রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১১ বছর- সঠিক বিচারের আশায় ভুক্তভোগীরা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৫ |  আপডেট  : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৭

১১ বছর আগে আজকের এই দিনে ধসে পড়েছিল সাভারের রানা প্লাজা। কয়েকটি পোশাক কারখানা নিয়ে গড়ে ওঠা ভবনটিতে ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন। আহত হন আরও প্রায় দেড় হাজার মানুষ। এত প্রাণহানির পেছনে দায় যাদের, তাদের বিচার এখনও শেষ হলো না। ২০১৩ সালের এই তিন মামলার বিচার কবে নাগাদ শেষ হবে তাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মকর্তারা। 

ভবন ধসে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় ওই সময় মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে অবহেলার কারণে মৃত্যু উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ, ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় একটি মামলা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও সম্পদের তথ্য গোপন সংক্রান্ত দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এর মধ্যে কেবল দুদকের দায়ের করা সম্পদের তথ্য গোপনের মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে। এর বাইরে ভবন নির্মাণে দুর্নীতির মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। বাকি দুটি মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও ইমারত আইনে দায়ের মামলা দুটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হয় ২০১৬ সালে। একই বছরের ১৫ মার্চ মামলা দুটি বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এবং বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। একই বছরের ১৬ জুন ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম মুস্তাফিজুর রহমান। এরপর ১৮ জুলাই হত্যা মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন তৎকালীন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান।

তবে অভিযোগ গঠনের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আট আসামি হাইকোর্টে আবেদন করেন। শুনানি শেষে প্রথমে আট জনের পক্ষেই স্থগিতাদেশ দেন আদালত। পরে ছয় জনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বহাল থাকে সাভার পৌরসভার ওই সময়কার মেয়র রেফায়েত উল্লাহ ও কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের পক্ষের স্থগিতাদেশ।

রানা প্লাজা ধসের পরদিন অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার এসআই আলী আশরাফ। ওই মামলায় সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া রানা প্লাজা ধসে নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যাকারী আখ্যায়িত করে আদালতে আরেকটি মামলা করেন গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার। আদালতের নির্দেশে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু মামলার সঙ্গে একীভূত করে তদন্ত করে সিআইডি। আদালতে দায়ের করা হত্যা মামলার বাদী শিউলি আক্তার এখন পুলিশের মামলার সাক্ষী। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। চার্জশিটভুক্ত ৪১ আসামিদের মধ্যে সোহেল রানা কারাগারে। রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বকর সিদ্দিক ও আসামি আবুল হোসেন জামিনে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন।

বর্তমানে ঢাকার জেলা দায়রা জজ হেলাল উদ্দিনের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে প্রায় ৮৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সর্বশেষ গত ২১ এপ্রিল মামলাটির ৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। আগামী ২৮ এপ্রিল মামলাটির পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য রয়েছে।

ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে ওই সময় সোহেল রানাসহ ১৩ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা  মো. হেলাল আহমেদ। সিআইডি তদন্ত শেষে এ মামলায় সোহেল রানা ও তার মা-বাবাসহ ১৮ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে।

১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ১২ ধারায় এই চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ মামলায় ১৩৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে ছিল। তবে সংশ্লিষ্ট আদালতের চার্জ গঠনের আদেশের বিরুদ্ধে কয়েকজন আসামি রিভিশন করায় সাক্ষ্যগ্রহণ আটকে আছে।

ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা সম্পর্কে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল জানান, গত বছরের ১৯ নভেম্বর ঢাকার সাবেক জেলা ও দায়রা জজের বিচারক এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালত বিচারিক ক্ষমতা বলে হত্যা মামলাটির পাশাপাশি ইমারত নির্মাণ আইনের মামলাটিও নিয়ে যায়। যাতে পাশাপাশি দ্রুত এই দুই মামলার বিচারকাজ শেষ হয়। তবে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মামলাটি যাওয়ার পরও এখন পর্যন্ত কোনও তারিখ পড়েনি। বর্তমানে মামলাটি হাইকোর্টে স্থগিত রয়েছে। ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি যে পর্যায়ে ছিল এখানেও সেই পর্যায়েই রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ২০১৬ সালের ১৪ জুন মামলাটির চার্জগঠন হয়। চার্জগঠনের পর পরেই মামলাটি হাইকোর্টে চলে গেছে। এজন্য একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই মামলায় আসামির সংখ্যা ১৬ জন। এই মামলায় সবাই জামিনে রয়েছে।

বর্তমানে মামলাটি ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক এস এম জিয়াউর রহমানের আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। এ মামলায় মোট ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেছেন আদালত। সর্বশেষ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক এম এ মফিদুল ইসলামের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। তবে তার জেরা শেষ না হওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান রয়েছে। আগামী ২৮ এপ্রিল জেরা ও পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।

এদিকে আসামি সোহেল রানার পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, এটা একটি দুর্ঘটনার মামলা। সেই মামলায় রানা ১১ বছর ধরে জেল হাজতে রয়েছে। জামিন পাচ্ছে না। বাকি সবাই জামিনে আছে। মামলার রায়ে যা হওয়ার তা-ই হবে। এভাবে বিনা বিচারে ১১ বছর জেলে থাকা মানবিক দিক থেকে অন্যায়। তাই আদালতের উচিত মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ করা, নয়তো আসামিকে জামিন দেওয়া। আশা করছি মামলায় রায়ে রানাসহ অন্য আসামিরা খালাস পাবেন।

ইমারত নির্মাণ আইনে অভিযুক্ত আসামিরা হলেন—ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার মেয়র রেফায়েত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল, আমিনুল ইসলাম, নিউওয়েব স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটর ও রেজাউল ইসলাম।

মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আবদুল খালেক ওরফে কুলু খালেকসহ ৫৯ জনকে আসামি করা হয়। তবে আসামিদের মধ্যে ১৭ জনের নাম উভয় মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ থাকায় ব্যক্তি হিসেবে আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৪১ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ৫৯৪ জনকে। ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ১৩৫ জনকে।

এই তিন মামলার বাইরে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলাটিই কেবল নিষ্পত্তি হয়েছে। এ মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার বিশেষ জজ-৬-এর বিচারক।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা নামের ভবন ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যান। ধ্বংসস্তূপ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার হয়। উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে ৮৪৪টি স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা রেখে ২৯১ জনের অশনাক্ত লাশ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। উদ্ধারকৃত জীবিতদের মধ্যে ১ হাজার ৫২৪ জন আহত হন। তাদের মধ্যে পঙ্গুত্ববরণ করেন ৭৮ জন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত