স্বতন্ত্র গদ্যশৈলীর জন্য তিনি সুপরিচিত অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২২, ১১:৫৬ | আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:০৪
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত (৬ অক্টোবর ১৯৩৩ — ১৭ নভেম্বর ২০২০) একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক। রচনার প্রাচুর্য এবং বৈচিত্র্যে,মনীষা এবং সংবেদনশীলতায় তিনি বাংলাসাহিত্যের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তিনি ২০টিরও বেশি কবিতার বই লিখেছেন, বাংলা এবং সাঁওতালি কবিতা ও নাটক ইংরেজি এবং জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছেন, এবং জার্মান ও ফরাসি সাহিত্য থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তিনি বেশ কয়েকটি বই প্রবন্ধের প্রকাশ করেছেন। তার স্বতন্ত্র গদ্যশৈলীর জন্য তিনি সুপরিচিত।
দাশগুপ্ত শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করেছেন, ও তারপরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে, প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েন এবং অবশেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ভারতীয় কবিতায় গীতি নিয়ে তার পড়াশুনার জন্য পিএইচডিপ্রাপ্ত হন। তিনি লিটল ম্যাগাজিনসমূহের সাথে ভীষণভাবে যুক্ত হয়ে মূল জার্মান কাজগুলিকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে থাকেন।
তার পিএইচডি শেষ করার পরে, দাশগুপ্ত ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে [বুদ্ধদেব বসু প্রতিষ্ঠিত] তুলনামূলক সাহিত্য ও বাংলা পড়িয়েছিলেন। এরপরে তিনি হাম্বোলড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপে জার্মানি যান। ১৯৭১ সাল থেকে তিনি জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ইনসিটিটিউট অনুষদে শিক্ষকতা করছেন। তিনি ভারত ও জার্মানির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ প্রচারের জন্য প্রধান একটি প্রতিষ্ঠান, ডয়চে-ইন্দিসচে গেসেলশ্যাফ্টের [ডিআইজি] সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
দাশগুপ্ত এমন একজন কবি, যিনি তার সহকর্মী এবং ভক্তদের দ্বারা অনেক প্রশংসিত, তার কবিতা মূলভাব এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের জন্য পরিচিত। জার্মান সরকার তাঁকে গ্যোটে পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে দুটি ভিন্ন সংস্কৃতিকে একত্রিত করার কাজে তার অবদানের জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছে। তার ছন্দনৈপুণ্য ভাষার কারুকার্য যেমন কাব্য-অবয়বকে একটি স্বকীয়তা দিয়েছে তেমনই বৈদগ্ধ্য বিপ্লবমনস্কতা এবং ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কারের ক্ষমতা তার কাব্য জগতকে দিয়েছে বিশালতা এবং নান্দনিক সৌন্দর্য। এরপর তিনি যে প্রবন্ধ রচনা করেছেন ও জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন সেখানে তার ভাষান্তর কুশলতা বাংলা সাহিত্যে বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। তার নিজস্ব গদ্যরীতি বর্ণাঢ়্য, প্রতিমাবহুল এবং শব্দের নবায়নে চিহ্নিত।
১৩৬৬ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংক্রান্তির দিন প্রকাশিত হয় অলোকরঞ্জনের প্রথম কবিতাগ্রন্থ যৌবন বাউল। অর্থাৎ আজ থেকে ষাট বছরেরও বেশি আগে। সে-কাব্যগ্রন্থকে বাংলার কবিতাসমাজ অত্যন্ত সমাদরে বরণ করে নেয়। কিন্তু সেই গ্রন্থ প্রকাশের আগেই অলোকরঞ্জনের কবিতাকে বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায় নিয়মিত ছাপতে শুরু করে দিয়েছেন। পাশাপাশি তরুণ কবিদের প্রধান মুখপত্র কৃত্তিবাস পত্রিকার সম্পাদক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অলোকরঞ্জনের উপস্থিতি অবধারিত করে তুলেছেন কৃত্তিবাস-এ. শতভিষা কবিতাপত্রের কর্ণধার কবি আলোক সরকার প্রায় প্রতি সংখ্যায় গ্রহণ করতে শুরু করেছেন অলোকরঞ্জনের কবিতাকে। যৌবন বাউল প্রকাশিত হওয়ার প্রায় সাতবছর আগে দেশ পত্রিকার প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক সাগরময় ঘোষ দেশ পত্রিকা-এরর পাতায় কবিতা লিখতে আহ্বান করেন অলোকরঞ্জনকে। ১৯৫৪ সালের পুজো সংখ্যা দেশ-এ একুশ বছরের যুবক অলোকরঞ্জন তাঁর কবিতায় লেখেন এমন একটি লাইন: "বৃষ্টি তার চরণের স্বরলিপি অবিকল জানে' এই লাইনটিতে আমরা 'র' বর্ণের এবং 'ন' বর্ণের আশ্চর্য বণ্টনের অনুপ্রাস দেখে বিস্মিত হয়ে যাই। এই অলোকরঞ্জনই পরিণত বয়সে লিখবেন এইরকম লাইন: 'তিসিবনে একা শিশু ভেসে আছে নিশুতি উদাস'— তখন আবার আমরা বিস্মিত হব 'স' ধ্বনির অপরূপ বিতরণের ক্ষমতায়। যেন তিসিবনের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ফিসফিসে এক বাতাসের স্বর আমরা শুনতে পেলাম। ধ্বনিকে সারাজীবন অলোকরঞ্জনের কবিতায় আমরা বিভিন্নভাবে নতুন করে আবিষ্কার করব। বাংলা কবিতাজগৎ অলোকরঞ্জনের প্রথম যৌবন থেকে সাতাশি বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ-মুহূর্ত পর্যন্ত যে-সম্মানের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল তাঁর লিখনীকে, তার নানাবিধ কারণ আছে। এর দু-একটি কারণকে মাত্র ছুঁয়ে যাব এ-লেখায়।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত