জাতীয় সংগীত

অপরিণামদর্শী চিন্তাভাবনা পরিত্যাজ্য

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫৪ |  আপডেট  : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:১৫

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বশীর আল্‌হেলাল (নেয়ামুল বশীর) ১৯৮৪ কি ’৮৫ সালে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমির এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘আজকালকার মা-বাবারা সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান না, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলেন না। এভাবে চলতে থাকলে এমন একদিন হয়তো আসবে, যেদিন আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানবে ১৯৭১ সালে “মুক্তিযোদ্ধা নামের দুষ্কৃতকারীরা” দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করতে চেয়েছিল।’ (স্মৃতি থেকে)। শ্রদ্ধেয় বশীর আল্‌হেলাল যে সময়টির কথা বলেছিলেন, তা কি এসে গেছে? শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পথরেখা বেয়ে এগিয়ে আসা ছাত্র-গণ আন্দোলনে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর একটি বিশেষ মতাদর্শের লোকজনের কথাবার্তায় তেমন আভাস স্পষ্ট। তারা ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকে নিজেদের অর্জিত বিজয় হিসেবে ধরে নিয়ে এমন সব কথা বলছেন, মন্তব্য করছেন, যা নিয়ে সর্বত্র বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। তেমনই একটি মন্তব্য করেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দীর্ঘ নয় বছর নিখোঁজ সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী।

ব্যক্তিজীবনে তিনি স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ৯০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াতে ইসলামীর প্রাক্তন আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে। গোলাম আযম আদালত-প্রদত্ত সাজা ভোগ করা অবস্থায় ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর বিএসএমএমইউ হাসপাতালে মারা যান। ৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের হলরুমে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে জনাব আযমী বলেছেন, ‘আমাদের যে জাতীয় সংগীত রয়েছে, সেটি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। এ সংগীত ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময় দুই বাংলাকে এক করার জন্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন। এ জাতীয় সংগীত দুই বাংলাকে এক করার জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক করতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই?’ তিনি এও দাবি করেছেন, ‘এ সংগীত ১৯৭১ সালে ভারত আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল।’ (প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)।

ব্রিগেডিয়ার আযমীর দাবি প্রসঙ্গে বলার আগে আমার ‘সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটির প্রথম দুটি স্তবক কী করে আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত পেল, তা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলা দরকার। এ সম্পর্কে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বইয়ে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। সেখান থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রকে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র হিসেবে চালু করার পর ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ইত্যাদি দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিও বাজানো হচ্ছিল। এরপর বেতারকেন্দ্রটি স্থানান্তর করা হয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম থানার শালবাগানে। সেখানে কয়েক দিন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পর তা কলকাতায় স্থানান্তর করা হয়। সবখানেই অন্যান্য গানের সঙ্গে আমার সোনার বাংলা বাজানো হতো। বিশেষ করে অধিবেশন শুরু এবং শেষে এ গানটি বাজানো হতো নিয়মিত। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার এ গানটিকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে ৫৩ বছর ধরে এটিই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত এবং সমাদৃত হয়ে আসছে।

এত দিন কারও কাছেই এটা বাংলাদেশের ‘অস্তিত্বের পরিপন্থি’ বলে মনে হয়নি। হঠাৎ করে আযমী সাহেবের কেন এটা মনে হলো, তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। অবশ্য এর আগে কেউ কেউ আমাদের জাতীয় সংগীত নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছেন কিন্তু তা হালে পায়নি। তবে এবার আযমীর এ-সংক্রান্ত বক্তব্য একেবারে আনুষ্ঠানিক এবং আগস্ট বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। কেননা দুঃশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তনের হাওয়া বেশ জোরেশোরেই বইছে। এসবের মধ্যে আমাদের সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন অন্যতম। বিশিষ্টজনেরা এ নিয়ে তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। তারা বলছেন, একটি ‘নির্বাচিত’ সরকারের স্বৈরাচার হয়ে ওঠার যথেষ্ট উপাদান আমাদের বর্তমান সংবিধানে আছে। ওইসব উপাদান ঝেড়ে ফেলে সংবিধান গণমুখী করার মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থেই রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণকে ফিরিয়ে দিতে হবে। সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ দ্বিমত করেছেন এমনটি শোনা যায়নি। বরং এর প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক বিবেচনা করে অনেকেই এর পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের অভিমত ব্যক্ত করে চলেছেন। হয়তো অচিরেই এ বিষয়ে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হবে এবং আমরা একটি গণমুখী সংবিধান পেয়ে যাব।

একটি দেশের সংবিধান সময়ের প্রয়োজনে সংশোধন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা পুনর্লিখন হতেই পারে। এটা নির্ভর করে দেশের পরিস্থিতি, রাষ্ট্রের প্রয়োজন এবং জনমতের ওপর। এ মুহূর্তে আমাদের সংবিধান পরিবর্তন বা পুনর্লিখনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। সংবিধানের মৌলকাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে এর ধারা-উপধারা ও বিধিবিধানের যুগোপযোগী পরিবর্তনের মাধ্যমে সে সংস্কারের কাজটি সম্পন্ন হবে বলে দেশবাসী আশাবাদী। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার আযমী জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের যে আহ্বান জানিয়েছেন, তার কোনো প্রয়োজন আছে কি? তা ছাড়া এর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কেউ একমত হবেন বলেও মনে হয় না। এমনকি তার পিতা যে রাজনৈতিক দলটির আমির ছিলেন, সেই জামায়াতে ইসলামীও এ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করবে কি না সন্দেহ। কেননা জামায়াতে ইসলামীর অতীত যা-ই হোক, দলটি এখন বাংলাদেশের একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের বিরুদ্ধে যায় কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌল চেতনার পরিপন্থি বলে বিবেচিত হয়, এমন কোনো অবস্থান দলটি গ্রহণ বা সমর্থন করবে বলে মনে হয় না। বিশেষত দলটির বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্য-মন্তব্য দেশবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে।

তার পরিশীলিত ও পরিমিতি বোধসম্পন্ন বক্তব্য জনসমক্ষে তাকে একজন পরিপক্ব রাজনীতিক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ফলে জামায়াতে ইসলামী এমন কোনো অবস্থান হয়তো নেবে না, যাতে মানুষের মনে একাত্তরে তাদের ভূমিকার কথা নতুন করে স্মরণে আসে। তা ছাড়া ব্রিগেডিয়ার আযমী সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে ছিল না।

সুতরাং ওটা তার ব্যক্তিগত অভিমত এবং নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশের গণমানুষের চিন্তা-চেতনার পরিপন্থি, যাকে অপরিণামর্শী বলা অত্যুক্তি হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পুনর্নির্মাণের জন্য বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ কাজ জাতির সামনে রয়েছে। সেসব বাদ দিয়ে স্বাধীনতার স্মারক হিসেবে স্বীকৃত জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের মতো অপরিণামদর্শী চিন্তাভাবনা পরিত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয়।

সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক - মহিউদ্দিন খান মোহন

 

সান

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত