বড় চুক্তি নয় সই হবে কিছু রুটিন এমওইউ

শেখ হাসিনার ভারত সফরে গুরুত্ব পাবে স্থিতিশীলতা নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:৫৭ |  আপডেট  : ২৫ মার্চ ২০২৪, ০২:৩৯

চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আগামী ৫ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লি যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে শেখ হাসিনার এ সফরটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। কূটনীতিক সূত্র বলছে, প্রায় তিন বছর পর প্রধানমন্ত্রীর সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বোঝাপড়া, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি, বাংলাদেশ ও ভারতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটে বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের দুই শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠককে সামনে রেখে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত দুই দেশের কর্মকর্তারা। সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে চলছে বিভিন্ন ধরনের চুক্তি ও সমঝোতার প্রস্তুতি। তবে প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে তিস্তার পানিবণ্টনের মতো বড় কোনো চুক্তির সম্ভাবনা নেই। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আসন্ন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে গুরুত্ব পাবে স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ইস্যু।

ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগেই দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক এগিয়ে নিতে বৈঠক করে ফেলেছেন দুই দেশের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা। ভারতের দেওয়া ঋণে তাদের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার একটি তালিকাও হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে ২০১৯ সালে চুক্তি হয় ভারতের সঙ্গে। ওই ঋণের আওতায় ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম কিনবে বাংলাদেশ। গত জুলাইয়ে ভারতের সেনাপ্রধান যখন ঢাকা সফর করেন তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে বিষয়টি ওঠে বলে জানা যায়।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে মেরিটাইম সিকিউরিটির জন্য ভারত থেকে রাডার কেনা নিয়েও কথা হবে। এ ছাড়া আলোচনার টেবিলে থাকবে উপ-আঞ্চলিক এনার্জি হাব গঠন বা বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটানকে নিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। যার নেতৃত্বে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশ নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনতে চায়। একই সঙ্গে এ অঞ্চলে জ্বালানি নিরাপত্তা কানেকটিভিটি বিষয়টি নিয়েও কাজ করতে চায় যৌথভাবে। এ জন্য ভারতের ভূমি ব্যবহার করে নেপাল ভুটান যাতায়াত চায় বাংলাদেশ।

এবার প্রধানমন্ত্রীর সফরের অর্থনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তি, সেপা (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট)। এ চুক্তি হলে ভারত ও বাংলাদেশের পণ্য দুই দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা পাবে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে এ চুক্তি অনুমোদন করেছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ এন্টি ডাম্পিং নীতি নিয়েও কথা বলবে।

সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হলে এ অঞ্চলে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টিও বাংলাদেশ তুলবে। এর বাইরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে দুই দেশ আলোচনা করবে। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিককালে মার্কিন-চীন বলয়ের প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গটি আলোচনায় উঠতে পারে। এ ছাড়া করোনা সংক্রমণের প্রবল ঢেউ চলাকালে রেলে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রেখেছিল ভারত।

ভারত এবার প্রস্তাব দিয়েছে, চাল, গম, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করে, সেগুলোর চাহিদার বিষয়ে আগাম জানাতে হবে। ভারত নিজের চাহিদা মেটানোর পর বাংলাদেশের প্রয়োজনের বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখবে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, দুই প্রতিবেশী দেশের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বাণিজ্য, জ্বালানি, পানিবণ্টন, সংযুক্তি ও নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পাবে। প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে বেশকিছু এমওইউ সই করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। যেসব এমওইউ সইয়ের জন্য চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে সেগুলো স্বাক্ষর হবে। কারণ কোনো কোনো এমওইউ খসড়া প্রস্তুতির কাজ এখনো শেষ হয়নি। কোনোটির আইনি ভেটিং ও মন্ত্রিসভায় অনুমোদন সম্পন্ন হয়নি। এসব নিয়ে পুরোদমে প্রস্তুতি চলছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরকালে বড় ধরনের কোনো চুক্তি হচ্ছে না। রুটিন এমওইউ সই হবে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে দুদেশের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক হলেও বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না বলে জানা গেছে। জেআরসি বৈঠকে তিস্তা চুক্তি দ্রুত সম্পাদনের তাগিদ দেওয়া হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে বরাবরের মতো আশ^াস মিলেছে। আবার কুশিয়ারা নদী থেকে উভয় দেশ শুকনো মৌসুমে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলনের লক্ষ্যে একটি খসড়া এমওইউ প্রস্তুত করেছে। কুশিয়ারা এমওইউ ভারতের মন্ত্রিসভায় অনুমোদন লাভ করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে তা সই হতে পারে।

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর সফরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসছে। উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী আগামী ৬ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে এ ঘোষণা দেবেন। আবার ভারত ২০০৬ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের বিশেষ কর্মসূচির আওতায় বৃত্তি দিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরের সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয়দের সম্মান জানাতে মুজিব স্কলারশিপ ফর ওয়ার ভেটারেনস ফ্যামিলি নামের বৃত্তি চালুর ঘোষণা দেবেন। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কয়েকজনের হাতে এ বৃত্তি তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে।

ভারতের কূটনৈতিকগুলো বলছে, শেখ হাসিনার সফরে ভারতবিরোধী কাজে জঙ্গিরা যেন বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার না করতে পারে তার নিশ্চিয়তা চাইবে দিল্লি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেন বাংলাদেশে আশ্রয় না পায় এবং রোহিঙ্গারা যেন বাংলাদেশ থেকে সে দেশে ঢুকে না পড়ে সেটিও তাদের চাওয়া। এ ছাড়া চীনের কথায় ভারতের স্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ যেন ঢাকা না নেয় তা চাওয়া থাকবে ভারতের। বাংলাদেশের কাছে পরিশোধিত ডিজেল রপ্তানি করতে চায় ভারত। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সফরে অগ্রগতির সম্ভাবনা রয়েছে।

সফর সূচি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ সেপ্টেম্বর ভারতে পৌঁছাবেন। ওই দিন বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হোটেলে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রেসিডেন্ট ভবনে গার্ড অব অনার দেওয়া হবে। এর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দিল্লির রাজঘাটে গিয়ে ভারতের মহান নেতা মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। পরে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একান্তে এবং প্রতিনিধি পর্যায়ে বৈঠক করবেন। এর পর দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তালিকায় থাকা সমঝোতা স্মারক সই হবে। একইদিন ভারতের প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদি মুর্মু ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জগদীপ ধনকড়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন শেখ হাসিনা। ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের বিভিন্ন কোম্পানির সিইও এবং ব্যবসায়ী কমিউনিটির সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করবেন। ওই দিন দুপুরে তিনি দিল্লি থেকে রাজস্থানে আজমির শরিফ দরগাহে যাবেন। সেখানে মাজার জিয়ারত শেষে পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত