৬০ বিঘার বেশি কৃষিজমির মালিক চিহ্নিতকরণ শুরু ডিসেম্বরে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৫ |  আপডেট  : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৩৩

একজন ব্যক্তি বা তার পরিবার ৬০ বিঘার বেশি কৃষিজমির মালিক হতে পারবেন না। ৪০ বছর ধরে আইনে এ বিধান থাকলেও কোনো সরকার বাস্তবায়ন করেনি। ভূমি সংস্কার আইনের এমন বিধান বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।

৬০ বিঘার বেশি কৃষিজমির মালিকদের চিহ্নিত করার কাজ আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হচ্ছে। একজন ব্যক্তি কিংবা কোনো পরিবারের অধীনে কী পরিমাণ জমি রয়েছে তা চিহ্নিত করার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা এখনো সরকারের কাছে নেই। প্রাথমিকভাবে অনলাইন ভূমি উন্নয়ন কর দেওয়ার ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ভিত্তিতে সীমার অতিরিক্ত জমির মালিকদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

বিজ্ঞাপন

তারা জানান, মালিকদের চিহ্নিত করার পর সীমার অতিরিক্ত জমি আইন অনুযায়ী কোন পদ্ধতিতে খাস করা হবে এবং অন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটি নিয়ে এখনো চিন্তা-ভাবনা চলছে। একই সঙ্গে জমি নিবন্ধন, নামজারি পর্যায়ে সীমার বেশি জমির মালিকদের চিহ্নিত করা এবং পরিবারের সদস্যদের জমির তথ্যের জন্য স্থানীয় সরকারের সঙ্গে ডিজিটাল তথ্যের আন্তঃসংযোগের বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে।

মনে করা হচ্ছে, দেশের অনেক ব্যক্তি ও পরিবারই ৬০ বিঘার বেশি জমির মালিক। আইন বাস্তবায়নে গেলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। তাই আপাতত চিহ্নিতকরণের দিকেই বেশি নজর দিতে চায় সরকার। যাতে তারা আর নতুন করে জমির মালিক না হতে পারেন।

আইনে আছে কেউ ৬০ ব্ঘিার বেশি কৃষিজমির মালিক হতে পারবে না। অনেকদিন আগে থেকেই এটি আইনে আছে। এতদিন এটি বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। কোন পদ্ধতিতে আমরা এ আইনটি বাস্তবায়ন করবো সেটা নিয়ে আমাদের অফিসাররা কাজ করছেন।- ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব) মো. আব্দুস সবুর মন্ডল

ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশে (ল্যান্ড রিফর্মস অর্ডিন্যান্স) প্রথমবার ৬০ বিঘার বেশি জমি না রাখার বিধান যুক্ত করা হয়। গত বছর ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশ যুগোপযোগী করে ‘ভূমি সংস্কার আইন, ২০২৪’ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনেও ওই বিধান বহাল রাখা হয়।

৬০ বিঘার বেশি কৃষিজমির মালিক হলেই বাকিটা ‘খাস’, হবে শাস্তি

আইনে যা আছে
‘ভূমি সংস্কার আইন, ২০২৩’-এ কৃষি ‘কৃষি ভূমি অর্জন সীমিতকরণ’ শিরোনামের ৪ ধারায় বলা হয়েছে- ৬০ প্রমিত বিঘার বেশি কৃষিজমির মালিক বা তার পরিবার হস্তান্তর, উত্তরাধিকার, দান বা অন্য কোনো উপায়ে নতুন কোনো কৃষিজমি অর্জন করতে পারবেন না।

তবে এ বিধান বিধি দিয়ে নির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী শিথিল করা যাবে। কোনো সমবায় সমিতির সব সদস্য তাদের ভূমির মালিকানা সমিতির অনুকূলে হস্তান্তর করে নিজেরা চাষাবাদ করলে; চা, কফি, রাবার বা অন্য কোনো ফলের বাগানের জন্য ব্যবহৃত ভূমি; কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান তার নিজস্ব কারখানায় ব্যবহৃত কাঁচামাল উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ভূমি ব্যবহার করলে; কোনো কাজের জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় বিবেচিত এমন কোনো ভূমি; কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শতভাগ রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্য বা কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য বা শতভাগ রপ্তানিমুখী বিশেষায়িত শিল্পের জন্য সরকারের অনুমোদন নিয়ে ব্যবহৃত ভূমি; কোনো সংস্থার জনকল্যাণে সরকারের অনুমোদন নিয়ে ব্যবহৃত ভূমি; কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শিল্প-কারখানা স্থাপন বা সম্প্রসারণে সরকারের অনুমোদনে ব্যবহৃত ভূমি এবং ওয়াকফ, দেবোত্তর বা ধর্মীয় ট্রাস্টের ক্ষেত্রে এর মালিকানাধীন ভূমির সম্পূর্ণ আয় ধর্মীয় বা দাতব্য কাজে ব্যয় হলে ওই বিধান (৬০ বিঘার বেশি জমির মালিক না হাওয়া) শিথিল হবে।

যদি কোনো ভূমির মালিক এ ধারার বিধান লঙ্ঘন করে ক্রয়সূত্রে কোনো নতুন কৃষিভূমি অর্জন করেন, তাহলে যে পরিমাণ ভূমি ৬০ বিঘার বেশি হবে তা সরকারের অনুকূলে বিধি নির্ধারিত পদ্ধতিতে সমর্পিত হবে এবং সমর্পিত ভূমির মূল্য বাবদ কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। তবে শর্ত থাকে যে, উত্তরাধিকার, দান বা উইলের মাধ্যমে অর্জিত ভূমির ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না।

উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত ভূমি ৬০ বিঘার বেশি হলে ভূমির মালিক তার পছন্দ অনুযায়ী ৬০ বিঘা ভূমি রাখতে পারবেন এবং অবশিষ্ট ভূমি সরকার বিধি নির্ধারিত পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ দিয়ে খাস করতে পারবে বলেও আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।

যেভাবে বাস্তবায়ন হবে আইনের বিধান
আইনের বিধান বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। বাস্তবায়ন পর্যায়ে যাতে কোনো জটিলতা সৃষ্টি না হয় সেজন্য আইনগত দিকগুলো দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব) মো. আব্দুস সবুর মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইনে আছে কেউ ৬০ ব্ঘিার বেশি কৃষিজমির মালিক হতে পারবে না। অনেকদিন আগে থেকেই এটি আইনে আছে। এতদিন এটি বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। কোন পদ্ধতিতে আমরা এ আইনটি বাস্তবায়ন করবো সেটা নিয়ে আমাদের অফিসাররা কাজ করছেন।’

তিনি বলেন, ‘আইনে সীমার বেশি জমি খাস করার কথা বলা হয়েছে। জমি খাস করতে পারে এসিল্যান্ডরা (সহকারী কমিশনার-ভূমি)। কিন্তু কোনো কোনো ব্যক্তির অধিক জমি অনেক সময় এক এসিল্যান্ডের অধীনে থাকে না। তাই এটি বাস্তবায়নের আইনি প্রক্রিয়াটা কী হবে, সেটি নিয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি।’

ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটালাইজেশন, নলেজ ম্যানেজমেন্ট ও পারফরম্যান্স (ডিকেএমপি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. এমদাদুল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে শুরু (৬০ বিঘার বেশি জমি মালিকদের) করতে চাই। প্রথমে আমরা ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করবো। এরপর পরিবারের দিকে যাবো, তবে এটাতে সময় লাগবে। আমরা এটা করবো এনআইডির ভিত্তিতে। কারণ ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থায় এটা ধরা সম্ভব। তবে এখতিয়ারের বেশি জমি থাকা কেউ যদি তার এনআইডি দিয়ে ভূমি উন্নয়ন কর না দেয় তবে আমরা তাকে ধরতে পারবো না।’

কারও ৬০ বিঘার বেশি জমি পেলে আটকে দেবো। এরপর তার পরিবারের সদস্য যেমন স্ত্রী, সন্তানদের এনআইডি দিয়েও দেখবো কতটুকু জমি আছে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে আর নতুন করে কোনো জমি কিনতে পারবে না।- ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিকেএমপি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. এমদাদুল হক চৌধুরী

তিনি বলেন, ‘এটা আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। আইনটি আমরা বাস্তবায়ন করবো। শনাক্ত করার জন্য ব্যবস্থা গড়ে তুলছি।’

অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘কারও ৬০ বিঘার বেশি জমি পেলে আটকে দেবো। এরপর তার পরিবারের সদস্য যেমন স্ত্রী, সন্তানদের এনআইডি দিয়েও দেখবো কতটুকু জমি আছে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে আর নতুন করে কোনো জমি কিনতে পারবে না। তাকে আমরা আটকে দেবো।’

‘আমাদের যখন ভূমি ডাটা ব্যাংক হয়ে যাবে, তখন সিস্টেম থেকে বলে দেবে কে কে ৬০ বিঘার সীমা অতিক্রম করেছে, লাল বাতি জ্বলবে, তাদের আর নতুন করে নামজারি হবে না’ বলেন এমদাদুল হক চৌধুরী।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অনলাইন ভূমি কর ব্যবস্থা ছাড়াও ভূমি সেবার অন্য স্তরে যাতে একজন ব্যক্তির জমির পরিমাণ চিহ্নিত করা যায়, সে ব্যবস্থা চালুর প্রক্রিয়া চলছে।

৬০ বিঘার বেশি কৃষিজমির মালিক হলেই বাকিটা ‘খাস’, হবে শাস্তি

ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিকেএমপি অনুবিভাগের যুগ্মসচিব মো. জাহিদ হোসেন পনির জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন আমাদের এলডি ট্যাক্স সার্ভিসটি (অনলাইনে ভূমি কর দেওয়া) ভার্সন-এক রয়েছে। এ ব্যবস্থায় কারও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিলে এ নম্বরের অনুকূলে যতগুলো জমির খতিয়ান আছে, সেগুলো দেখায়। আগামী মাসে আমরা এলডি ট্যাক্সের ভার্সন-দুই আনছি। এটা এলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যখন কারও এনআইডি দিয়ে সিস্টেমে সার্চ দেবো, তখন দেখবো তার এ এনআইডির অধীনে কতটুকু জমি আছে। আমাদের কৌশল হবে যে আপনার জমির সীমা অতিক্রম করেছে, এরপর আপনার পরিবারের সদস্যদের কার এনআইডির বিপরীতে কী পরিমাণ জমি আছে সেটা দেখা।’

‘একই সঙ্গে যাতে কোনো ব্যক্তির নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের জমির পরিমাণ আমরা দেখতে পারি- সেটি কীভাবে করা যায় তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি। এ গ্যাপটা রয়ে গেছে।’

যুগ্মসচিব বলেন, ‘আমরা এটি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে কাজ করছি। তাদের সঙ্গে আমাদের ডাটা শেয়ারিং হচ্ছে।’

জাহিদ হোসেন পনির বলেন, ‘একজন ব্যক্তির পারিবারিক যে তথ্য সেটি স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে। কে কার সন্তান, কে কার বা- সেটি আছে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তরে, ইউপি চেয়ারম্যান, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দপ্তরে। তাদের কাছে ফ্যামিলি হিস্ট্রি আছে। তাদের সঙ্গে আমরা কীভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারি, সেটি দেখা হচ্ছে। অনেকে তো কাজের মেয়ের নামেও সম্পত্তি রাখে। সেটি আমরা দেখবো পরবর্তী ধাপে।’

‘এছাড়া একটি বিষয় নিয়ে আমরা ভাবছি। সেটি হলো কোনো ব্যক্তি যখন মিউটেশন করবে তখন তিনি একটি অঙ্গীকার করবেন যে, এ জমি নামজারির আবেদন করেছি, এছাড়া আরও অমুক অমুক জায়গায় এই এই জমি আছে। এতেই অনেকে আটকা পড়ে যাবে। এ পর্যায়ে তিনি যদি ঘোষণা দেন ৬০ বিঘার ওপরে তার কৃষিজমি নেই, এতেই কিন্তু সতর্ক হয়ে যাবে। তার এ অঙ্গীকারের ফর্মটা দুদকের কাছে চলে যাবে। এগুলো চিন্তা-ভাবনার মধ্যে রয়েছে’ বলেন যুগ্মসচিব জাহিদ হোসেন।

ডিকেএমপি অনুবিভাগের উপসচিব সেলিম আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সীমার বেশি জমির মালিকদের আমরা তিনটি জায়গায় ফিল্টার করতে পারি। আমরা জমি নিবন্ধনের সময়ই তাদের আটকে দিতে পারি। এসময় এনআইডি ছাড়াও দেখবো তার পরিবারের সদস্য কারা কারা আছেন। এটা স্থানীয় সরকারের বিষয়। এজন্য প্রত্যয়ন ব্যবস্থার আন্তঃসংযোগ তৈরি করতে হবে। তখন ওই আইডি দিলেই বের হয়ে আসবে তার মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান কে এবং তাদের নামে কী পরিমাণ জমি আছে। এটা যাতে আমরা করতে পারি, সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে।’

তিনি বলেন, ‘মিউটেশনের (নামজারি) সময়ও আমরা এনআইডি ব্যবহার করি। ওই ব্যক্তির নামে কী পরিমাণ জমি নামজারি হয়েছে, সেটা বের করা সম্ভব, যদি আমরা সেই পলিসি নিই।’

সেলিম আহমদ বলেন, ‘তবে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো এনআইডির বিপরীতে ভূমি উন্নয়ন কর দিয়ে থাকেন, তবে তার তথ্য আমাদের কাছে আছে। এটা আমাদের রেডি। এটা দিয়ে আমরা তার জমির পরিমাণ বের করতে পারবো।’

সৌজন্যে : জাগো নিউজ

কা/আ 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত