শুয়োরের ঘরে অসুর  

  আখতার হোসেন 

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২১, ১২:৪৭ |  আপডেট  : ২ মে ২০২৪, ১৫:২৯

শুয়োরের বাচ্চাগুলো একটা আরেকটার সাথে ল্যাপ্টালেপ্টি করে গা এলিয়ে রোদ পোহাচ্ছে। অঘ্রাণের শেষে একটু একটু শীত ছড়িয়ে পৌষ জানান দিচ্ছে, ‘আমি আসছি।‘ দুই হাত দূরেই চারটা বাঁশের খুঁটার মাঝখানে দড়ি দিয়ে বুনন করা ছোট্ট খাটিয়াতে বসে আয়েশ করে লাল চান রবিদাসও রোদ পোহাচ্ছে শুয়োরের বাচ্চাগুলোর সাথেই। আর, মাঝে মাঝে গুড়ুক গুড়ুক শব্দ করে হুঁকোর মুখে মুখ লাগিয়ে তামাক পোড়া ভেজা ধোঁয়াটা বেশ আয়েশ করে ফুসফুসের ভেতর টেনে নিচ্ছে। পাশেই বসে আছে মঙ্গল সাঁওতাল। দুজনই পালা করে হুঁকোর স্বাদ নিচ্ছে।  লাল চান রবিদাস আর মঙ্গল সাঁওতাল জাতে আলাদা; কিন্তু ওদের সুখ দুঃখ অভিন্ন। যে কারণে লাল চান রবিদাস কষ্ট পায়, একই কারণে মঙ্গল সাঁওতালও কষ্ট পায়; কখনো আনন্দ পায় না। যে ঘটনায় মঙ্গল সাঁওতাল দুঃখে কেঁদে ফেলে, সে ঘটনায় লাল চান রবিদাসও কাঁদে, কখনো হাসে না।   

কেন যে শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা রেগে গেলে ‘শুয়োরের বচ্চা’, ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দেয়, বুঝতে পারে না লাল চান রবিদাস। হুঁকাতে টান দিতে দিতে মঙ্গল সাঁওতালকে প্রশ্নটা করেই বসে লাল চান রবিদাস, ‘আচ্ছা, বলতে পারিস, শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা রেগে গেলে কেন শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দেয়?’

-আরে বোকা, যারা দুব্বল, যাদের কোনো ক্ষ্যামতা নাই, যারা অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকে, তাঁদেরকে এ গালিগালাজ শুনতেই হবে…; আরে এ তো আশিব্বাদ রে, আশীব্বাদ…’ হুঁকোটা হাতে নিতে নিতে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কথাটা বললো মঙ্গল সাঁওতাল। 

-গালি গালাজ শোনা আশিব্বাদ… ‘ অবাক হয়ে বললো লাল চান রবিদাস। 

হুঁকোতে টান দিয়ে আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মঙ্গল সাঁওতাল বললো, ‘তা নয় তো কি! এই শুয়োরের বাচ্চা বলে যে তোকে গালি দিলো, তার মানে হলো তোর অস্তিত্ব স্বীকার করলো। আরে যাদের গালি দেয় না তারা তো কিছুই না, তারা হলো গিয়ে পিঁপড়া রে পিঁপড়া, তেলাপোকা! এই গালিটা আশীব্বাদ নয়…?  ’

মঙ্গল সাঁওতালের কথা অবাক হয়ে শোনে লাল চান রবিদাস। হতে পারে মঙ্গলের কথাই ঠিক! ভগবানই তো সব ঠিক করে রেখেছে। আমাদের সব কিছুই তো ভগবানের হাতে। আমাদের এই নীচু জাতে জন্ম এটাও তো ভগবানেরই ইচ্ছা। ভগবানের লীলা খেলা কে বোঝে! আসলেই তো, আমরা আছি বলেই তো শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিচ্ছে! না থাকলে কি দিতো? তবু একটু খারাপ লাগে। আহা, শুয়োরের বাচ্চাগুলো কতো সুন্দর! কতো নিষ্পাপ! দেখলেই মনে হয় কোলে নিয়ে আদর করি। একেক সময় লাল চান রবিদাসের মনে হয়, শিক্ষিত ভদ্রলোকদের বলে, আমি অপরাধ করেছি, বেয়াদবি করেছি, আমার উপরে রাগ করেন। আমাকে আমার নাম ধরে গালি দেন, বলেন, এই রবিদাস, তুই হলি গু, তুই হলি মুত, তুই হলি নর্দমা, তুই হলি পচা কাদা, তুই হলি ভেদবমি…। আপনারা শুয়োরের বাচ্চার উপর সব রাগ ঝেড়ে দেন কেন? অন্যায় তো আমি করেছি, শুয়োরের বাচ্চা আর কুত্তার বাচ্চাদের উপর রাগ করা কি ভালো দেখায়? আহারে, বাচ্চাগুলো কী সুন্দর! 

বাপ-দাদাদের পর সে নিজে---এই তিন পুরুষ ধরে এই জায়গায় তারা বাস করছে, চাষ করছে। এখন হঠাৎ চিনি কলের সাহেবরা বলছে, এ যায়গা নাকি তাঁদের, চিনিকলের। এখানে চিনিকলের জন্য আখের চাষ হবে। ভারি আশ্চর্যের কথা! লাল চান রবিদাসদের আর মঙ্গল সাঁওতালদের এখান থেকে সরে যেতে হবে। কোথায় সরে যাবো আমরা? চিনিকলের সাহেবেরা সরকারি কাগজপত্র দেখাচ্ছে, কিন্তু মঙ্গল সাঁওতাল আর লাল চান রবিদাসের কাছে কোনো কাগজ পত্র নেই। কাগজপত্র থাকবে কি করে? এই মাটিতে তিন পুরুষ ধরে আছে, এই মাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে! কেউ কখনো কোনো কাগজ পত্র দেয়ওনি, চায়ওনি। এই নিয়ে বড় হুজ্জতি চলছে। বড় বড় শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা আসে। মাঝে মাঝে পুলিশও আসে। কথাবার্তা বলে যায়। যায়গা ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু, এই তিন পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে কোথায় যাবে মঙ্গল সাঁওতাল আর লাল চান রবিদাসেরা? 

লাল চান রবিদাস শুনেছে, দেশের রাজার নাম পাল্টেছে। দেশের রাজার নাম এখন সরকার। আগে যারা রাজা-জমিদার ছিলো, তারাই এখন সরকার নাম নিয়েছে। লাল চান রবিদাস সেদিন মঙ্গল সাঁওতালকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘আচ্ছা মঙ্গল, তুই জানিস সরকার কাকে বলে?’

মঙ্গল সাঁওতাল বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়েছিলো, ‘বড় বড় শিক্ষিত সাহেবেরা বেশি কথা বলা পছন্দ করে না, সব কিছু সংক্ষেপে বলে। এই যেমন সরকার। সরকার হলো দুধ জ্বাল দেবার পর দুধের উপর যে সর পড়ে, সেই সরের কারখানা। সরের কারখানা বা সর কারখানাকে উনারা ছোট্ট করে সরকার বলে…।’ মঙ্গল সাঁওতাল সরকারের এমন সংজ্ঞা কোথা থেকে শুনেছে কে জানে! লাল চান রবিদাস অবাক হয়ে শুনে যায়। 

চার পাঁচ বছর পর পর সারা দেশে সাড়া পরে যায়। ভোট ভোট একটা উৎসব হয়। দেশের মানুষ ভোট দেয় কারা সরকার হবে, কারা সরকার চালাবে। এইটা লাল চান রবিদাসের খুব ভালো লাগে। এই ভোটের মাধ্যমে ঠিক করা হয় এই সর কারখানা কারা চালাবে। কিন্তু, কি যে হয় বুঝতে পারে না লাল চান রবিদাস। যখনই ভোট শেষ হয়,সর কারখানার মানুষ ঠিক হয়ে যায়, তখনই ওদের উপর হামলা হয়। কে করে, কারা করে, কেন করে বুঝতে পারে না। ভোট এলে যেমন আনন্দ হয়, তেমনই ভয়ে আশংকায় বুকটা কেঁপেও ওঠে। শিক্ষিত ভদ্র মানুষগুলো তখন হিংস্র হয়ে ওঠে। ঘর দোরে আগুন লাগিয়ে দেয়, লুটপাট করে, নির্যাতন করে, কে মা কে বোন এসব হিসেব করে না। 

  লাল চান রবিদাসের খুব চিন্তা হয় তাঁর বিধবা বড় বোনটাকে নিয়ে। ফুলমতি ওর নাম। ফট করে কথা নেই বার্তা নেই, দুই দিনের জ্বরে মরে গেলো স্বামীটা। রেখে গেলো বারো বছর বয়সের মেয়েটাকে, সন্ধ্যামণিকে। স্বামীর ওইটুকুই ভিটে! ওটাও যদি হারায়, তাহলে যে ফুলমতিও হারিয়ে যায়! লাল চান রবিদাস বলেছে, ‘দিদি, কি আর করবে! কপালের লিখন আর ভগবানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো কিছুই করা যায় না। বলি কি আমার কাছে এসে থাকো…’। 

ছোট ভাইটারও তো অনেক কষ্ট। তাকেও লড়াই করতে হচ্ছে তাঁর ভিটে রক্ষার জন্য। বড় বোন হয়ে নিজের সুখের জন্য ফুলমতি ছোট ভাইকে কষ্ট দিতে চায়নি। এক বেলা খেয়ে হোক, না খেয়ে হোক, স্বামীর ভিটেকেই শেষ আশ্রয় মনে করেছে। মনে করেছে স্বামীর এই আমানত তাঁকে রক্ষা করতেই হবে। ফুলমতি এখানে আছে বলেই চতুর লোলুপ শৃগালের মতো মানুষগুলো চারপাশে ঘুর ঘুর করে। আর না থাকলে তো একদিনেই বেহাত হয়ে যাবে এই ছোট্ট ভিটেটুকু। 

সব চেয়ে বেশি ভয় লাগে ভোটের সময়ে। তখন যে কি হয়! কদিন খুব ভয়ে ভয়ে থাকে ফুলমতি। আবারও সেই ভোট এসেছে। ফুলমতি দিশেহারা হয়ে যায়। সবাইকে ভালো মনে হয়। আবার সবাইকে সন্দেহ হয়। কাকে ভোট দেবে? প্রতিবার ভোটের পর হামলা চলে, তান্ডব চলে। কেন চলে বোঝে না ফুলমতি। 

একবার মনে করেছিলো এবার ভোটের আগে দু তিন দিনের জন্য ছোট ভাইয়ের বাসায় চলে যাবে। আবার কি ভেবে কিসের মায়ায় সিদ্ধান্ত পাল্টায় ফুলমতি। যা হয় হোক, স্বামীর এই শেষ আশ্রয়েই থাকবে। 

বারো বছরের মেয়েকে নিয়ে বত্রিশ বছরের বিধবার দিন আর রাত কি ভাবে কাটে, তা বোধ হয় ভগবানও জানে না। ভোটের দিন তো ভালো মতোই পার হলো। মনে হলো বিপদ বোধ হয় কেটেই গেলো। কিন্তু পর দিনই পাঁচ জন একসাথে হামলে পড়লো ফুলমতির জরাজীর্ণ কুঁড়ে ঘরে। 

-অ্যাই হারামজাদি, শুয়োরের বাচ্চা…’ সামনে থাকা একজন বললো। 

বারো বছরের সন্ধ্যামণি ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। একজন হ্যাঁচকা টানে মেয়েটাকে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিলো। চীৎকার করে কেঁদে উঠলো সন্ধ্যা মণি।

-বাবারা, তোমরাই তো বললে, শুয়োরের বাচ্চা! আসলেই ও বাচ্চাই। এক সাথে সবাই যেয়ো না, মেয়েটা আমার মরে যাবে…একজন একজন করে যাও…। বাবারা আমিও আছি, তোমাদের ইচ্ছা হলে আমার সাথেও…’ এইটুকুই বলতে পারলো ফুলমতি, সন্ধ্যামণির মা, লাল চান রবিদাসের বড় বোন।
 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত