সুন্দরবনের খাঁটি মধুর মোড়কে চিনি মেশানো মধু, প্রতারিত হচ্ছে পর্যটকসহ সাধারন মানুষ

  বাগেরহাট প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২১, ২০:০১ |  আপডেট  : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৭

সুন্দরবনের খাঁটি মধুর কদর দেশজোড়া। সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা উপজেলাসহ আশপাশের এলাকায় সুন্দরবনের খাঁটি মধুর নামে চলছে ভেজাল মধুর ব্যবসা। এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ী চক্র অতি মুনাফার আশায় সুন্দরবন থেকে সংগৃহীত মধুতে ভেজাল দিয়ে বাজারে তা উচ্চদামে বিক্রি করছে। ভেজাল মধু শনাক্ত করার সাধারণত কোন উপায় না থাকায় দেশী-বিদেশী পর্যটকসহ ক্রেতা সাধারণ তা কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর এপ্রিল ও মে মাসে বনবিভাগের রাজস্ব প্রদান সাপেক্ষে মৌয়ালরা সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহের অনুমতি পায়। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থ বছরে পুর্ব বন বিভাগ থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছে এক হাজার ৪৪ কুইন্টাল আর মোম উৎপাদন হয়েছে ৩১৩. ২০ কুইন্টাল। এ দুইটি মিলিয়ে রাজস্ব আয় হয়েছে ১০ লক্ষ ৯৬ হাজার ২শ টাকা। এর এক বছর আগে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে সুন্দরবন থেকে ১ হাজার ২‘শ ২০ কুইন্টাল মধু আহরণ করেছেন মৌয়ালরা। মধু আহরণ মৌশুমে বৃস্টি না হওয়ায় গত অর্থ বছরের তুলনায় এবছর ১৭৬ কুইন্টাল মধু কম সংগ্রহ হয়েছে। কিন্ত গত ২০১৮-১৯’র চেয়ে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৪‘শ ৭৮ কুইন্টাল মধু বেশি উৎপাদিত হয়েছিল। তবে মধু ও মোম থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে গত বছরের চেয়ে বেশী বলে জানায় বিভাগীয় বন কর্মকর্তা। এই মধু আহরণ মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ার পর পরই এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চক্র মধুতে ভেজাল দিয়ে বাজার ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সুন্দরবনের খাঁটি মধুর মোড়ক লাগিয়ে বিক্রী করা শুরু করে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, অসাধু ব্যবসায়ী চক্রটি সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই মৌয়ালদের মোটা অংকের টাকা দাদন দেয়। দাদনবাজ ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা লাভের আশায় বনের অভ্যন্তরে থাকা অবস্থাতেই সংগৃহীত মধুর সাথে চিনির সিরা ও অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে পরে লোকালয়ে আনতে বলে দেয়। মৌয়ালদের একাংশ ভেজাল মধু তৈরির উপকরণ ও সরঞ্জামসহ মৌসুমে বনে প্রবেশ করে।

সুন্দরবনের চাঁদপাই, ঢাংমারী, শরণখোলা, নলিয়ান ও বুড়িগোয়ালীনি রেঞ্জের বিভিন্ন অফিস থেকে মৌয়ালরা অনুমতি নিয়ে বনে প্রবেশ করে সংগৃহীত মধুর সাথে অন্যান্য উপাদান মিশ্রিত করে ভেজাল মধু তৈরী করে থাকেন। এছাড়া অনেক সময় বন থেকে আহরিত প্রাকৃতিক মধু লোকালয়ে এনে তার সাথে চাষের মধু মিশ্রন করেও ভেজাল দেয়া হয়। সুন্দরবন ও এর আশপাশ সংলগ্ন লোকালয়ে নকল মধু তৈরিতে বিভিন্ন দুর্বৃত্ত চক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে। মাঝে মাঝে উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও বন বিভাগের এ ক্ষেত্রে তেমন কোন তৎপরতা নেই।

সুুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের অর্ন্তগত জয়মনি বাজার, বৈদ্যমারী, জিউধরা, ঢাংমারী, বাণীশান্তা, লাউডোব গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গ্রামবাসী  জানান, বনে এখন আর আগের মতো মধু পাওয়া যায় না। মধু আহরণ মৌসুমের শুরুতে গরান ও খলসী ফুলের মধুর মৌসুম এবং শেষের দিকে কেঁওড়া ফুলের মধুর মৌসুম। কিন্তু বনে গরান ও খলসী এই দুই জাতের গাছের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। যার ফলে মধু আহরণও হ্রাস পাচ্ছে। এ কারণে এক শ্রেণির অসৎ মৌয়াল অধিক লাভের আশায় নকল মধু বানানোর জন্য বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে বস্তা ভর্তি চিনি ও বড় বড় পাতিল নিয়ে বনে যায়। চাষ ও চিনি নির্ভর ভেজাল মধু তৈরির জন্য শরণখোলা, চাঁদপাই, কয়রা, শ্যামনগরসহ বন সংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছে। এ চক্রের সাথে শতাধিক লোক জড়িত। গত দেড়মাস পুর্বে বনের পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা শ্যামনগরে ১৫ বস্তা চিনিসহ কয়েকজন মৌয়ালকে আটক করে জেল হাজতে দিয়েছে প্রশাসন। মোংলাতে এ চক্রের শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন হওয়াতে মোংলায় গড়ে উঠেছে পর্যটন ব্যবসা। এখানে বছরের অধিকাংশ সময়ই পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। আর পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্যে এ শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো বিভিন্ন স্থানে সুন্দরবনের মধু বিক্রীর দোকান গজিয়ে উঠেছে।

বাগেরহাট, মোড়লগঞ্জ, শরনখোলা ও মোংলা শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, মুদি দোকান, কাপড়ের দোকান, ঔষধের দোকান, ফলের দোকান, পান সিগারেটের দোকান, বেকারী, জুতার দোকান এমনকি সেলুনেও সুন্দরবনের খাঁটি মধুর লেবেল লাগিয়ে ভেজাল মধু বিক্রী করা হচ্ছে। সব স্থানে প্রকারভেদে কেজি প্রতি ৬ শ’ থেকে ১ হাজার টাকা দরে এ মধু বিক্রী করা হচ্ছে। ভেজাল মধু বিক্রির সাথে জড়িত সাতজন মধু বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানাযায়। প্রত্যেকে তার মধু খাঁটি বলে দাবি করেন। তবে তারা স্বীকার করেন, কেউ কেউ ভেজাল মধু বিক্রী করে।

সুন্দরবনের মৎস্য ব্যবসায়ী ও দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন আহমেদ  বলেন, সুন্দরবনের মৌয়ালদের কারো কারো বিরুদ্ধে ভেজাল মধু তৈরির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ বিষয়ে বনবিভাগের উদাসীনতাও বরাবরেরই। তাদের অবশ্যই এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিৎ, না হয় বিশ্বের দরবারে সুন্দরবনে তৈরী হওয়া মুল্যবান ঐতিহ্যবাহী এ পন্যটির দিন দিন সুনাম হারিয়ে যেতে বসেছে।

বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম  বলেন, সুন্দরবনের মধু দেশের ঐতিহ্য। খাঁটি মধুর চাহিদা দেশব্যাপী। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে বিদেশেও এ মধু রপ্তানি করা সম্ভব। কিছু ব্যবসায়ীর জন্য মধুর এ বাজার ধ্বংস হতে বসেছে। প্রশাসনের উচিত ভেজাল মধু বিক্রেতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা।

পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ এনামুল হক  বলেন, ভেজাল মধু তৈরির অভিযোগ তিনি শুনেছেন। কিন্তÍ বনবিভাগের মধুতে ভেজাল শনাক্তকরণের কোন যন্ত্র নেই। সাধারণত মধু সংগ্রহ মৌসুমে যে সকল মৌয়াল বন বিভাগের পাশ নিয়ে মধু সংগ্রহ করতে বনে প্রবেশ করেন তাদের নৌকাসহ অন্যান্য মালামাল আমরা পরীক্ষা করি। কিন্তÍ আমাদের অগোচরে তারা মধুতে ভেজাল দিলে কিছু করার থাকে না। তিনি আরো বলেন, মোংলাসহ আশে পাশের দোকানে প্রশাসন যদি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে তাহলে মধুতে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা কমবে।

মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার  বলেন, আমাদের কাছে এ বিষয়ে কেউ কোন লিখিত অভিযোগ দেননি। মৌখিক ভাবে আমরা বিষয়টি জানতে পেরেছি। কারো বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আমরা তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহন করবো।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত