শতাব্দীর শেষভাগে সক্রিয় সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬:০০ |  আপডেট  : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:৪৩

সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক

বাংলা সাহিত্যের 'সব্যসাচী লেখক'  সৈয়দ শামসুল হক (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) এর আজ জন্মদিন। শতাব্দীর শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী সাহিত্যিক তিনি। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাকে 'সব্যসাচী লেখক' বলা হয়। তার লেখকজীবন প্রায় ৬২ বছর ব্যাপী বিস্তৃত। স্বাধীন বাংলাদেশে যে কজন ঔপন্যাসিক উপন্যাস-সাহিত্যের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের নামগুলোকে যদি একটি সারিতে বদ্ধ করা হয়, তাহলে সৈয়দ শামসুল হককে প্রথম সারিতেই থাকেন। 

সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক এবং ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

বাবা মারা যাবার পর অর্থকষ্টে পড়লে চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন তিনি। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাটির পাহাড় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেন। পরে তোমার আমার, শীত বিকেল, কাঁচ কাটা হীরে, ক খ গ ঘ ঙ, বড় ভাল লোক ছিল, পুরস্কারসহ আরও বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেন। বড় ভাল লোক ছিলপুরস্কার নামে দুটি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন ।

সৈয়দ শামসুল হকের ভাষ্য অনুযায়ী তার রচিত প্রথম পদ তিনি লিখেছিলেন এগারো-বারো বছর বয়সে। টাইফয়েডে শয্যাশায়ী কবি তার বাড়ির রান্নাঘরের পাশে সজনে গাছে একটি লাল টুকটুকে পাখি দেখে দু’লাইনের একটি পদ "আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/ তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে" রচনা করেন। এরপর ১৯৪৯-৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে ব্যক্তিগত খাতায় ২০০টির মতো কবিতা রচনা করেন।কবিতায় রয়েছে তাঁর গভীর অনুপ্রেরণা। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ একদা এক রাজ্যে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। পরে বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা, পরাণের গহীন ভেতর, নাভিমূলে ভস্মাধার, আমার শহর ঢাকা, বেজান শহরের জন্য কোরাস, বৃষ্টি ও জলের কবিতা কাব‌্যগ্রন্থগুলো তাকে পাঠকমহলে জনপ্রিয় করে তুলে। সৈয়দ হক মৃত্যুর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে তার শেষ কবিতা লিখেন। কবিতার নাম আহা, আজ কি আনন্দ অপার!

সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে। ফজলে লোহানী সম্পাদিত 'অগত্যা' পত্রিকায়। সেখানে 'উদয়াস্ত' নামে তার একটি গল্প ছাপা হয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ১৯৫৬ সালে প্রথম উপন্যাস দেয়ালের দেশ প্রকাশিত হয়। তার রচিত এক মহিলার ছবি (১৯৬১), অনুপম দিন (১৯৬২), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪) উপন্যাসগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে।

সৈয়দ শামসুল হকের খেলারাম খেলে যা একটি অবিস্মরণীয় উপন্যাস। যৌনতা আর শরীরী সম্পর্কের বিস্তৃত বিবরণের জন্য প্রকাশের পরপরই এ উপন্যাস নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অশ্লীলতার অভিযোগে লেখককে প্রচুর নিন্দামন্দ শুনতে হয় এ জন্য। তিনি উপন্যাসের ভূমিকায় এই উপন্যাসকে 'এদেশের সবচেয়ে ভুল বোঝা উপন্যাস' হিসেবে অভিহিত করেছেন। ‘এটি বাংলা সাহিত্যের একটি সময় অতিক্রমী বা টাইম অ্যাডভান্সড্ উপন্যাস। যে তরুণ বা তরুণী অল্প বয়সে এই উপন্যাস পড়ে লজ্জা অনুভব করতেন, তিনিই এখন পরিণত বয়সে এর ভেতরে খঁুজে পান মানবজীবনের গভীর দার্শনিকতা, অস্তিত্বের রহস্যময়তা ও কালস্রোতে কুটোর মতো ভেসে যাওয়া বেদনাহত জীবন। 

বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ, নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান,দ্বিতীয় দিনের কাহিনী সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস । দ্বিতীয় দিনের কাহিনী তিনি লেখেন ১৯৭৪ সালে, লন্ডনে। বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালি জীবনের বিপ্লবাত্মক রূপান্তর সৈয়দ শামসুল হকের মধ্যেও নবচেতনার সঞ্চার করে। স্বাধীন ভূখণ্ড, মানচিত্র, স্বতন্ত্র পতাকা আর বহিঃশত্রু বিতাড়নই যে যথেষ্ট ছিল না, তা সৈয়দ হক অনুভব করেছেন গভীরভাবে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অনেক লেখায় জাতীয় জীবনের এই গভীরতর সংকটের প্রতিফলন ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে চমৎকারভাবে চিহ্নিত করেছেন তিনি দ্বিতীয় দিনের কাহিনী উপন্যাসে। বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়, সংগ্রাম, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার কথা পরম মমতায় তুলে ধরেছেন। 

সৈয়দ হক নাট্যকার হিসেবেও সফলতা পেয়েছেন। বিবিসি বাংলায় নাটকে কাজ করার মাধ্যমে তিনি নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি পান। তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত একটি কাব্য নাটক। তার পরের নাটক নুরুলদীনের সারাজীবন ফকির বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত। সৈয়দ হক তার রচনায় সমসাময়িক বাংলাদেশ এবং মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি ও ভালো-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরেন। তার অন্যান্য নাটক নারীগণ, যুদ্ধ এবং যোদ্ধা, ঈর্ষা, এখানে এখন-এ সমকালীন বাস্তবতা ফুটে ওঠেছে।

২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এই যশঃসম্পন্ন কবি ও লেখক পরলোকগমন করেন। কিন্তু তার লেখা সাহিত্য পাঠকের মনে  অনেকটা সময় ধরে জুড়ে থাকবে । তার দৃষ্টিভঙ্গি, দেশপ্রেম, সমসাময়িক চিন্তা ও নবচেতনা, জীবনবোধ তার লেখাকে  পাঠক হৃদয়ে এক অবিস্মরণীয় জায়গা করে দিয়েছে।

 

সা/ই

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত