতে পারবনা, কেবলমত্র নতজানু নতমস্তক হয়ে প্রণামের সঙ্গে সম্মান প্রদান করি সেই সকল পরিবারকে ও সংগ্রামীদের।

লেখক : অরুন্ধতী ঘোষ, পশ্চিম বাংলা

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত