তিতুমীর কলেজ

আমার অবহেলার বিদ্যাপীঠ    

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:৩৬ |  আপডেট  : ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৩৭

শেষ পর্বঃ আমার পরীক্ষাগুলো
 
পরীক্ষার পুরো সময়টা আমার ছেলে অসুস্থ থাকলো। মায়ের দুধ-খাওয়া শিশুটি মাতৃবিচ্ছিন্ন হয়ে বাইরের খাবার খেয়ে প্রায় মরতেই বসেছিল। অসুস্থ শিশুপুত্রকে দূরে রেখে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় অপরিচিত পরিবেশে থেকে পরীক্ষা দিয়ে আমি উচ্চমাধ্যমিক পাস করলাম বটে, তবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাটা আসলে ছিল আমার জীবনের কয়েকটি কঠিন পরীক্ষার সমষ্টি। সব কটাতেই উৎরে গেছি, শুধু শিশুপুত্রের কাছ থেকে মাতৃদুগ্ধ কেড়ে নিয়ে মা হিসেবে আমি পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম।

সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট পরীক্ষা পর্যন্ত কোনোমতে সময় পার করে আমি ঢাকা থেকে পাততাড়ি গুটোলাম। চললাম শ্বশুরবাড়ি মানিকগঞ্জ। প্রায় আড়াই বছর হলো বিয়ে হয়েছে আমার। অথচ স্কুল কলেজ লেখাপড়া করে করে বাড়ির বউ শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থিতু হতে পারছে না। ছুটিছাটায় দু চারদিনের জন্য যাই বটে, কিন্তু সে তো বেড়াতে যাওয়া! বউ শ্বশুর ঘর করবে না, শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাবে, তা তো হয় না! লোকে বলবে কী! তাছাড়া মানিকগঞ্জে শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ, চাচাশ্বশুরের পরিবার সব মিলিয়ে ভরভরন্ত বাড়ি। শাশুড়ি তার ছেলে বউ নাতি সবাইকে কাছে রাখতে চান। আমার স্বামীও বাবা-মা ভাই-বোনকে কাছে পেতে চান। এর মধ্যে তিনি চেষ্টা চরিত্র করে ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জে পোস্টিংও নিয়ে নেন।

সেকেন্ড ইয়ারে পড়াকালীন আমার ছোট্ট ছেলেটা


একদিন স্বামী বললেন, চল এবার নিজেদের বাড়ি যাই। পরীক্ষার সময় ঢাকায় এসে পরীক্ষা দিয়ে যাবে। গ্রামের খোলা পরিবেশে খোকা দৌড়াবে, ধুলোমাটি দিয়ে খেলা করবে, খাঁটি গরুর দুধ খাবে, বেশ হবে। তা ছাড়া বাড়ি ভরতি চাচা ফুপুরা আছে, ওদের কোলে কাঁখে থাকবে, তুমিও পড়াশোনা করতে পারবে।
 
তো শুভদিন দেখে বইপত্তর বাক্সে ভরে নিয়ে ছেলেকোলে আমি চলে এলাম মানিকগঞ্জে। মানিকগঞ্জ শহর ঘেঁসে পশ্চিম দাশরা গ্রামে আমার শ্বশুরবাড়ি। ওরা নদীশিকস্তি মানুষ। পদ্মাপাড়ে হরিরামপুর থানায় চরমুকুন্দিয়া গ্রামে ছিল আমার শ্বশুরের আদি বাড়ি। নদী সে বাড়ি ভেঙে নিয়ে গেলে আজিমনগর গ্রামে বাড়ি করে। আজিমনগরের বাড়িও একসময় পদ্মার পেটে যায়। আমার শ্বশুর চট্টগ্রাম রেলওয়েতে চাকরি করতেন। পরিবারও সেখানে ছিল। পরে মানিকগঞ্জের পশ্চিম দাশরা গ্রামে নতুন বাড়ি করেন। আমার বিয়ের সময় এ বাড়ির বয়স মাত্র দু বছর। বাড়ির নামই ‘নতুন বাড়ি’। বাড়ির মাঝখানে বিশাল উঠান। একপাশে মরিচ বেগুনের খেত, পুঁইয়ের জাংলা। মাঝখানে ছাতার মত ছড়ানো একটা ঝলমলে পেয়ারা গাছ। উঠোন জুড়ে তার ছায়াচিত্র। উঠোনের একদিকে থাকার ঘর অন্য পাড়ে রান্নাঘর। আশেপাশের বাসিন্দা সব দরিদ্র জনগোষ্ঠি। বেশিরভাগই হিন্দু জেলে পরিবার। রাজবংশী পাড়া। বাড়িতে বাড়িতে বাঁশের আড়ায় জাল শুকুতে দেওয়া। দাওয়ায় ঝোলানো, কাঠিতে সুতো-ঠাসা অর্ধসমাপ্ত জাল। রাজবংশী নারীরা অবসরে হাতের আঙুলে জালের জাফরি বিছিয়ে নিপুণ কৌশলে সুতোকাঠি এফোঁড় ওফোঁড় করে। রাজবংশী পাড়ার মাঝখানে ঠাকুর পাড়াও আছে একটা। তারা অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন। দিনান্তে ওদের নিকোনো উঠোনে চাটাই পেতে খোল করতাল বাজিয়ে নাম সংকীর্তনের আসর বসে। তবে নিম্নবিত্ত মানুষ বেশি হওয়াতে সারাক্ষণ চুরির ভয়। দিনের বেলাও জুতো-স্যান্ডেল সাবান-চিরুনি গামছা-লুঙ্গি হাঁড়ি-কলসি যা-ই চোখের আড়ালে থাকে, চুরি হয়ে যায়। আমার শাশুড়ি চুরি ঠেকাতে সারাক্ষণ চোখ পেতে রাখেন। আমরা রান্নার সময় শোবার ঘর থেকে তেল পিঁয়াজ থেকে শুরু করে যাবতীয় জিনিসপত্র রান্নাঘরে নিয়ে আসি, আবার সন্ধ্যার আগেই ডালাকুলা শিশিবোতল সব শোবার ঘরে নিয়ে যাই।
 
গ্রামের চারদিকে বাঁশবন, বড় বড় গাছ, বুনো জলাজঙ্গল, কচু, কলাবতী আর ভাঁটফুলের ঝোপ। দিনের আলো মিলিয়ে না যেতেই চারপাশ থেকে শেয়াল ডাকতে শুরু করে। শেয়ালের প্রকৃতিও অদ্ভুত। এক শেয়াল রা করলেই বাকিগুলো কোরাস ধরতো। কান পাতা দায় হতো। এদিকে আমার চৌদ্দমাস বয়সী পুত্তুর শেয়ালের একটা হুক্কা হুয়া শুনলেই ভয় পেয়ে কুঁকড়ে যেতো। দুই কান চেপে ধরে চিৎকার শুরু করতো। প্রতিদিন সন্ধ্যোবেলায় শেয়ালের হুক্কাহুয়া আর ছেলের ভয় পাওয়া কান্না মিলে আমার চারপাশে এক অদ্ভুত জীবনসংগীত বেজে যেতো। অনেক কষ্টে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে পায়ের ওপর দোলা দিতে দিতে হারিকেনের আলোয় চলতো আমার পরীক্ষার পড়াশোনা। শেয়াল ডেকে উঠলেই ঘুমের মধ্যেই কেঁপে উঠতো ছেলে। তখন ওকে বুকের ভেতরে গুঁজে রাখতে হতো। তাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতো। বুকের খোড়লে ছেলেকে রেখে সাবধানে পড়ার বই মেলে ধরতাম। দিনের বেলায় সংসারের কাজেকর্মে পড়ার সময় পেতাম না। রাতেও না পড়লে পরীক্ষা দেবো কেমন করে? এভাবে একদিন আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এলো। আমার সিট পড়লো ঢাকার নটরডেম কলেজে। এবার দেখা দিলো বিরাট সমস্যা। সেটা হলো, পরীক্ষার সময়ে আমি থাকবো কোথায়, আমার ছেলেকে কে দেখবে? আমাকে তো থাকতে হবে নটরডেম কলেজের কাছাকাছি। নইলে পরীক্ষাগুলোতে সময়মত উপস্থিত হতে পারবো না। আমার স্বামীর অফিস মানিকগঞ্জে, তাকে থাকতে হবে সেখানেই। সে তো ছেলে পালতে পারবে না। আমার শাশুড়িও বয়স্ক মানুষ। এদিকে আমার আব্বার পোস্টিং তখন ঢাকার বাইরে, আদমজীনগর, জুটমিল এরিয়ার ভেতরে। বাসাও সেখানে। কী করি! তারপরে আমরা একটা অমানবিক সিদ্ধান্ত নিই। আমার বোল-না-ফোটা ছোট্ট দুধের শিশুটিকে আদমজীতে আম্মার কাছে রেখে আসবো। আমার স্বামী থাকবেন মানিকগঞ্জে আর আমি মহাখালিতে আমার এক দূর সম্পর্কের ননদের দুই রুমের ভাড়া বাসায় থেকে পরীক্ষা দেবো। পরীক্ষা চলবে প্রায় এক মাস ধরে। এই এক মাস আমার বাচ্চাটা থাকবে মা-ছাড়া।
  
প্রথম যেদিন আমি আদমজীতে আম্মার কোলে ছেলেকে রেখে আমার গলা আঁকড়ে-ধরা ওর ছোট্ট হাতটি প্রায় ছিঁড়ে চলে এলাম, নিজেকে মনে হচ্ছিল রাক্ষুসী, দানবী। কী হবে ঘোড়ার ডিমের এই লেখাপড়া দিয়ে! সারা শরীর যেন জল হয়ে আমার চোখ দিয়ে বের হয়ে আসতে লাগলো। আমার দুই কান ছেলের কান্নার স্বরে ব্যথা করতে লাগলো। এ কান্না আর ফুরোয় না। এ এক অনন্ত কষ্টের ধ্বনি। ননদের বাসায় পড়তে বসে আমি সারাক্ষণ ছেলের কান্না শুনি। ঘুমের মধ্যেও শুনি। কল্পনা নয়, সত্যিই শুনি! অদ্ভুত সেই শ্রুতি। মনে হচ্ছিল বিশ্বপ্রকৃতি জুড়ে আমার ছেলের কান্নার ধ্বনি রেকর্ড হয়ে গেছে। ওটা বেজেই চলছে। আম্মার কোল থেকে ওর বাড়িয়ে দেয়া ছোট্ট করুণ দুটি হাত আমাকে অস্থির করে রাখে। আমার বইয়ের পাতা চোখের পানিতে ভিজে যায়। রাতে শুয়ে ছেলেকে নিয়ে নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে কাঁদতে বসি। সে সময় কোনো ফোন নেই। চিঠি ছাড়া যোগাযোগের কোনে ব্যবস্থা নেই। আবার একা একা তখন চলতেও শিখিনি। স্বামীর আশায় বসে থাকি, কবে তিনি মানিকগঞ্জ থেকে এসে আমাকে নিয়ে আদমজী যাবেন আর আমি ছেলের মুখ দেখবো!

পরীক্ষা শুরু হলো। হলে বসে কী লিখি কিছুই মনে থাকে না। কোনো প্রশ্ন দেখে কখনো মনে হয়, এটা এলো কোত্থেকে, এটা তো সিলেবাসেই নেই! আবার বই পড়তে গিয়ে সিলেবাসের বাইরের বিষয়কেও মনে হতে থাকে, হায় হায় এটা তো পড়া হয়নি, পরীক্ষায় এলে কী লিখবো! এর মধ্যে একদিন, সেদিন পর পর দুই পেপারের পরীক্ষা, একটা পরীক্ষা দিয়ে ব্রেক টাইমে মাঠে বসে পরের পরীক্ষার বই নেড়েচেড়ে দেখছি, এমন সময় সামনে আম্মাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম। নটরডেম কলেজের মাঠে আম্মা কেন? তবে কি আমার ছেলের কোনো খারাপ খবর আছে? আম্মা আমার দিকে দু হাত বাড়িয়ে কি বলতে বলতে ছুটে এলেন। আমার শংকিত মন সেটাকে চরম খারাপ খবর হিসেবে অনুবাদ করে নিল। আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরে কী হয়েছে বলে চিৎকার করে উঠলাম। আম্মা ধাতস্থ হলেন। বললেন, শুভ (আমার ছেলের শিশুকালের নাম) খুব অসুস্থ। ওর কঠিন রক্ত আমাশয় হয়েছে। কদিন আগে এত ঘোরতর অবস্থা ছিল যে মনে করেছিলেন আর বাঁচবে না! শুকিয়ে কাঠি কাঠি। কিছু খেতে চায় না। সারক্ষণ আম্মু আম্মু করে কাঁদে। আম্মা কাঁদতে লাগলেন। আমি হাতের বই ছুঁড়ে ফেললাম। পরীক্ষা দেব না। এখনই আদমজী যাবো। পরে আম্মাই আবার বুঝিয়ে শুনিয়ে আমাকে শান্ত করলেন। ছোট বোনদের কাছে আমার ছেলেকে রেখে এসেছিলেন আমাকে শুধু একটু দেখে যেতে। তখনই চলে গেলেন আম্মা। পরীক্ষা হলে বসে আমি সময় কাটালাম শুধু দোয়া পড়তে পড়তে আর বুকের ধড়ফড়ানি কমানোর চেষ্টা করে।
 
পরীক্ষার পুরো সময়টা আমার ছেলে অসুস্থ থাকলো। মায়ের দুধ-খাওয়া শিশুটি মাতৃবিচ্ছিন্ন হয়ে বাইরের খাবার খেয়ে প্রায় মরতেই বসেছিল। অসুস্থ শিশুপুত্রকে দূরে রেখে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় অপরিচিত পরিবেশে থেকে পরীক্ষা দিয়ে আমি উচ্চমাধ্যমিক পাস করলাম বটে, তবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাটা আসলে ছিল আমার জীবনের কয়েকটি কঠিন পরীক্ষার সমষ্টি। সব কটাতেই উৎরে গেছি, শুধু শিশুপুত্রের কাছ থেকে মাতৃদুগ্ধ কেড়ে নিয়ে মা হিসেবে আমি পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম।

সমাপ্ত

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত