হিউ-এন-সাঙ এর চোখে আফগানিস্তান 

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২১, ১২:৪৯ |  আপডেট  : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৭:০০

শান্তনু সরকার
-------------------------

হিউ-এন-সাঙ এর বর্ননা সপ্তম শতাব্দীর ভারত তথা মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাস জানার এক অনবদ্য দলিল। তার যাত্রা পথের বিবরন আমাদের জানতে সাহায্য করে ভারতীয় সংস্কৃতির বিস্তার আর বিশেষত বৌদ্ধধর্মের অবস্থান চীন-মধ্য এশিয়া-আর ভারতে। আরেকটা কারনে তার এই যাত্রা পথের বিবরন অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ। কারন তিনি যে সময় মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থান অতিক্রম করেছিলেন (৬৩০-৬৪০ আনুমানিক) সেই সময় আরও সুদূর পশ্চিম এশিয়ার জম্ম নিচ্ছে ইসলাম। যা হয়তো আর কয়েকশো বছরের মধ্যে পালটে দিয়েছিলো মধ্য এশিয়ার সামগ্রিক ধর্মীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তাই তার বিবরণ প্রি-ইসলামিক মধ্য এশিয়া আর আফগানিস্তানকে জানার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আসা যাক তার আফগান পথের বিবরনে।

কুন্দুজ
----------

তিনি সিল্ক রুটের পথ ধরে প্রথমে সমরখন্দ পৌছান। সেখান থেকে হারিয়ে যাওয়া কেশ নগর হয়ে পামির মালভূমির আয়রন গেট বা লৌহ কপাট অতিক্রম করে বর্তমানে উত্তর আফগানিস্তানের বক্ষ নদীর তীরে কুন্দুজ শহরে পৌছান। কিছুদিন আগেই এই কুন্দুজ খবরের শিরোনামে ছিলো তালিবানের হাতে প্রথম পতন হওয়া নগর হিসাবে।

বালখ প্রভিন্স
---------------

বালখ প্রভিন্সই মহাভারত বর্নিত প্রাচীন বহ্লিক দেশ। কিংবা গ্রীস নামে ব্যাক্ট্রিয়া। বর্তমানের মাজার-ই-শরিফ কে কেন্দ্র করেই অবস্থান এই প্রভিন্সের। হিউ-এন-সাঙের আগমনের সময় বালখ ছিলো এক উন্নত বৌদ্ধ জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র। এতোটাই উন্নত ছিলো যে তাকে রাজগৃহর সাথে তুলনা করা হতো। 
তিনি এখানে দেখেছিলেন অপূর্ব শৈলীর সুবিশাল সংঘরাম। আর কয়েক হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। ওনার বর্ননা অনুযায়ী এই সংঘরামে রক্ষিত ছিলো ভগবান বুদ্ধের দাঁত, চুল আর ব্যবহৃত একটা মাটির গ্লাস।
এছাড়া কিছু দূরে আরও দুটি বৌদ্ধ স্তুপ ছিলো যেটা ভগবান বুদ্ধের দেহাংশের উপর নির্মিত।
 

বামিয়ান
-------------

কিছুদিন বালখে থেকে তিনি আবার যাত্রা করলেন ভারত অভিমুখে। এবার সবচেয়ে কঠিন পথ। দূর্গম হিন্দুকুশ পর্বতমালা আর সংকীর্ণ গিরিপথ। তার মাঝে অবস্থান করছে এক মনোরম উপত্যকা। বামিয়ান। কিছুবছর আগেও ছিলো বৌদ্ধ স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। বামিয়ানের কথা আশা করি সবাই জানেন। তালিবানের হাতে ধ্বংস হয় সভ্যতার এক বিরল রূপ। বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি। 
হিউ-এন-সাঙ ওই সময় ওখানে দশটি সংঘরাম আর কয়েকহাজার ভিক্ষু দেখেছিলেন। অনেকেই ছিলেন শিল্পী। এই স্থানে এসে তিনি তিনটি মূর্তি দেখেন। ১৭৫ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তিটির স্থানীয় নাম ছিলো সলসল...পৃথিবীর আলো। তার পাশের গুহায় ছিলো ১০০ ফুট উঁচু সামামা অর্থাৎ বিশ্বজননী। কিন্তু তিনি আরেকটি ১০০০ ফুট উঁচু মহানির্বান বুদ্ধ মূর্তির উল্লেখ করে গেছেন, যার কোন অস্তিত্ব বর্তমান যুগের ঐতিহাসিকরা খুঁজে পান নি। প্রতিটি মূর্তিই ছিলো স্বর্ন, মুক্তো ও বিভিন্ন অলঙ্কারে সজ্জিত। 

কাপিসা ও গান্ধার
-------------------------

এর পর দীর্ঘ কঠিন পথ বেয়ে এর পর হিউ-এন-সাঙ পৌছান কপিসা নগরী। যা ততকালীন গান্ধার(বর্তমানের কান্দাহার) রাজ্যের অংশ ছিলো। এই কপিসা জনপদই ছিলো আফগান ভূমির শেষ অমুসলিম রাজ্য, যা প্রায় ১৮৯৬ অব্ধি প্রাচীন সংস্কৃতি ধরে রাখতে পেরেছিলো "কাফিরিস্থান" নামে। বর্তমান নাম নুরিস্থান।

হিউ-এন-সাঙের বর্ননা অনুযায়ী এই হিন্দুকুশের দক্ষিণ ঢালের কপিসা-গান্ধার থেকেই পবিত্র ভারতভূমির শুরু। তিনি মাথা ছুঁয়ে প্রনাম করেন সেই ভূমিকে। এ ভূমি তো ভগবান বুদ্ধের চরনধুলায় সিক্ত। কপিসাতেই তিনি প্রথম পরিচিতি লাভ করেন হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে.... তার ভাষায় ভারতের প্রাচীন ধর্ম। সেখানকার শাষক ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশজাত। তিনি অত্যন্ত পরধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন এবং সাদরে বরন করে নেন হিউ-এন-সাঙকে। এখানেই তিনি প্রথম দেখেন এক শৈব্য সম্প্রদায়ের নাগা সন্ন্যাসীকে। 

তিনি যদিও অনেক আশাহত হন। কারন তার আগমমেন দুশো বছর আগে হুন-তাতার গোষ্ঠীর আক্রমনে এই অঞ্চলের অনেক প্রাচীন মঠ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। অনেক রত্ন লুঠ হয়ে যায় বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার থেকে। যদিও তিনি ভগবান বুদ্ধের অস্থির উপর সম্রাট অশোক অথবা কনিষ্ক দ্বারা নির্মিত এক বৌদ্ধ স্তুপের দর্শন পেয়েছিলেন। এবং বর্তমানের পঞ্জশীর অঞ্চলে একটা বৌদ্ধ মন্দিরে অবস্থা করেছিলেন। 

এর পর হিউ-এন-সাঙ যেনো অদ্ভুত ভাবে ওই অঞ্চলের বৌদ্ধ মন্দির গুলোর সংস্কারে ব্রতী হয়ে পড়েন। বেশ কিছু লুকানো সম্পদ উদ্ধারের মজার গল্প আছে তার বিবরনীতে। স্থানীয় ভাষাও রপ্ত করেন।

এরপর তার বিবরন অনুযায়ী পাওয়া যায় আধুনা হারিয়ে যাওয়া অতীতের বিখ্যাত 'ছায়া গুহার" পথের বিবরন। তার যাত্রা পথের নানান ঘটনার কথা। কথিত, সেই ছায়া গুহায় পবিত্র আঁত্মার শ্রমনদের ভগবান বুদ্ধের ছায়া দর্শনের কথা। এই পবিত্র ছায়া গুহার কঠিন পথ সাফল্যর সাথে পেরিয়ে এসে বেশ কিছুদিন গান্ধারে ছিলেন। তারপর আরও পূর্বমূখী হয়ে যাত্রা করেন অতীতের পুরুষপুর বা বর্তমানের পাকিস্তানের পেশোয়ার।

হিউ-এন-সাঙ ব্যক্তিগত জ্ঞান অর্জনের জন্য এই যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু তিনি অজান্তেই তার বিবরনের মাধ্যমে কয়েক হাজার বছর পরেও মানুষদেরও অতীতের অলোকে উদ্ভাসিত করে দিয়ে গেছেন। অনেক অজানা ইতিহাসের স্বাক্ষী তার এই যাত্রা পথের বিবরনী।

(তথ্য ঋনঃ উইকিপিডিয়া, অমৃতপন্থঃ চঞ্চল কুমার ঘোষ)

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত