সেনদিয়া গণহত্যা দিবস বুধবার: স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে নির্মিত হচ্ছে শহীদ স্মৃতিসৌধ
প্রকাশ: ১৮ মে ২০২১, ১৯:৩০ | আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:০৮
বুধবার (৫ জ্যৈষ্ঠ) ১৯ মে সেনদিয়া গণহত্যা দিবস। একাত্তরের এইদিনে রাজৈরে খালিয়ার সেনদিয়া, পলিতা, ছাতিয়ানবাড়ী ও খালিয়া গ্রামের দেড় শতাধিক মুক্তিকামী মানুষ জীবন রক্ষা করতে আশপাশের আখ ক্ষেত ও ঝোপ-জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। পাকি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামস বাহিনী ব্রাশ ফায়ার করে তাদের হত্যা করে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে সরকারিভাবে সেনদিয়ায় স্মৃতিসৌধ নির্মিত হচ্ছে। দীর্ঘ ৫০ বছর পর হলেও খুশি শহীদ পরিবারের স্বজন, মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়রা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ১৯ মে বাংলা ৫ জ্যৈষ্ঠ বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ চালায় হানাদার বাহিনী। ওইদিন তারা টেকেরহাট ক্যাম্প থেকে লঞ্চ যোগে গোপালগঞ্জ জেলার ভেন্নাবাড়ী ঘাটে নেমে চরচামটা থেকে সংখ্যালগু এলাকায় নির্বিচারে গুলি বর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। সেখান থেকে পাকিরা তাদের দোসরদের সহযোগিতায় নৌপথে গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর হয়ে রাজৈরের কদমবাড়ী এলাকায় গান বোট থেকে নেমে সড়ক পথে বাড়ী-ঘরে অগ্নিসংযোগ করে আসছে এমন খবর পেয়ে খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া, পলিতা, খালিয়া ও ছাতিয়ান বাড়ী এলাকার হাজার হাজার নিরীহ জনগণ আখ ক্ষেতসহ বিভিন্ন ঝোপ-জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। যারা বাড়ী ঘর ছেড়ে পালাতে পারেনি তাদেরকে ধরে নিয়ে পশ্চিম সেনদিয়া ফকিরবাড়ির ভিটায়, সেনদিয়া বাওয়ালী ভিটায়, বারিকদার বাড়ীর উত্তর বাঁশ বাগানে, শচীন বারিকদারের বাড়ির দক্ষিণ খালপাড় এবং ছাতিয়ানবাড়ির পুকুর পাড়ে। কারো চোখ বেঁধে, কারো হাত-পা বেঁধে, বাবা-মায়ের সামনে সন্তানকে, সন্তানের সামনে বাবা-মাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। কাউকে বুটজুতোয় থেতলে ক্ষত-বিক্ষত করে আগুনে পুড়িয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। অনেককে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। দীর্ঘ সময় এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে নরপিশাচরা ফেরার পথে পশ্চিম সেনদিয়া গ্রাম দিয়ে যেতেই আখ ক্ষেতে মানুষের শব্দ পেয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। নিমিষেই প্রাণ হারায় শতাধিক মানুষ। পাকি বাহিনীর দোসররা আখক্ষেত এবং ঝোপ-জঙ্গলে তলাসী চালিয়ে মাটির গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ও ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে ৬টি স্পটে পালিয়ে থাকা মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। নারকীয় এ তান্ডব শেষে পাকি ও তাদের দোসররা চলে যাবার পর গ্রামের লোকজন ও আত্মীয় স্বজন এসে ঝোপ জঙ্গল এবং আখ ক্ষেত থেকে লাশ উদ্ধার করে খালের পাশে ৬ স্থানে মাটি চাপা দেয়।
সেদিনের ঘটনায় প্রায় দেড়‘শ নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় এবং গুরুতর আহত হয় অনেকেই। আহতদের অনেকেই এখনও ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এরপর কেটে গেছে ৪৯ বছর। এবছর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে গণসমাধীস্থলে শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ৩৪ লাখ ৯৯হাজার ৯৮২ টাকা বরাদ্ধ দেয়। স্মৃতিসৌধের ৬০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এতে নতুন প্রজম্ম পাকি বাহিনী ও তাদের দোসররদের নারকীয় ঘটনার স্মৃতি বুকে ধারণ করে জানতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী সেনদিয়া গ্রামের শচীন বারিকদারের সাথে কথা বলে জানা গেছে পাকি বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্মমতার এ কাহিনী।
সেদিনের ঘটনায় শিকারী বাড়ীর পরান শিকারী, স্ত্রী সুরধনী শিকারী, ছেলে পুলিন শিকারী ও মেয়ে মধুমালা শিকারীকে হত্যা করা হয়। মা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলে ৪ মাসের শিশু প্রভাষ শিকারী মায়ের কোল থেকে ছিটকে খালের কচুরীপানার উপর পড়ে থাকে। এলাকাবাসী তাদের স্বজনদের লাশ খুঁজতে গিয়ে খালের কচুরিপানার উপর রক্তাক্ত শিশুর কান্না শুনতে পায়। বাবা-মায়ের আদরের পুত্র প্রভাষ শিকারীকে উদ্ধার করা হয়। তার কান্না থামানোর চেষ্টা করেও কান্না থামানো যাচ্ছিলো না। এ পরিস্থিতিতে শিশু প্রভাষকে তুলে দেওয়া হয় পার্শ্ববর্তী বিরজনী বাড়ৈর হাতে। বিরজনী নিজ সন্তানের মৃত্যু জ্বালা কিছুটা লাঘব করতে চেয়েছিলেন প্রভাষকে ঘিরে। কিন্তু প্রভাষের বুক ফাটা কান্নায় বিরজনী তাকে ফিরিয়ে দেয় তার বোন ফুলমালার কাছে। ফুলমালা তার আদরের ভাইকে আদর যতেœ বড় করে তুলতে তুলে দেন মুকসুদপুরের খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের হাতে। বহু মায়ের কোল রদবদল করতে হয়েছে প্রভাষকে। খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের আদর যতেœ বড় হওয়া প্রভাষ শিকারীর নামকরণ রাখা হয় মোশি বাড়ৈ। পিতা-মাতা ও ভাই-বোনকে হারিয়ে খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের আশ্রয়ে বড় হয়ে মোশি বাড়ৈ বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করছেন। পাকি বাহিনীর হাতে সেনদিয়া, পলিতা, ছাতিয়ানবাড়ী ও খালিয়ার শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে মোশী বাড়ৈর প্রচেষ্টায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া কোন সরকারই এ পর্যন্ত শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ না করায় এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মোশী বাড়ৈ ও তার সহধর্মিনী দীপা বাড়ৈর অর্থায়নে এবং গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বানিয়ারচরের শিক্ষক মাইকেল বাড়ৈর সার্বিক সহযোগিতায় ও ড. অরুণ কুমার গোস্বামীর সম্পাদনায় ২০০৯ সালের ১৪ এপ্রিল শহীদ স্মৃতি সেনদিয়া নামে একটি স্মরণিকা বের করা হয়। একাত্তরের ৫ জ্যৈষ্ঠ যারা পাকি বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলেন স্মরণিকায় তাদের ১২৬ জনের নাম উলেখ করা হয়েছে। শহীদ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাদার মারিনো রিগন।
সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান খান এমপি ২০১৪ সালের ১৭ মে রাজৈর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপনকালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদর আলসামসদের হাতে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে মাদারীপুরে ১০ বদ্ধভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার ঘোষনা দেন। এর মধ্যে রয়েছে রাজৈরে ৬টি ও মাদারীপুরে ৪টি। তার ওই ঘোষনার ৬ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় রাজৈরে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি যাদুঘর ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য ৪টি স্থানে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৪ টাকা বরাদ্ধ দেয়। এর মধ্যে খালিয়ার সেনদিয়ায় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য বরাদ্ধ দেওয়া হয় ৩৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯৮২টাকা।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাজৈর উপজেলা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সেকান্দার আলী শেখ বলেন, ‘হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে খালিয়ার সেনদিয়া, পলিতা, ছাতিয়ানবাড়ী ও খালিয়া গ্রামের দেড় শতাধিক মানুষ শহীদ হয়। হত্যার পর লাশগুলো ৬টি স্থানে গণকবর দিয়ে রাখা হয়। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের পক্ষ থেকে গণকবরগুলো চিহ্নিত করার জন্য একাধিকবার লোক এসে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জায়গা নির্ধারণ করে। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে সেনদিয়ায় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্ধ করা হয়। এতে শহীদদের স্বজন, এলাকাবাসী ও মুক্তিযোদ্ধারা খুশি।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন খলিল বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খান বলেন, ‘মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনী রাজৈর উপজেলার সেনদিয়া ৫ জৈষ্ঠ্য ১২৫-১৩০জন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তাদের স্মৃতি সংরক্ষণে জন্য বর্তমান সরকার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করছেন। আমি আশাকরি হানাদার বাহিনী যাদের হত্যা করেছিল তাদের নাম স্মৃতিসৌধে সংরক্ষণ করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ করছি।’
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘১৯ মে, ৫ জ্যৈষ্ঠ রাজৈরের খালিয়া ইউনিয়নে যে গণহত্যা হয়েছে, আমার জানা মতে সেখানে একদিনে ১৩১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। সেনদিয়ায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হচ্ছে। যারা মারা গেছেন, যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, শহীদ হয়েছেন তাদের নামফলক এই স্মৃতিসৌধে লিখে দেওয়া হবে।’
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত