রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ক দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় (১৯২৭ — ২০১৮)

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪:৫৩ |  আপডেট  : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫৫

রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় গায়ক দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় (১২ই নভেম্বর ১৯২৭ — ২৪শে ডিসেম্বর ২০১৮) । আজ তার মৃত্যু বার্ষিকী ।‌তিনি একজন ভারতীয় সুরকার ও গায়ক, যাঁর সংগীতজীবন ছয় দশক ধরে বিস্তৃত। রবীন্দ্রসঙ্গীত, বাংলা মৌলিক গান এবং বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের গানের দক্ষ শিল্পী হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত।  ১৫০০ এরও বেশি গান রেকর্ড করেছেন তিনি, যার মধ্যে প্রায় ৮০০ টি রবি ঠাকুরের গান। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্র সংগীতের জন্য ভারত সরকারের সংগীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি অনেক বাংলা চলচ্চিত্রতে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন এবং জনপ্রিয় বাংলা মৌলিক গানে সুর সংযোজন করেছিলেন। 

তাঁকে বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্র সংগীতের সাথে পরিচয় করিয়েছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র-সংগীত সুরকার সলিল চৌধুরী। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় এবং সলিল চৌধুরীর মধ্যে বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল চল্লিশের দশকের শেষের দিকে, আইপিটিএ তে তাঁদের যাতায়াতের মধ্য দিয়ে। এই জুটি বাঙালি শ্রোতাকে "শ্যামল বরণী ওগো কন্যা", " ক্লান্তি নামে গো ", " একদিন ফিরে যাব চলে ", " পল্লবিনী গো সঞ্চারিনী " এবং এইরকম আরো অনেক গান উপহার দিয়েছিলেন। তারা মাইকেল মধুসূদন দত্তের দুটি কবিতা ("রেখো মা দাসের মনে", "আশার ছলনে ভুলি") নিয়ে কাজ করেছিলেন এবং বিরল এবং সুন্দর সুর শুনিয়েছিলেন। পরে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় মুম্বই গিয়েছিলেন সলিল চৌধুরীর সাথে কাজ করার জন্য। সেখানে তিনি 'হানিমুন' (১৯৬০), 'মায়া' (১৯৬১), 'সপন সুহানে' (১৯৬১) এর মতো হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য লতা মঙ্গেশকরের সাথে দ্বৈত সংগীত গেয়েছিলেন এবং 'মধুমতী' চলচ্চিত্রে এককভাবে নেপথ্য সঙ্গীত গেয়েছিলেন।

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ‌নিষ্ঠার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের ভাষান্তর করেছিলেন, তারঁ গান শুনে বাংলা এবং এর বাইরের মানুষেরাও রবীন্দ্রসঙ্গীতের শ্রোতা হয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রখ্যাত বাংলা ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন, এর মধ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট গল্প 'ক্ষুধিত পাষাণ' (১৯৬০)। এছাড়া 'সন্ধ্যা রাগ' (১৯৭৭) ছবির জন্যেও তিনি গান গেয়েছিলেন। দুটি ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন যথাক্রমে বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ এবং পণ্ডিত রবিশঙ্কর।

মুখোপাধ্যায় 'মহিষাসুর মর্দিনী' (দানবের ধ্বংস) সঙ্গীতনাটকের অংশ হিসাবে বিখ্যাত ভক্তিমূলক গান 'জাগো দুর্গা' পরিবেশন করেছিলেন। এটি আকাশবাণী (অল ইন্ডিয়া রেডিও) (এআইআর), কলকাতা দ্বারা প্রচারিত একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় বেতার অনুষ্ঠান। প্রতি বছর 'মহালয়া'র শুভ দিনে বিখ্যাত শারদীয় উৎসব 'দুর্গাপূজা'র সূচনা উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানটি প্রচার করা হয়। গত ৬০ বছর ধরে অসাধারণ জনপ্রিয়তার সাথে, এটি সমগ্র পৃথিবীতে, বাংলাভাষাভাষী সম্প্রদায়ের পরিচায়ক সুর হিসেবে স্বীকৃত এবং ভোর ৪ টায়  জেগে উঠে বাঙালি দেবী দুর্গাকে এই চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে স্বাগত জানায়। 

'ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি'র সদস্য হিসাবে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ যেমন পোল্যান্ড, রোমানিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, এবং যুগোস্লাভিয়া সফর করেছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং বাংলা আধুনিক গান, দুই ধারাতেই সাবলীল বিচরণ শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে তাঁর পরিচিতির পথ প্রশস্ত করেছিল। তিনি সাধ্যমতো সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন।

যদিও সূচনাপর্বে পঙ্কজকুমার মল্লিক ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে যত্নবান ছিলেন তিনি। হেমন্ত-উত্তর শিল্পীদের দলে বেশ কিছুটা জুড়ে থাকা ফাঁকা জায়গা দ্বিজেনবাবু ভরাট করেছেন ।নিজের গানে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে দ্বিজেনবাবু জলসায় শোনাতেন হেমন্তবাবুর গান। নিজেই বলেছেন, তখন হেমন্তবাবুই তাঁর প্রেরণা। তাঁর দেখানো পথে হেঁটেই আধুনিক গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীতেরও প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন তিনি।  রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, আজীবন রবীন্দ্র সাধনার মধ্যেই অতিবাহিত করেছেন ।

 

সা/ই

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত