স্মৃতিতে অম্লান অধ্যক্ষ ওয়ালি-উল ইসলাম খান 

  মো. জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২১, ১০:৫০ |  আপডেট  : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:২০

১৯৮১ সালে শ্রীনগর কলেজের অধ্যক্ষ একেএম ওয়ালি-উল ইসলাম খান কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমেরিকা চলে যান। আমি তাঁদের রথ খোলার বাসা থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত গিয়ে ছিলাম বিদায় জানাতে। সেদিনের মতো মন খারাপ আগে খুব কমই হয়েছে। তাঁর শ্রীনগরের জগত অন্ধকার করে এত দূরে চলে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারিনি। তিনি চোখের আড়ালে চলে গেলেও কখনও আমরা একে অপরের মনের আড়াল হইনি।  শুরুতে চিঠিতে ও পরে ফোনে আমাদের যোগাযোগ হতো নিয়মিত।

তিনি প্রথমে লসএঞ্জেলেস-এ যান। সেখানে বেশ কয়েক বছর ছিলেন। পরে আটলান্টার জর্জিয়াতে সেটেল্ড হন।

সর্বশেষ তিনি আমাকে ফোন করেন ২৩ মে। অনেকÿন কথা হয়। ফোন করেছিলেন তাঁর দোকান থেকে। সেদিন তাঁকে খুব প্রাণবন্ত মনে হয়েছিল। হয়তো শেষ কথা ছিল বলে। এর দুদিন পরে তিনি পায়ের অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তির কথা জানান। বললেন ‘সবাইকে বলো যেন আমার জন্য দোয়া করেন’। বিশেষ করে আমার মা’র  দোয়া বেশি করে চান।

এটাই তাঁর সাথে আমার শেষ কথা হবে ভাবিনি । এর আগেও তাঁর হার্টের চিকিৎসা হয়েছে। এবারে হবে হার্ট রিলেটেড পায়ের রগে ।বন্ধু আনোয়ার ভূঁইয়ারও এ অপারেশন হয়েছে দেশে। সে এখন ভালো আছে। অপারেশন শেষে স্যারও বাসায় চলে এসেছিলেন। বাসায় আসার পরে  পেটে সমস্যা হয়। যার ফলে আবার হাসপাতাল। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেন বড় ধরনের স্ট্রোক হয়েছে- যার দরুন তাঁর জ্ঞান নেই। হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন ১১ জুন পর্যন্ত। ২৯ মে লাইফ সাপোর্টের খবর জানান এনামুল ইসলাম খান। খবর  জেনে আমিতো স্তম্ভিত। যা কল্পনার কিছু ঘটলে যা হয়, আমার অবস্থা তেমনি। সাথে সাথে ফেসবুকে লিখে ও টেলিফোনে সবাইকে জানালাম। সবাইকে দোয়া করতে বলি। ৪ জুন শুক্রবার শ্রীনগর,লৌহজং ও সিরাজদিখানের বিভিন্ন মসজিদে তাঁর আরোগ্য কামনা করে জুম্মা নামাজের পরে দোয়া করার ব্যবস্থা করে তাঁর ছাত্ররা।

স্যারের একমাত্র সন্তান কীমতি খানের ফেসবুক মন্তব্য থেকে জানতে পারি তাঁর জ্ঞান ফেরেনি। চোখের পাতা খোলা দেখে কীমতি ভেবেছিল ওর ডাক শুনতে পাবে। কিন্তু চেতনা আর ফিরেনি। এর পরে কয়েকদিন কোনো খবর আর পাইনি। অনুজ প্রতীম সৈয়দ ইফতেখারুল আলম টিটোকে বলি কোন খবর পেলে জানাতে। ঠান্ডু চৌধুরীকে ফোন করে জানি সর্বশেষ খবর। হাসপাতাল কতৃপক্ষ পরিবারের সিদ্ধান্ত চেয়েছে লাইফ সাপোর্ট কন্টিনিউ রাখবে, না খুলে ফেলবে।  এর অর্থ হলো বাঁচার সম্ভাবনা নেই।

১১জুন সাড়ে ১২ টার দিকে নাসির উদ্দিন এলান ফোন করে জানায়, লাইফ সাপোর্ট খুলে লালনের অচিন পাখিকে খাঁচা  ছেড়ে চলে যাবার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এমন খবরের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম। তবু মন কি মানতে চায়! ফেসবুকে লিখে ফোন করে সবাইকে জানালাম তাঁর মহাপ্রস্থানের খবর।

১৯৭০ সালে তাঁকে প্রথম দেখি। ওয়াজিউল্লাহ স্যার পরিচয় করিয়ে দেন। শ্রীনগর কলেজে তিনি আমাদের ইতিহাস পড়াাতেন। খুবই নিরীহ ছিলেন। কথাবার্তা খুব কম বলতেন। অধ্যাপক আবদুর রশিদ স্যার প্রিন্সিপাল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমরা সব ছাত্র নৌকার পক্ষে। ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ পৌরনীত পড়াাতে এসে আবদুর রউফ খান জানান, ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছে।  স্যার খবরটি দিলেন- তিনি ভাবতে পারেননি এর প্রতিক্রিয়া কী হবে।  আমরা সাথে সাথে ‘ইয়াহিয়ার ঘোষনা- মানি মানি মানি না’ স্রোগান দিয়ে ক্লাসরুম থেকে বাইরে চলে আসি। আমাদের স্রোগান শুনে বানিজ্য বিভাগের ছাত্ররাও চলে আসে। মিছিল নিয়ে শ্রীনগর স্কুল ,বাজার ঘুরে আবার কলেজে এসে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আর কলেজ নয়। দেশ স্বাধীন করেই ক্লাস করবো।

এর পর মুক্তিযাদ্ধা হিসেবে অস্ত্র হাতে কলেজে আসি ১৯৭১ সালে বিজয়ের পর। বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে কলেজে যাই পড়াশোনা করতে। শ্রীনগর কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তৎকালিন স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে। তারা কলেজটির নাম দিয়েছিলেন, মোয়েমখান কলেজ। ’৬৯-এর গণঅভ্যত্থানে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর সম্থানীয় জনগণ কলেজটির নামকরণ করে ‘শ্রীনগর কলেজ’। স্বাধীনতার পর কলেজের দায়িত্ব নেন আওয়ামী লীগের গণপরিষদ সদস্য শাহ মোয়াজ্জেম  হোসেন।

তিনি  চেয়ারম্যান হয়ে কলেজের এডহক কমিট করেন। আমার প্রস্তাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আ ন হামিদ উল্লাহকে সদস্য করা হয়। তিনি প্রথমে কলেজের স্বীকৃতির উদ্যোগ নেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিধান মতে কলেজের পূর্ণকালীন অধ্যক্ষ ছাড়া স্বীকৃতি সম্ভব নয়। রশিদ স্যার ঢাকা কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। সরকারি চাকরি ছাড়া  তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। অধ্যক্ষ করার ব্যাপারে আমার মতামত চাওয়া হলে আমি রউফ খানের নাম বলি। তিনি সম্মত না হওয়ায় ওয়ালি-উল ইসলাম খানের নাম বলি। অপর একজন শিক্ষক তাঁকে মুসলিম লীগ পরিবারের  লোক বলে পানি ঘোলা করতে চায়। কিন্তু আমরা তাতে কান দিইনি। আমরা বলেছি, ঐ পরিবারের একজন মুক্তিযুদ্ধে ভারপ্রাপ্ত  সেক্টর কমান্ডার ও একজন শ্রীনগর থানা কমান্ডার ছিলেন। ওয়ালি-উল ইসলাম স্যার কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন।

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে শ্রীনগর কলেজের নব গতিতে যাত্রা শুরু হয়। নানাভাবে তিনি কলেজের তহবিল বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন। প্রতি পাসপোর্ট ফরমে এমসিএর স্বাক্ষর পেতে শ্রীনগর কলেজে ১০ টাকা জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করেন। দেউলভোগ গরুর হাটের খাজনা সরকারিভাবে নিলাম রহিত করে বঙ্গবন্ধুর পুরো শাসনামলে তা শ্রীনগর কলেজ ফান্ডে জমার ব্যবস্থা করেন। যা বাংলাদেশের অন্য কোথাও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। প্রশাসন থেকে তৎকালীন রাজস্বমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে জানানো হয়। তিনি এ ব্যাপারে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে ফোন করেন। মন্ত্রী মহোদয়কে তিনি বলেন, ‘ধরে নেন দেউলভোগ গরুর হাট বলে কোনো হাট নেই। ঐ হাটের খাজনা না পেলে বাংলাদেশ সরকারের তেমন ক্ষতি হবে না। কিন্তু আমার কলেজটি নিজের পায়ে দাঁডিয়ে যাবে।’  মন্ত্রীর সাথে কথা বলার সময় প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে আমিও মোয়াজ্জম ভাইয়ের ২ নং মিন্টু রোডের সরকারি বাসভবনে উপস্থিত ছিলাম।

সম্ভবত ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ছাত্র সংসদের নির্বাচন করে আমি ভিপি ও আনোয়ার জিএস হয়। প্রতি মঙ্গলবার প্রন্সিপাল স্যারের সাথে আমরা দেউলভোগ গরুর হাটে যেতাম। যাতে টাকা যথাযথভাবে কলেজ ফান্ডে জমা হয় তা তদারক করতে। এ ছাড়াও কলেজ -স্কুলের জন্য শ্রীনগর ল ঘাট ডাক আনা ও প্রতি বছর আষাঢ় মাসে রথমেলা উপলক্ষে শ্রীনগর হাই স্কুল প্রাঙ্গনে মাসব্যাপি যাত্রা গানের আয়োজন করা হতো। এসব কাজে শ্রীনগরের ব্যবসায়ী, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করেছেন। এসব কাজে ছাত্রনেতা হিসেবে প্রিন্সিপাল স্যার সর্বদা আমাদের সমর্থন পেয়েছেন।

১৯৭২ সালের জুন মাসে শিক্ষা মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী চৌধুরী,তথ্য ও বেতার মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীকে নিয়ে মোয়াজ্জেম ভাই শ্রীনগর কলেজে আসেন। আমি দাবি দাওয়া  পেশ করি। শিক্ষা মন্ত্রী সব দাবি মেনে নেন।বিকেলে হয় থানা আওয়ামী লীগের উদ্যেগে শ্রীনগর খেলার মাঠে (বর্তমানে শ্রীনগর স্টেডিয়াম) স্মরণকালের বৃহৎ জনসভা। এ সভার ম  ১০/১২ টি তোরণ নির্মানে আমাদের সর্বদা পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকগণ। তোরণ ও ম  নির্মানে আর্টিস্ট  মোস্তফা কামাল (জি এম কামাল) ও বিশ্বনাথ পোদ্দার দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন। ম  নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক বিশেষ প্রতিবেদন ছাপে।

১৯৭২ সালে আমরা শ্রীনগরে এস এস সি পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যেগ নিই। দরখাস্ত আমি ড্রাফট করে মাশুরগার সিরাজুল ইসলাম ঢালী (পরে কৃষি ব্যাংকের জিএম) ভাইয়ের হাতে লিখে তা চূড়াান্ত করি। ১ নং আবেদনকারী হন শ্রীনগর কলেজের অধ্যক্ষ একেএম ওয়ালি-উল ইসলাম খান। থানার সব হাই স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষকদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করি। জাতীয় সংসদের তৎকালীন চীফ হুইপ শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেনের সুপারিশে মুন্সিগঞ্জের বাইরে ১৯৭২ সালে শ্রীনগরে এসএসসি, ১৯৭৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। আগে জুনিয়র বৃত্তি থেকে ডিগ্রী পরীক্ষা পর্যন্ত সব পরীক্ষা মুন্সীগঞ্জ গিয়ে দিতে হতো। এভাবে স্বাধীনতার পরে তিল তিল করে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে শ্রীনগরের উন্নয়ন হয়েছে।

১৯৭৪ সালে শ্রীনগর কলেজের অধ্যক্ষ একেএম ওয়ালি উল ইসলাম খানকে সভাপতি, শ্রীনগর হাই স্কুলের সহকারি শিক্ষক মোহাম্মদ ওয়াজি উল্লাহকে সম্পাদক ও আমাকে যুগ্ম সম্পাদক করে শ্রীনগরে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাংগঠনিক কমিটি করা হয়। ওয়াজি উল্লাহ স্যার স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল হাই খানকে রাজি করান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস করার উপযোগী ঘর করে দেয়ার জন্য। যা বর্তমানে শ্রীনগর সুফিয়া হাই খান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।

কলেজের উত্তর-পূর্ব দিকে এল টাইপের ঘর নির্মাণের জন্য যাই কাঠ কিনতে প্রিন্সিপাল স্যার আমাদেরকে নিয়ে যান লৌহজং-এ । তাঁকে দেখেছি দরাদরি করে যতটা সাশ্রয় করা যায় তা করেছেন। কলেঝে বিজ্ঞান  বিভাগ খোলার পরে বিজ্ঞানাগারের জন্য কিছু এ্যাপারেটাস ও কেমিক্যাল কিনতে হাটখোলার এক দোকানে যাই। মেমো লেখার আগে বিক্রেতা কত টাকা লেখবে জানতে চায়। স্যার বলেন ,এটা জিজ্ঞাসা করলেন কেন? যত টাকা দাম তাই লিখবেন।’

বঙ্গবন্ধুর আমলে ভারত সরকার বাংলাদেশের ১০০ কলেজকে বই উপহার দেয়। পোলান্ড সরকার ১০০ কলেজকে বিজ্ঞানাগারের যন্ত্রপাতি দেয়। শ্রীনগর কলেজ বই ও যন্ত্রপাতি পায়। এটা সম্ভব হয়েছিল চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও ডঃ এম এ নাসেরের (বুয়েটের ভিসি) প্রচেষ্টায়। বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি আনতে তাঁর সাথে আমি ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম যাই। সেটাই ছিল আমার প্রথম চট্টগ্রাম যাওয়া ও প্রথম ট্র্রেনজার্নি। সিদ্দিকও সাথে ছিল। হোটেল শাহজাহানে আমরা রাতে থাকি। তখন চট্টগ্রামে একটি আসনে উপ-নির্বাচন হচ্ছিল। আমি যেহেতু কলেজের ভিপি, তাই প্রিন্সিপাল স্যার রাতে আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে একা পৃথক রুমে ঘুমাতে দেননি। তাঁর রুমে আমাকে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেন।

তিনি শুধু কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের মধ্যে নিজেকে সীমাব রাখেন নি। খেলাধূলা, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, টেলিফোন, বিদ্যুৎ লাইন সংযোজনেও তাঁর ভূমিকা ছিল। মুন্সিগঞ্জের এসডিও হালিম সাহেবসহ সব ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীনগর ট্যুরে এলে তাঁরা ডাকবাংলোয় না উঠে কলেজের প্রিন্সিপালের বাসায় থাকতেন। কলেজের বা শ্রীনগরের অন্য কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে আসা অতিথিরাও তাঁর বাসায় রাত্রি যাপন করতেন। প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল কাশেম ফজলুল হক, সাইদুর রহমান,  হূমায়ুন আজাদ, রনেশ দাশগুপ্তসহ মন্ত্রীগন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁর বাসায় আতিথ্য গ্রহন করেছেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মোয়াজ্জেম ভাইও প্রিন্সপাল স্যারের বাসায় থাকার স্মৃতি চারণ করেন।

বর্তমান আমলের এমপিদের মতো বঙ্গবন্ধুর আমলের এমপিরা এলাকার সব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতেন না। বলে দিতেন প্রন্সিপাল সাহেবকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে। আমরা স্যারের সাথে থানার হাই স্কুলসমূহের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম।

আমার মনে আছে ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে শ্রীনগর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে আওয়ামী লীগের থানা কমিটির সাধারন সম্পাদক আবদুর রশিদ মিয়াকে উগ্রপন্থিরা হত্যার সময় আমি প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে অগ্রনী ব্যাংকে ছিলাম। খবরটি পাবার পর তিনি আমাকে নিয়ে বন্যার পানি ভেঙে দ্রুত কলেজ কোয়ার্টারে চলে আসেন, যাতে আমার কোন বিপদ না হয়।

মোয়াজ্জেম ভাই চেয়েছিলেন আমি তাঁর বাসায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ অনার্স,এমএ, ল পড়ে রাজনীতি করব। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হানাহানি চলছিল। একদিন স্যার আমাকে নিরিবিলি স্থানে ডেকে নিয়ে জানতে চান ভবিষ্যতে আমি কী হতে চাই। আমি বলি লেখাপড়ার পরে চাকরি করবো। তিনি বলেন, তাহলে তোমার অনার্স পড়ার প্রয়োজন নেই। সেশন জটে বিএ অনার্সের রেজাল্ট পেতে ৪/৫ বছর লেগে যাবে। তুমি পাস কোর্সে শ্রীনগর কলেজে ভর্তি হলে আমরা ডিগ্রী কোর্স চালু করতে পারবো। ২ বছরে গ্রাজুয়েট হয়ে অফিসার পদে যোগ দিতে পারবে। আমি তাই করি।

১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বিএ পরীক্ষা দিয়ে ৪% পাসের হারে ১৯৭৬ সালে বিএ পাস করে আমি অর্থনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ভর্তি হই। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি যাই। এ সময়ে পত্রিকায় রাষ্টায়ত্ব ব্যাংকে ৫ম ও ৬ষ্ঠ গ্রেডে অফিসার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে তিনি আমাকে দরখাস্ত করতে বলেন। আমি এমএ শেষ করে চাকরিতে যাওয়ার কথা বললে তিনি বলেন, “আমি কোন কিছু শুনতে চাই না ।আজই তুমি দরখাস্ত করবা”। তাঁর কথা মেনে দরখাস্ত করি । লিখিত, ভাইবা দিয়ে ৫ম গ্রেডে স্থান পাই। নিয়োগপত্র পেয়ে আমি শ্রীনগরে ঘুরাঘুরি করে সময় কাটাচ্ছি দেখে তিনি আমাকে বলেন, তুমি চাকরিতে যোগদান করছ না কেন? আমি বলি, স্যার ৩০ তারিখ পর্যন্ত সময় আছে। তিনি বলেন ,কাল গিয়ে যোগদান কর। আগে যোগ দিলে তুমি সিনিয়র হবে। আমি তো এসব জানতাম না। কারন আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে আমিই প্রথম গ্রাজুয়েট এবং প্রথম অফিসার। আর স্যারের বাবা,চাচা,মামা,নানা সবাই ছিলেন উচ্চ পদস্থ অফিসার।

আমি ১৯ তারিখে ঢাকা গিয়ে ২০-০৮-১৯৭৭ তারিখে কৃষি ব্যাংকে যোগদান করি। তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক,বন্ধু,শুভাকাক্সিক্ষ ও অভিবাবক। তাঁর পরামর্শ মতো চলে জীবনে পূর্ণতা পেয়েছি।

আমি ছিলাম তাঁর পরিবারেরই একজন সদস্য। স্যারের বাবা ,চাচা,মামাদের মতো ভদ্র,শিক্ষিত মানুষ বিক্রমপুরে কমই আছে। একমাত্র ষোলঘরের ডঃ এ আর খানদের পরিবারও এদিক দিয়ে একটি অগ্রসর পরিবার। স্যারের মা আমাকে নিজের ছেলের মতোই জানতেন।
আমেরিকা যাওয়ার পরেও তাঁর আমার যোগাযোগ একটুও হ্রাস পায়নি। তাঁর মাধ্যমে লসএঞ্জেলেস ও জর্জিয়ায় বসবাসরত বাঙালিরা সবাই আমাকে নামে চিনেন। তাঁর মৃত্যু আমার জন্য অতি আপনজন হারানোর মতো।এখনও বিশ্বাস হতে চায় না যে তিনি নেই।

আসলে তিনি শ্রীনগরকে কখনও ভুলতে পারেননি। ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট তিনি স্বপরিবারে শ্রীনগর গেলে ছাত্র,অভিবাকরা জডিয়ে ধরে সে কি কান্না! কলেজের সম্বর্ধনা ,শাহআলমের ময়ূরপক্সিখতে নৌভ্রমন ও লা সহ সবকিছু দেখে স্যারের মেয়ে জর্জিয়া ফিরে গিয়ে বলেছে,‘শ্রীনগর গিয়ে বুঝতে পারলাম আব্বু খালি কেন শ্রীনগর শ্রীনগর করে”।

সব মৃত্যুই বেদনার। একেএম ওয়ালিউল ইসলাম খান-এর মৃত্যু তাঁর প্রতিটি পরিচিতজনের কাছে অনেক বেদনার। তিনি মানুষকে ভালবেসেছেন- মানুষও তাঁকে ভালবাসতো। আমাদের কাছে তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, চেতনায়। শ্রীনগর কলেজের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন চিরদিন।

তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুন।

লেখক:  বীর মুক্তিযোদ্ধা, পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. সাবেক ভিপি শ্রীনগর কলেজ ছাত্র সংসদ, সাবেক ডিএমডি, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক লি.।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত