বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত

সাকা হাফং অভিযান

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ মে ২০২২, ১৫:৫৫ |  আপডেট  : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:০৫

আব্দুল কাইউম খান মামুন
  ---------------------------------

 

শেষ পর্ব

২৫ ডিসেম্বর, ২০২১
আমরা যখন খালের পারে বসে কথা বলছিলাম, হঠাৎ দেখি আরিফ ভাই রা যেদিকে গিয়েছেন সেদিক থেকে আলো আসছে, কিন্তু একটি টর্চের আলো। বুঝলাম রাস্তা পাওয়া গিয়েছে, তাই শুধু একজন ফেরত আসছে আমাদের নেয়ার জন্য। কাছে আসতে বুঝলাম নুর এসেছে। বললো সবাইকে উঠতে, রাস্তা পাওয়া গিয়েছে। সবাই হাটা শুরু করলাম। বেশ অনেকটা সামনে গিয়ে বাকিদের পেলাম। একে একে সবাই পার হতে থাকলাম। পানি শুধু ঠান্ডা না, অনেক বেশি ঠান্ডা। এই খানে একটি ঝিড়ি এসে মিশেছে, নাম নেফিউ ঝিরি। এখন আমরা ওই ঝিরি ধরেই উঠতে শুরু করবো। তবে উঠে যাওয়ার রাস্তা পাওয়াটা এত সহজ ছিলো না। দেখে যেটা যাওয়ার রাস্তা মনে হচ্ছিলো, সেটা আসল রাস্তা না। 
 
আবারো রাস্তা খোঁজা শুরু হলো। এমন একটি দিক দিয়ে রাস্তা পাওয়া গেলো যেদিক দিয়ে যাওয়ার কথাই না। কিছু সামনে আগাতেই দেখি ছোট ছোট বাঁশ দাড় করিয়ে রাখা, নিচে কয়লা। বুঝতে পারলাম কেউ এখানে কিছু সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছিলো, বাঁশের মধ্যে পানি গরম করে কিছু খেয়েছে। দু এক দিন আগের হতে পারে। রাস্তা তাহলে ঠিকই আছে। এই নেফিউ ঝিরি একদম উপর থেকে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে। তার পাশ দিয়েই আমরা উঠে চলেছি। শিফা পায়ে সমস্যার কারণে কিছুটা আস্তে হাঁটছে, যদিও প্রতিবার ই বলে আসছে সেরকম কোন ব্যথা করছে না। পেছনে আমরা কয়েকজন আস্তে ধীরে আগাচ্ছি। রাত ২ টার দিকে একটা জায়গায় একটু দাড়ালাম। সবার লাইট বন্ধ। এতক্ষণে খেয়াল করলাম আমাদের চারপাশের বিশাল বিশাল গাছের ফাঁক ফোকর ভেদ করে দিনের সূর্যের আলোর মত করে রাতের জোছনা আসছে। যতক্ষণ নিচে ছিলাম, কুয়াশার কারণে কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। কিন্তু এখন উপরের দিকে কোন কুয়াশা নেই। একদম ঝকঝকে আকাশ। এমন না যে আকাশে একদম পূর্নচন্দ্র, তবে অর্ধেকের কিছুটা বেশী আরকি। তাতেই যা আলো, গাছপালা না থাকলে এই আলোতেই এগিয়ে যাওয়া যেতো। 
 
আবারো উঠতে থাকি আমরা। পলাশ বারবার তাড়া দিচ্ছিলো, কারণ রাস্তা তখনো অনেক বাকি। পাহাড়ি লোকজন তো অনেক ভোরে উঠে যায়। তারা উঠে পড়ার আগেই এসব এলাকা পার হয়ে যেতে হবে। ভোর ৫ টার দিকে আমরা একটি স্থানে পৌঁছাই যেখানটা দেখে মনে হচ্ছিলো পাহাড় কেটে রাস্তা করার গাড়ি ওই পর্যন্ত এসে থেমে গিয়েছে। রাস্তা হয়তো আরো অনেকদূর যাবে। কিন্তু আপাতত এই পর্যন্ত কাজ শেষ। আমাদের সবাইকে রেখে আরিফ ভাই এগিয়ে গেলেন, রাস্তা ঠিক আছে কিনা বোঝার জন্য। কিন্তু একটু পরেই আবার ফিরে এলেন। রাস্তা এইটা না। উনি পলাশ কে নিয়ে অন্য একটি পথে আগালেন। 
 
বসে আছি তো বসেই আছি। পলাশ বা আরিফ ভাই কারোর কোনোই খোজ নাই। কয়েকজন মাটির উপরে বসে পড়েছে। এই জায়গাটা কিছু খোলা হওয়াতে বেশ ঠান্ডা বাতাস লাগছে। মোটামুটি ১৫/২০ মিনিট পরে পলাশ এর ডাক শুনলাম। সবাইকে আগাতে বললো। একে একে সবাই আগাতে শুরু করলাম। সামনের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঢুকতে হবে। এরপরে আবারও ঝিরি পথ। ভালোই লাগে এই ঝিরি পথ গুলো। সামনে নাকি একটি রাস্তা পার হতে হবে। বেশ কিছুদূর হেঁটে সামনে এগিয়ে তারপরে অপর পাশে দিয়ে আবার পাহাড়ে উঠতে হবে। ওই অংশটাই মূলত রিস্কি। কারণ কেউ দেখে ফেললেই ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। আমরা ওই রাস্তার কাছাকাছি ই চলে এসেছি। 
 
একটু পরেই ঝিরি পথ ছেড়ে বাম পাশে পাহাড় ধরে উঠতে শুরু করলাম। অনেক খাড়া ভাবে উঠে গিয়েছে এই স্থানটা। শিফার যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে। তবু কষ্ট করে উঠছে, সাথে ইফতি ওকে সাহায্য করেই যাচ্ছে। যাইহোক, আর হয়তো বেশিদূর নেই। কিছু পরেই আমরা সেই রাস্তায় পৌঁছে যাই। অনেক চওড়া রাস্তা। পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে। এখনো কাঁচা। আশেপাশে ইট দেখা যাচ্ছে। এগুলো ভেঙে সোলিং করবে হয়ত। আমরা খুবই দ্রুত রাস্তার অংশটা পার হয়ে যাই। পার হয়ে বাম পাশে একটি জায়গায় প্রবেশ করি। সেখানে অনেক বড় একটি খোলা জায়গা। কাজ করার বিভিন্ন মালামাল রাখা। এগুলো পার হয়ে আরো ভিতরে চলে যাই। সেখানে পাহাড়ে উঠে যাওয়ার একটি রাস্তা দেখা যায়। আমাদের সবাইকে দাড়াতে বলে পলাশ আর আরিফ ভাই উপরে উঠে যায়। কিছুটা সময় পরে আবার ফিরে আসে। বললো এইটা রাস্তা না। এই বলে আবারো নিচে চলে যায়। সেখানেও কিছু সময় রাস্তার জন্য খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। একটু পরে আমাদেরও যেতে বলে, সবাই চলে যাই। কিন্তু রাস্তায় উঠতেই গাড়ির শব্দ শুনতে পাই। দ্রুত সবাই আবার ভেতরে চলে আসি। এসে ওরা দুজন আমাদের সবাইকে নিচে রেখে আবারো উপরে উঠে যায়। রাস্তা খুঁজে পেলে আমাদের জানাবে। 
 
সবাই নিচে গাছের আড়ালে দাড়িয়ে/ বসে অপেক্ষা করছি। এদিকে আতিক ভাই এর আবার পেটের সমস্যা হয়েছে। এর মধ্যেই নাকি কয়েক বার আড়ালে গিয়েছেন। এখন আবার গেলেন। জানতে চাইলাম আমাদের সবার কমন খাবারের বাইরে আর কি খেয়েছে। কিন্তু কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। যাই হোক স্যালাইন খাওয়া চালিয়ে যেতে বললাম। আর আমার সাথে থাকা একটি ওষুধ খেতে বললাম। হঠাৎ ই পলাশ এর ডাক শুনতে পাই। সবাইকে নিয়ে উঠতে শুরু করি। কিছুটা ওঠার পরেই ওদেরকে পেয়ে যাই। ওঠার পরে বললো সবাইকে কিছু খেয়ে নিতে। এরপরে আবার সামনে আগাবো। সবাই সবার ব্যাগ থেকে শুকনা খাবার বের করে খেতে শুরু করলাম। 
 


যেখানে আছি এখন, এখানে থেকে আমাদের আসার পথটা অনেকদূর দেখা যাচ্ছে। এই পাহাড়ের বিপরীতে থাকা পাহাড়টাও অনেক উচুঁ। মনে মনে ভাবছিলাম ওইটার চূড়া এত উচুঁ হলে সাকার চূড়া তো তাহলে আরো অনেক উপরে। তার মানে আরো অনেকটা উঠতে হবে। যদিও পেছনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে খুব বেশি উচুঁ মনে হচ্ছিলো না। আরিফ ভাই আর পলাশ আমাদের রেখে আবারো সামনে এগিয়ে গেলেন। কিছু সময় পরে আমাদের যেতে বললেন। কিন্তু না, এই রাস্তাও ঠিক না। আবারো ব্যাক করতে শুরু করলাম। যেখানে বসে নাস্তা করেছিলাম সেখানে আমাদের রেখে ওনারা আবারো এগিয়ে গেলেন। উপর থেকে শুধু ওনাদের বলা কিছু শব্দ শুনতে পাচ্ছি। অনেকটা সময় পরে পলাশ এর ডাক শুনলাম। বাম পাশে থাকা একটি ট্রেইল ধরে এগুতে বললো। সবাইকে নিয়ে সেদিক দিয়ে আগাতে শুরু করলাম। দুইপাশে অনেক ঘন জঙ্গল, আর নেমে যাওয়ার পথটা খুবই পিছলা। দুইহাতে দুইপাশের জঙ্গলের গাছ ধরে ধরে নিচে নামতে শুরু করলাম। একে একে সবাই নামলাম। সেখান থেকে আরেকটু সামনে যেতেই আরেকটি ট্রেইল পেয়ে যাই। 
 
নতুন পাওয়া ট্রেইল ধরে এগিয়ে যেতে থাকি। এদিকটায় অনেক জঙ্গল। সবচাইতে বড় সমস্যা হলো ট্রেইল এর দুপাশের গাছগুলো এমনভাবে নিচু হয়ে আছে যে আমাকে অনেক নিচু হয়ে হাঁটতে হচ্ছে। এরমধ্যে আবার কিছু ছ্যাচড়া আছে যেগুলো জামা কাপড় কামড়ে ধরে, কাপড়ের সুতো উঠে আসবে তবু ছুটবে না। শেষ নভেম্বরে দুমলং এ আসা যাওয়ার সময় তো আমার অনেক সুন্দর একটা টিশার্ট এর সুতো উঠে একদম একাকার হয়ে গিয়েছিলো। আজও সেই একই অবস্থা। এদের জ্বালায় সামনে এগুনোই দায়। একদম সামনে আছে পলাশ, জঙ্গল কেটে এগুচ্ছে। পেছন থেকে আমরা দু হাত দিয়ে জঙ্গল যতটা পারা যায় দুপাশে সরিয়ে এগুচ্ছি। 
 
এই ট্রেইল ধরে চলতে শুরু করতেই গ্রুপের কয়েকজন বললেন রুট সম্ভবত এইটা না, ডান পাশে আরেকটা ট্রেইল গিয়েছে, সেটায় যেতে হবে। কিন্তু আরিফ ভাই আর পলাশ নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল, ওনাদের মতে বর্তমান ট্রেইল ই ঠিক আছে। বেশ অনেকটা এগিয়ে, একটা স্থানে তেরছা ভাবে উপরে উঠতে হচ্ছিলো,পাতা পড়ে থাকার কারণে যথেষ্ট পিছলা। আশেপাশের গাছপালা ধরে ধরে উঠতেছিলাম। 

সামনে এগিয়ে দেখি একটা জায়গায় আমাদের আগে থাকা আতিক ভাই, ভাবী বসে আছেন। ডায়রিয়া হয়ে আতিক ভাইয়ের কিছুটা খারাপ লাগছে। এখানে আমাদের রেখে পলাশরা আবারো সঠিক রাস্তা খুঁজতে বের হলেন। এই ফাঁকে আতিক ভাই বসে বসেই ঘুমিয়ে গেলেন। কিছুটা পরে আমাদের উপর থেকে ডাক দিলো উঠার জন্য। এখান থেকে মূলত বাঁশঝাড় শুরু। সবাই একে একে উঠতে শুরু করলাম। ওঠা নামার পথে বাঁশঝাড় ভালোই লাগে আমার। খুব সুন্দর ঠান্ডা ঠান্ডা একটা পরিবেশ থাকে, বাতাসে বাঁশপাতা গুলো সুন্দর একটা শব্দ করতে থাকে, তাছাড়া বাঁশ ধরে ধরে সুন্দরভাবে ওঠানামা করা যায়। কিছুদূর উঠতেই আতিক ভাই এর আবারো প্রকৃতির ডাক পড়লো। বেচারার এখনো বন্ধ হয়নি। 
 
সবাই ধীরে ধীরে উঠতে থাকলাম। যতই এগুচ্ছি মনে হচ্ছে, এইতো চলে এসেছি আর একটু। কিন্তু ওই একটু উঠতেই দেখি আরো উঠতে হচ্ছে। এভাবেই উঠতে উঠতে হঠাৎ ই মনে হলো এবার ঠিক চূড়ার কাছাকাছি চলে এসেছি। সামনে যারা ছিলো তাদের কণ্ঠের উল্লাসধ্বনির মাধ্যমে বুঝতে পারলাম যে আমরা চলে এসেছি। আসলেই, আরেকটু সামনে যেতেই পেয়ে গেলাম কাঙ্ক্ষিত চূড়া। আহ!! অবশেষে সামিট হলো আমার, আমাদের। কত ধরনের অনিশ্চয়তা, বাধা বিপত্তির পরে অবশেষে আমরা সবাই সুস্থ সবল ভাবে সামিট করতে পারলাম। গতকাল সকাল ৯ টায় শেরকর পাড়া থেকে রওয়ানা হয়ে আজ সকাল পৌনে ১০ টায় সামিট পয়েন্টে পৌছালাম। হ্যাঁ, পুরো সময় তো আর হাটিনি, কিন্তু কেউ ঘুমাইও নি। গতকাল সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত সবাই  হাঁটার উপরেই আছি। এখানে থেকে আবার পাড়াতে ফেরত যেতে হবে। সেক্ষেত্রে অন্তত সন্ধ্যা তো হবেই। দেখা যাক আল্লাহ ভরসা। চূড়ায় পৌঁছে প্রথমেই সবাই সবাইকে অভিনন্দন জানাই। সবাই চূড়া থেকে সামনে থাকা মায়ানমার এর অসংখ্য পর্বত ও এর সৌন্দর্য দেখতে থাকি। কিছুটা বিশ্রাম ও হালকা খাওয়া সেরে নেই। এরপরে একে একে সবাই ছবি তুলতে শুরু করি। সাকা সামিট পয়েন্ট এর একটি বিশেষত্ব আছে, এখানে একটি গর্ত আছে, যেটা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটাই আসল সামিট পয়েন্ট। ওই গর্তের পাশে বসে সবাই ছবি তুললাম। সাথে যেহেতু গ্রুপের বাইরে কেউ নাই, তাই নিজেরাই গ্রুপ ছবি তুলে নিলাম। 
 


মোটামুটি সোয়া এগারোটার দিকে আমরা নামতে শুরু করি। খুব একটা সমস্যা হচ্ছিলো না নামতে। হাসাহাসি গল্প করতে করতে সবাই নেমে চলেছি। বাঁশঝাড় শেষ করে যখন আবার জঙ্গলে ঢুকলাম সেখানে এখন আর সকালের মত ঘন জঙ্গল মনে হচ্ছিলো না, সবার শেষ জন পর্যন্ত ডালপালা ভেঙে এগুনোর কারণে এখন খুব সুন্দর একটি ট্রেইল হয়ে গিয়েছে। এখন অনেক ফাঁকা মনে হচ্ছে। আস্তে ধীরে সবাই এগিয়ে চলেছি। নামতে যা দেরী, এছাড়া কোথাও থামতে হয়নি। একদম নিচে নামার আগে একটি জায়গায় বসলাম শুধু। ওই স্থানের কিছুটা নিচেই পানির একটি উৎস আছে। সেখান থেকে অনেকেই পানি খেয়ে নিলাম। 
 
এদিকে শিফা এর হাটুর অবস্থা খুব একটা ভালো না। এই অবস্থায় আবারো একই পথে ফিরে যাওয়াটা অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার। তাই পলাশ আর আরিফ ভাই আগেই চলে গিয়েছেন যদি কোন গাড়ি পাওয়া যায় কিনা। পেছনে আমরা যারা ছিলাম তারা সকালের ওই মাটির রাস্তায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটি ট্রাক হাতছাড়া হয়ে গেলো। ওনারা কয়েকজন মিলে একটি কনস্ট্রাকশন এর গাড়ি দাড় করিয়ে রেখেছিলেন। কি আর করা কপাল খারাপ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমরা যেখানে থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠলাম, সকালে ওই জায়গার সামনে দিয়ে কতবার যে আসা যাওয়া করেছি, কিন্তু রাস্তা বুঝতে পারিনি। পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোর কারনে বোঝার উপায় ই নাই যে এখানে একটি রাস্তা আছে। অন্তত দের থেকে দুই ঘণ্টা সময় বাঁচতো আমাদের। 
 
রাস্তায় এসে কিছু সময় দাড়ালাম, যদি কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু না, অনেকক্ষণ থেকেও কিছু পেলাম না। রাস্তা ধরে এগুতে থাকলাম। কিন্তু বেশিদূর যাওয়া ও যাবে না, সামনেই আর্মি ক্যাম্প আছে। রাস্তার পাশে থাকা ইটের উপরে বসলাম সবাই। কোন পথে কিভাবে গেলে ভালো হবে, সেটা নিয়েই আলোচনা করছিলেন আরিফ ভাই আর পলাশ। এর মধ্যেই পলাশ উঠে একটি ট্রেইল ধরে চলে গেলো। ওইদিকে একটি পাড়া আছে। পাড়ার ঠিক পরেই ক্যাম্প। এর মধ্যে দিয়ে কোনোভাবে যাওয়া যাবে কিনা সেটাই দেখতে গিয়েছে। 
 
পাড়া থেকে ফিরে এসে বললো, এদিকে দিয়েই যাওয়ার জন্য। রাস্তায় কোন গাড়ি পেলে চলে যাওয়া যাবে। সবাই উঠে আগাতে শুরু করলাম। পাড়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় চুপচাপ যেতে হবে, কারো সাথে কোন কথা বলা যাবে না। কোনো দিকে না তাকিয়ে রাস্তা ধরে এগিয়ে যাবো, আর যেহেতু এখন একদম ভরদুপুর আশা করা যায় এই রোদে কেউ আমাদের জন্য দাড়িয়ে নেই। পাড়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন ডাক দিয়েছিলো, কিন্তু কোন কথা না বলে সবাই খুব দ্রুত এগিয়ে গেলাম। পাড়া থেকে বের হতেই আবার সেই রাস্তায় এসে উঠলাম। আমার বাম পাশেই ক্যাম্প আর ডান পাশে দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে। একদম কাচা রাস্তা। গাড়ি আসা যাওয়া করলেই ধুলোর মেঘ আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। ক্যাম্প এলাকা টা খুব দ্রুত পার হওয়ার চেষ্টা করছি সবাই। একটি ট্রাক দেখে পলাশ এগিয়ে গেলো, আমরা যারা পেছনে ছিলাম, তারাও অনেকটা দৌড়ে এগুচ্ছিলাম। বেচারী শিফার অবস্থা বেশি খারাপ, হাঁটুতে সমস্যা নিয়ে তাকেও আমাদের সাথে একই গতিতে এগুতে হচ্ছে। দৌড়েও লাভ হলো না, ট্রাক অনেক বেশি টাকা চাচ্ছিলো তাও মাত্র ৫ কিলো এগিয়ে দেয়ার জন্য। আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। 


আবারো হাটা শুরু। মাথার উপরে করকরা রোদ। রাস্তায় রাশি রাশি ধুলা। অনেকগুলো ট্রাক ড্রাইভার এর সাথে কথা বলেও লাভ হলো না। হেঁটেই চলেছি সবাই। এরইমধ্যে একটি পানিবাহী পিকাপ পাওয়া গেলো, সেখানে শিফা সহ মেয়েদের সবাই কে ও ইফতি কে সাথে দিয়ে দেয়া হলো, কয়েক কিলো অন্তত গাড়িতে যেতে পারবে। আল্লাহর রহমত। আশা করি আমাদের বাকিদের ও ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই ভেবে এগুতে শুরু করলাম। দুই কিলো মত হেঁটে এগুলাম। যদিও অনেক রোদ কিন্তু এতক্ষণ শুধু নেমেই এসেছি, উঠতে হয়নি। একটা ব্রিজের পাশে এসে মাটিতে পরে থাকা বিশাল লম্বা একটি গাছের উপরে বসলাম। 

একটি ট্রাক আসলো, পলাশ গিয়ে কথা বললো। ড্রাইভার রাজি হলো আমাদের নিয়ে যেতে। সবাই দৌড়ে উঠতে শুরু করলাম। ট্রাকের পেছনটা পুরাই ফাঁকা। সবাই ভালোভাবে ধরে দাঁড়ালাম। ট্রাক টানতে শুরু করলো। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া। ট্রাক আমাদের পাড়াতে পৌঁছে দিবে না ঠিক আছে, কিন্তু অনেক টা পথ এগিয়ে যেতে পারবো। 
 
গাড়ি চলতে শুরু করলো। আহ, কি যে শান্তি লাগতেছিলো। চাঁদের গাড়ির চাইতেও বেশী জোস ফিলিংস। কারণ চাঁদের গাড়িতে একটি খাচা মত থাকে, এখানে সেটাও নাই। নতুন বানানো রাস্তা ধরে গাড়ি এখন শুধু উঠেই চলেছে। ভাবছিলাম এত রাস্তা উঠে আসতে ক্লান্ত এই শরীরের আসলেই খবর হয়ে যেত। তবে ভাবছিলাম শিফা দের কথা। কোথায় নামিয়ে দিয়েছে জানিনা। যদিও সামনে রাস্তাতেই পড়বে। কয়েক কিলো এগিয়ে পেয়েও গেলাম। ধরে বেধে ওদেরকে ট্রাকে তুলে নিলাম। কয়েকজন বাদে বাকি সবাই ট্রাকের ফ্লোরে বসা। আহ কি যে একটা মজার সময় কাটলো। গল্প, হাসি, ছবি তোলার মাঝেই একটি নির্দিষ্ট স্থানে আমাদের নামিয়ে দিলো। এখান থেকে আমাদের হেঁটেই যেতে হবে, গাড়ি যাওয়ার রাস্তা নেই আর। এইখান থেকে সিমতলম্পিং পাড়া কাছেই। ড্রাইভার খুবই ভালো মানুষ। জাস্ট নাস্তা খাওয়ার কিছু নিলো, তাও নিজে চেয়ে না, আমরাই দিয়েছি। অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আমরা চলতে শুরু করি। 
 
সাকা, ২০১৯
চলতি পথে আমার সেই ২০১৯ এর কথা আবারো মনে পড়ে গেলো। আমরা নয়াচরণ পাড়া থেকে ফিরে সেদিন সিন্তলম্পিং পাড়ায় ছিলাম। পরদিন খুব ভোরে অন্ধকার থাকতেই থানচি এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম পুরো পথ হেঁটে যেতে হবে। কারণ গত ৫/৬ দিন যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে এই মাটির রাস্তা নিশ্চই গাড়ি চলার উপযোগী নেই আর। তবে এই অনুপযোগী যে আসলেই কতটা অনুপযোগী সেটা তখনও জানতাম না। রাস্তার দুরত্ব ও কম না, ২০/২২ কিলো হবে এই পাড়া থেকে। পাড়ার রাস্তা থেকে যখন মূল রাস্তায় উঠলাম, তখন বুঝলাম রাস্তার অবস্থা কতটা জঘন্য। এত কাদা যে হাটাই দায়। অনেকটা এগুনোর পর এক জায়গায় দেখি রাস্তায় পাশের পাহাড়ের একটি অংশ ধ্বসে পড়ে আছে। পা দিতেই ডেবে যাচ্ছিলো। আস্তে আস্তে করে এগুনোর চেষ্টা করছি। যতই সামনে যাই পা ততই ডেবে যায়। হাঁটু সমান ডেবে যাওয়ার পরে কিছুটা ভয় লাগছিলো, এখন যদি এই ধস পিছলে আমাদের বামে থাকা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করে, আর কেউ খুঁজেও পাবে না। অনেক ভয়ে ভয়েই জায়গাটা পার হলাম। এভাবে আরো ৪/৫ টা জায়গায় ধস পেয়েছিলাম। তবে একটি স্থানে এসে আমরা পুরো আটকা পরে যাই। ওই স্থানে ৬/৭ ফুট চওড়া একটি রাস্তা আমাদের সামনে থেকে নেমে এসেছিলো, কিন্তু এখন আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। সামনের পুরো পাহাড় ধ্বসে একদম নিচে পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। ধরেই নিয়েছিলাম যে আটকা পড়তে যাচ্ছি আমরা। এর মধ্যেই এক স্থানীয় লোক আসলো, সে ওই ভঙ্গুর ঢালু পাহাড় বেয়ে পাশ ফিরে কোনাকুনি উঠে যাচ্ছিলো। তাই দেখে আরিফ ভাই আর পলাশ ও পিছু নিলো। আমি কোনোভাবেই সাহস পাচ্ছিলাম না। কিন্তু দাড়িয়ে ও থাকা যাবে না। সবার পিছনে আমিও উঠতে শুরু করলাম। কোনোভাবেই আমার ডান দিকে তাকাচ্ছিলাম না। ওদিকে একবার পিছলে পড়লে আর খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কিভাবে যে একটানে উঠে গেলাম নিজেও জানিনা। একদম উঠে তারপরে পেছনে নিচের দিকে তাকালাম, মাথাটা ঘুরে উঠলো। নাহ, আর তাকানো যাবে না ভেবে এগিয়ে চললাম। আরো ২/৩ টা এমন পাহাড় ধসের জায়গা পেরিয়ে যখন থানচি থেকে ৬ কিলো দূরে পৌঁছেছি, তখন ঐ রাস্তায় কাজ করা একটি পানিবাহী পিকআপ ড্রাইভার দয়াপরবশ হয়ে আমাদেরকে তার গাড়িতে উঠতে বলেন। আহ কি যে শান্তি পেলাম। সবাই দৌড়ে উঠে পড়লাম। অল্প কিছু সময় পরেই আমরা থানচি পৌঁছে যাই। আহ, অবশেষে লোকালয়ের দেখা পেলাম। সরাসরি ডিস্কাভারি হোটেলে চলে যাই। সেখানে ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিই। 
 
প্ল্যান ছিলো অন্য কোন গ্রুপ পেলে তাদের সাথে চাঁদের গাড়িতে যাবো নয়তো বাসেই চলে যাবো। কিন্তু কোনো চাঁদের গাড়ি পেলাম না। গারীই নেই, সব বান্দরবানে। বাসে ওঠার জন্য সাঙ্গু নদীর উপরের ব্রিজ পার হচ্ছিলাম। সেখান থেকে সাঙ্গু নদীর অবস্থা দেখে অনেক অনেক অবাক হয়েছিলাম। এত পানি কখনোই দেখিনি আগে, বা এমন হতে পারে সেটাও ধারণায় ছিলো না। যাইহোক বাসে করে এই প্রথম এই রাস্তা ধরে যেতে থাকি। বর্ষা মৌসুম হওয়াতেই হয়তো রাস্তার অনেকটা অংশে এই বিকেল বেলা অনেক অনেক মেঘ পেলাম। এমনও পেয়েছি যে মেঘের কারণে সামনের রাস্তা দেখা যাচ্ছিলো না। কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম । তিনঘণ্টার কিছু বেশি সময় লেগেছিলো বান্দরবান পৌঁছাতে। প্রচুর বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢলে কেরানিহাট থেকে সামনের দিকে অনেকটা রাস্তায় পানি ছিলো। একারণে ঢাকার বাস ছাড়া নিয়ে অনেক সমস্যায় ছিলো বাস কোম্পানিগুলো। অবশেষে শুধু আমাদের বাসটাই রিস্ক নিয়ে ছেড়ে গিয়েছিলো। তবে রাস্তায় আসলেই অনেক পানি ছিলো। বাসের হেডলাইট পর্যন্ত পানি ছিলো রাস্তায়। ড্রাইভার রিস্ক নিয়েই একটানে পুরো রাস্তা পার হয়েছিলো। যাইহোক, অবশেষে ভারাক্রান্ত মন নিয়েই সবাই ঠান্ডার মধ্যে ঘুমিয়ে ঢাকা পৌছালাম। যদিও ড্রাইভার এক সময় রাস্তার মধ্যে একটি প্রাইভেট কারে মেরে দিয়ে ভয়ে পাগলের মত টেনে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তখনো কিছুটা ভয়ে ছিলাম কোন দুর্ঘটনা না ঘটে। আল্লাহর অশেষ রহমতে অনেক ধরনের খারাপ কিছু থেকে সহি সালামতে ঘরে ফিরেছিলাম। আর যারা থেকে গিয়েছিলো, তাদের সম্পর্কে যদি কেউ জানতে চান, জানাতে পারেন। ঐ গ্রুপের থেকে লালন ভাই এর একটি পূর্ণাঙ্গ লেখা আছে। গ্যারান্টি দিতে পারি সেই লেখার আমাদের চলে আসার পরের অংশ পড়তে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং ও থ্রিলিং লাগবেই। 
 
ট্রাক ড্রাইভার আমাদের যেখানে নামিয়ে দিলো, সেখানে থেকে আমরা সিমতলোম্পিং পাড়ার পথে এগিয়ে চললাম। কিছুটা এগুতেই পথ চিনে ফেললাম। আগেরদিন এখানেই বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। বাকিদের থেকে আমরা আলাদা হয়ে বসেছিলাম এখানেই। তাড়াতাড়ি পাড়ায় ফেরার তাগিদে আমরা এগিয়ে চলতে থাকি। এদিকে চলতি পথে ইফতি আর শালদা আমাদের গ্রুপের সবাইকে নিয়ে গান বানাতে শুরু করে দেয়। ট্যুরে যাকে যেভাবে পাওয়া গিয়েছে, সেইটা নিয়ে একটি রসাত্মক গান । হাঁটতে হাঁটতে ২/৩ জনের টা শুনে ফেলি। এরা তো ভালোই, চলতি পথেই কি সুন্দর গান বানিয়ে ফেলছে। 
 
সিমতলোম্পিং পাড়ায় কিছুটা সময় দাড়িয়েছিলাম। আগেরবারের চেয়ে অনেক সুন্দর এখন। এমনকি পানির ব্যবস্থা সহ বাথরুম ও আছে । কিযে একটা সিস্টেম ছিলো আগে, ভাবতেই হেসে উঠলাম আমি আর পলাশ । আবারো এগুতে শুরু করি। এদিকে পেছন থেকে হুট করে নুর এসে বলে সে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আবারো তাজিংডং সামিট করবে। এক দিনে দুইটা সামিট করার খুব ইচ্ছে হয়েছে। সে দৌড়ে ভুল রাস্তায় চলে গেলো । আরিফ ভাই তাকে খুঁজতে পিছনে পিছনে গেলো, কিন্তু তাকে আর পাওয়াই গেলোনা। মুহূর্তেই হাওয়া। 
 
যাইহোক সবাই আবারো আগাতে থাকি। কিছুটা সামনে গিয়ে এক স্থান থেকে আমি একাই এগিয়ে যাই। দ্রুত হেঁটে অনেক সামনে চলে যাই। এমনকি পেছনের কারো কোন শব্দ ও শুনতে পাইনা। ভাবলাম লাইট বন্ধ করে একটু দাড়িয়ে দেখি তো কেমন লাগে। নাহ, বেশিক্ষণ লাইট বন্ধ করে থাকতে পারিনি। একটু সামনে যেতেই কিছু একটা দৌড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে লাইট ঘুরিয়ে দেখি একটি গয়াল। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবলাম দৌড়ে আমার দিকে আসবে কিনা, দিলাম একটা দৌড়ানি, একলাফে নিচের দিকে চলে গেলো। অবাক হলাম, এই শরীর নিয়ে কিভাবে ঢাল বেয়ে দৌড়ে নেমে গেলো, তাও অন্ধকারে। 
 
সন্ধ্যা ৭ টার দিকে পাড়ায় পৌঁছেই আগে গোসল টা সেরে ফেলি। কি যে শান্তি লাগছিলো গোসল করতে। যথেষ্ট সময় নিয়ে গোসল করলাম। এরপরে পলাশ এর সাথে দ্রুত রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে ফেললাম। পরের দিন ভোট থাকাতে পাড়ায় তেমন কেউ থাকবে না, সবাই ভোট দিতে যাবে। পুরো পাড়ায় আমরাই কয়েক জন থাকবো হয়তো। আবার কাল বিকেলে ঢাকা ব্যাক করতে পারবো কিনা সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। দুপুরের দিকে ফোন করে কথা বলতে হবে। আজ আর বেশি দেরি না করে শুয়ে পড়লাম। 
 
২৬ ডিসেম্বর ২০১৯
সকালে অনেক সময় ধরে ঘুমাবো, এইটা আমার কখনোই হয়না। আজও উঠে পড়লাম। ফ্রেশ হতেই দেখি শিফা সহ আরো কয়েকজন ঘরের সামনের আগুনের পাশে বসে আছে। আমিও গেলাম। সেখানে লোকাল কয়েকজন এর সাথে টুকটাক কথা হচ্ছিলো। এরমধ্যে কয়েকটি লোকাল শব্দ শিখেও ফেলেছে শিফা আর সাদি । সকালের নাস্তা শেষ করে সবাই অলস সময় কাটাচ্ছি। হেঁটে পাড়ার অন্য মাথায় চলে গেলাম সবাই। সেখানে গিয়ে একটি দোকান থেকে কিছু কিনবো ভেবে গিয়ে দেখি বন্ধ। ভোট দিতে গিয়েছে। সেখানে অনেকটা সময় সবাই গল্প করলাম। সাথে কয়েকজন এর ফটো সেশন। পাশে থাকা একটি গাছ থেকে তেতুল ও পেরে খেলাম। 
 
মোটামুটি দুপুরের দিকে আবার ঘরে ঢুকলাম। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, ব্যাগে থাকা নুডুলস গুলো রান্না করে সাথে ডিম সিদ্ধ করে দুপুরের খাবার হিসেবে চালিয়ে দিবো। আমি নিজেই দায়িত্ব নিলাম। ডিম সিদ্ধ আসতে আসতে আমি সবার থেকে নুডুলস নিয়ে সেটা রান্না করে ফেললাম। আরিফ ভাই সবার প্লেটে নুডুলস বেড়ে দিয়ে তার উপরে ডিম অর্ধেক করে কেটে দিচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিলো রেস্টুরেন্ট এর খাবার । খাবারটা কিন্তু সেই ট্যস হয়েছিলো।
 
খাওয়ার পরে আমাদের সেই গানের আসর বসলো। ইফতি গাইতে শুরু করলো। একে একে সবাইকে নিয়ে দুই লাইনের গান। আহা, ছেলেটার গলার কি সেই সুর। কত সুন্দর করেই না আমাদের নিজেদের নিয়ে গান গেয়ে শুনালো। পুরোটা ভিডিও করে রাখলাম। বুড়ো বয়সে বসে বসে দেখবো ইনশাআল্লাহ। 

তিনটার দিকে আমরা পাড়ার সবচাইতে উচুঁ স্থানে যাই। সেখানে নাকি নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। তবে টানা পাওয়া যায় না, গ্যাপ দিয়ে দিয়ে। আবার মোবাইল হাতে উচুঁ করে রাখতে হয়, সেভাবেই লাউড স্পিকারে কথা বলতে হয়। সেভাবেই কথা বলে আমরা জানতে পারলাম, আজ আর থানচি থেকে বের হওয়া যাবে না। যে যেখানে আছি সেখানেই থাকতে হবে। কি আর করা কয়েকটি জায়গায় ফোন করে জানানোর চেষ্টা করলাম একদিন দেরি হওয়ার বিষয়টা। কথা বলা শেষ করে নিচের দিকে নামতেই দেখি আবির, মাহবুব ভাই, ইফতি, সাদি, সাদিক মিলে আমাদের সবার ঠান্ডার ড্রেস, চা খাওয়ার সকল সরঞ্জাম, আগুন জ্বালানোর সকল সরঞ্জাম, মাটির উপরে বসার সরঞ্জাম নিয়ে হাজির। আপাতত কেউ আর নিচে যাচ্ছিনা। এখানেই গল্প হবে, আড্ডা হবে। এখান থেকে খুব সুন্দর ভাবে সূর্যাস্ত দেখা যাচ্ছিলো। সেটা দেখতে দেখতে সবাই ছবি তুলতে শুরু করলাম। এমনকি সূর্য ডুবে যাওয়ার পরেও হালকা আলোতে সমানে ছবি তোলা চলতে থাকলো। খুব সুন্দর সুন্দর কিছু ছবি আসতেছিল। ভালোই লাগতেছিলো ছবিগুলো। আমারও কয়েকটি তুলে নিলাম। এরই মধ্যে আগুন ধরানো হলো। এক্ষেত্রে সাদিক নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নিলো। যতক্ষণ এই স্থানে ছিলাম সাদিক ই আগুণ জ্বালিয়ে রেখেছিলো। আতিক ভাই তার মাইক্রো চুলায় সবার জন্য চা বানিয়ে ফেললেন। সবাই আরাম করে তাই খেলাম। এরপরে সবাই আগুনের চারপাশে বসে গান গেয়ে গল্প করে সময় কাটাচ্ছিলাম। 
 
এভাবেই রাত প্রায় ৯ টা বেজে গেলো। এখন নিচে যাওয়া দরকার, খাওয়া দাওয়া সারতে হবে। দাদারা তো ঘুমিয়ে যাবেন, ওনাদের জন্য অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।। ঘরে ঢুকে খাবার রেডি করে সবাই পেট পুরে খেয়ে নিলাম। পলাশ আজও ডাল এ বাগার দিলো। সেই লেভেলের মজা হয়েছে আজ ডালটা। মনে হচ্ছিলো শুধু ডাল ই খাই বসে বসে। 
 
খাওয়া শেষে পরেরদিনের জন্য ব্যাগ গুছিয়ে রাখলাম। এরই মধ্যে আতিক ভাইদের সেই লেভেলের হাসাহাসির পর্ব শুরু হলো। একজন হাসে তো বাকি সবাই তাল মিলায়। মাহবুব ভাই, ইফতি, আবির আর আতিক ভাই মিলে একদম জমিয়ে ফেলেছিল। বেচারা নুর অবশ্য মাঝেমাঝে সবার থেকে ঘষামাজা খাচ্ছিলো। এভাবেই চলতে থাকাকালীন হঠাৎ আরিফ ভাই বলে বসলেন, এই গল্প গুজব সর্বোচ্চ রাত ১১ টা পর্যন্ত চলবে। আমরা কেউ কিছু বলার আগেই পলাশ নিজে থেকেই বলে উঠলো যে ১১ টা না, রাত ১২ টা পর্যন্ত চলবে আজ। পলাশের মুখে এমন কিছু কেউ ই আশা করিনাই । মনে হয় সব সেই সাদা কাথার কারসাজি।  

যাইহোক, বিছানা গুছিয়ে সবাই মোটামুটি ১২ টার মধ্যেই শুয়ে পরে। কয়েকজন বাইরে গল্প করতে যায়। আমিও ভাবলাম, আবার কবে আসবো, যাই কিছু সময় বাইরে কাটিয়ে আসি। বাইরে বের হয়ে দেখি সেই লেভেলের জোছনা। আহা, মনটাই ভরে গেলো। প্রায় ঘরের সামনেই সোলার লাইটের আলো জ্বালানো। লাইটগুলো না থাকলে আরো ভালো হতো। এর মধ্যেই পাড়ার শেষ মাথা পর্যন্ত হেঁটে আসলাম। এসে আমাদের ঘরের সামনে থাকা বেঞ্চে শুয়ে থাকলাম। আহা, সেই শান্তি। মাঝেমধ্যে এভাবে পাহাড়ে এসে শুয়ে থাকলে মন্দ হতো না। শুয়ে শুয়ে নভেম্বর মাসের অফ ট্রেইল এর ষষ্ঠ পর্ব নিয়ে লিখতে শুরু করলাম। দেখি এক/দেড় ঘণ্টা টানা লিখতে পারলে একটি পর্বের অনেকটাই শেষ করে দেয়া যাবে। হঠাৎ নুর এসে ডাক দিলো। বললো, চলেন হেঁটে আসি। বললাম, নাহ একটু শুয়ে থাকি। এভাবেই প্রায় একঘন্টা শুয়ে লিখে যাচ্ছিলাম। 
 
হঠাৎ বাইরে থাকা বাকিদের আমার দিকে আসার আওয়াজ শুনতে পাই। ওরা এই ঘরের ই পাশের বারান্দায় গল্প করতেছিলো। আমাকে দেখে তারা অবাক হয়ে জানতে চাইলো আমি একা কি করছি এখানে। বললাম গল্প লিখি । সবাই ধরে বসলো সন্ধ্যার মত পাহাড়ের উপরে গিয়ে বসবে। বললাম চলো যাই। আবির, নুর, ইফতি, শালদা আর আমি। উপরে একটি স্কুল আছে। যদিও বন্ধ, সেটার বারান্দাতেই বসলাম। বসে সবাই সবার বিভিন্ন গল্প করছিলাম। বিশেষ করে আমাদের এই গ্রুপে কে কিভাবে আসলো সেটার কাহিনী শুনতেছিলাম। এটার সাথে সবাই ই আরো অন্য কিছু ও বলে যাচ্ছিলো। সবার যে এত সুন্দর সুন্দর কাহিনী থাকতে পারে, না শুনলে বুঝতে পারতাম না। যেহেতু পরেরদিন ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই, তাই কারো ঘুমাতে যাওয়ার ও কোন ইচ্ছে নেই। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প গুজব শেষে আমরা ঘরে ফিরে যাই। 
 
সকালে ঘুম থেকে উঠে ডিম ও সাথে থাকা বিস্কুট দিয়ে সকালের নাশতা সেরে নেই। একেবারে থানচি পৌঁছে ভারী খাবার খাওয়া হবে। নাস্তা শেষে সবাই কফি নিয়ে বসলাম। কফি খেতে খেতে গানের আসর বসে গেলো। কিসের কি ফিরে যাওয়া, সবার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কেউ কোথাও যাচ্ছে না আজ, এভাবেই অলস সময় কাটানো হবে। কি যে একটা ট্রিপ হলো এবার, এর রিল্যাক্স কোন ট্রিপে করিনি এখন পর্যন্ত। তবে এটা ঠিক এমন গ্রুপ না হলে এত রিল্যাক্স কোনোভাবেই হতো না । 
 
মোটামুটি সাড়ে নয়টায় আমরা রওয়ানা হই। ফিরে আসার গল্প আর বলতে চাই না। কারণ ট্যুর শেষ হয়ে যাওয়া কখনোই ভালো লাগে না। আবার এটাও ঠিক, একটি ট্যুর শেষ হয় বলেই আরেকটি ট্যুরে যেতে পারি। এবারের ট্যুরের পরে বাংলাদেশ এর টপ টেন শেষ করতে শুধু কেওকারাডং বাকি থাকবে। যদিও হাজরা হাফং কেও অনেকেই টপ টেন এর মধ্যে হিসেব করে থাকে। সে হিসেবে এটাও সামিট করতে হবে। তবে কেন যেন এই কেওকারাডং আমার বারবার বাকি থেকে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক জানুয়ারির মধ্যে সেরে ফেলবো ইনশাআল্লাহ, একটা দৌড়ের উপর ট্যুর দিয়ে আসবো ।  
সমাপ্ত।

আব্দুল কাইউম খান মামুন

২য় পর্ব

https://gramnagarbarta.com/news/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%82-%E0%A6%85%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8-14304?fbclid=IwAR1BqOISDKPlScYR4icpW1nZ6GjZkH3iB9tfpsokNbH0D0fcBeG4Nf71oGE

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত