রাষ্ট্রপতির ভাষণ দিয়ে শুরু হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ১৭:১৫ |  আপডেট  : ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:১৮

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নতুন সরকার গঠন করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। নতুন সংসদের এমপিদের নিয়ে আজ (৩০ জানুয়ারি) বিকেল ৩টায় শুরু হয়েছে প্রথম সংসদ অধিবেশন। ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. শামসুল হক টুকু অধিবেশনের সভাপতিত্ব করছেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ গতবারের মতো এবারও স্পিকার হিসেবে শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং ডেপুটি স্পিকার পদে শামসুল হক টুকুকে মনোনীত করেছে। এর ফলে অধিবেশনের প্রথমদিনে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের ভোটের পর তাদের শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি।

রাষ্ট্রপতির ভাষণের মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু  হয় ।  তিনি মঙ্গলবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। জাতিসংঘসহ ২৫টির অধিক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সংগঠনে বাংলাদেশ সক্রিয় সদস্য। প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি আমরা। পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ও ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক। 

তিনি আরও বলেন, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশের সংবিধানে ১৮ক অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছে। দেশের পরিবেশ দূষণরোধ ও সংরক্ষণে নানাবিধ আইন, নীতি, বিধিমালা ও নির্দেশিকা প্রণয়ন ও হালনাগাদপূর্বক তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে সুরক্ষার লক্ষ্যে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান ২০২২-২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি ভাষণে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরের কাজে আত্মনিয়োগ করেন, তখনই একটি কুচক্রী মহল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন ও প্রগতির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। তবে গত দেড় দশকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। এ সময় আমরা দারিদ্র্যের হার ৪১.১ থেকে ১৮.৭ ভাগে হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছি। বেকারত্বের হার ২০১০ সালে ছিল ৪.১০ শতাংশ, যা কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩.২ শতাংশে। আমাদের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৪৫ ভাগ, যা আজ ৭৬.৮ ভাগে উন্নীত হয়েছে; আয়ুষ্কাল মাত্র ৫৯ বছর থেকে প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। মাতৃমৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে, শিশুমৃত্যু হার হ্রাসে সাফল্যের কারণে বাংলাদেশ পেয়েছে এমডিজি পুরস্কার, চিকিৎসাসেবা আজ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।

তিনি বলেন, করোনা অতিমারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সত্ত্বেও গত প্রায় দেড় দশক ধরে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬.৭ শতাংশের অধিক। এ সময়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৭৯৩ মার্কিন ডলার এবং জাতীয় বাজেটের আকার ৯ গুণের অধিক বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি আয় প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৫৫ দশমিক পাঁচ-ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি করে বর্তমান অর্থবছরে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে, যার মোট উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ৬১ লাখ। এর মধ্যে বর্তমানে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ৫৮ লাখ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ, প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ, বীর মুক্তিযোদ্ধা উপকারভোগীর সংখ্যা ২ লাখ ৪০ হাজারের অধিক এবং প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তির উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের লক্ষ্যে গত বছর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সরকারি চাকরিজীবী ব্যতীত ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে দেশের সকল নাগরিকের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, কৃষি জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও সরকারের বিভিন্ন কৃষিবান্ধব নীতির কারণে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্য উৎপাদনে আজ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। ধান, ভুট্টা, আলু, সবজি, সরিষাসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দেশে বর্তমান বার্ষিক খাদ্যশস্য উৎপাদন ৪৯২ লাখ টন। এর ফলে বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও দেশে খাদ্য নিরাপত্তা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ ধান, সবজি, ও স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং ইলিশ আহরণে প্রথম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। 

'বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ ২৯ হাজার ৭২৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। ইতোমধ্যে শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য মর্যাদাপূর্ণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকাংশ স্থাপনার নির্মাণকাজ এবং পরমাণু জ্বালানি হস্তান্তর সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি, এ বছর এ কেন্দ্র হতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।'

তিনি বলেন, গত দেড় দশকে যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছে। আইকনিক পদ্মা সেতু, পায়রা সেতু, দ্বিতীয় মেঘনা, দ্বিতীয় গোমতী প্রভৃতি অসংখ্য সেতুসহ সড়ক, মহাসড়ক নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। জেলা, আঞ্চলিক ও জাতীয় পাকা মহাসড়কের পরিমাণ প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি করে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার এবং গ্রামীণ সড়কের পরিমাণ ৭৬ গুণ বৃদ্ধি করে প্রায় ২ লাখ ৩৮ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করা হয়েছে।  ঢাকা শহরে জনগণের চলাচল সহজ ও নিরাপদ করতে এমআরটি লাইন-৬ উত্তরা হতে মতিঝিল পর্যন্ত চালু হয়েছে এবং এর কমলাপুর অংশের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশ যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের সফটওপেনিং করেছেন।

রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়েকে আধুনিক, যুগোপযোগী গণপরিবহন মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে দেড় দশকে রেলপথের পরিমাণ দেড় গুণ বৃদ্ধি করে ৩ হাজার ৪৮৬ কিলোমিটার করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের যাত্রীবাহী ক্যারেজ, লোকোমোটিভ, মালবাহী ভ্যান ইত্যাদি সংগ্রহ; রেললাইন, রেলসেতু, স্টেশন নির্মাণ, সিগনালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, নতুন বিদ্যমান ট্রেন সার্ভিস/রুট বর্ধিতকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের সক্ষমতা অনেকগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগ দ্রুত ও সহজীকরণ এবং এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের কাজ সমাপ্ত হয়েছে ও ভাঙ্গা-যশোর অংশের কাজ শুরু হয়েছে। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কক্সবাজার জেলার সঙ্গে ঢাকা থেকে সরাসরি রেলসংযোগ স্থাপিত হয়েছে।

তিনি বলেন, জেন্ডার সমতা এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে। নারীর ক্ষমতায়নে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসন-সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়েছে। সরকার জীবন চক্রভিত্তিক কাঠামোর আওতায় বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা, অসচ্ছল নারীদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় আনার জন্য ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট বাস্তবায়ন করছে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, সকলের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিতের স্বার্থে ১৯৯৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/সংস্থা হতে গৃহ নির্মাণের মাধ্যমে প্রায় ৮ লাখ ৫২ হাজার অসহায় ভূমিহীন, গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে নির্মাণাধীন ৩০ হাজার ‘বীর নিবাস’-এর মধ্যে প্রায় ১১ হাজারটির নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের যথাযথ মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতের স্বার্থে সরকার একাধিকবার ৪৩টি শিল্প সেক্টরের ন্যূনতম মজুরি হার নির্ধারণ/পুনঃনির্ধারণ করে দিয়েছে এবং আরও ১৩টি নতুন শিল্প সেক্টরের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর আমাদের ৫৩ বছরের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন। এর সুফল ভোগ করছে দেশের ১৭ কোটি জনগণ। বর্তমানে দেশের মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১৯.০৮ আট কোটি এবং ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১৩.১৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। দেশের টেলিডেনসিটি প্রায় ১০৮ শতাংশ এবং ইন্টারনেট ডেনসিটি প্রায় ৭৫ শতাংশ। বর্তমানে আইসিটি রপ্তানির পরিমাণ ১.৯ বিলিয়ন ডলার। ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের মূল্য জনগণের ক্রয়সীমার মধ্যে এসেছে। যা পূর্বে ২৭ হাজার টাকা ছিল, বর্তমানে ২৫০ টাকারও নিচে নেমে এসেছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং, প্রশাসন, উদ্ভাবন, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল অর্থনীতি, আইসিটি শিল্পসহ প্রায় সব খাতে সমানভাবে উন্নতি হয়েছে। বিগত বছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নে সাফল্যের স্বীকৃতস্বরূপ বাংলাদেশ ভূষিত হয়েছে অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে।

 

সা/ই

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত