মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মুহূর্তে বৈপ্লবিক ধারার লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৩:৪১ |  আপডেট  : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৩৪

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মুহূর্তে বাংলা কথা-সাহিত্যে যে কয়েকজন লেখকের হাতে সাহিত্যজগৎে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তার রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি। ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যা তার রচনায় ফুটে উঠেছে। জীবনের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি রচনা করেন চল্লিশটি উপন্যাস ও তিনশত ছোটোগল্প। তার রচিত পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উপন্যাস ও অতসীমামী, প্রাগৈতিহাসিক, ছোটবকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি গল্পসংকলন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। ইংরেজি ছাড়াও তার রচনাসমূহ বহু বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তার প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবণি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তার মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি তিনি রচনা করেন তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা। চাকরি সূত্রেই তার পিতা সাঁওতাল পরগনার দুমকায় গমন করেন। সেখানেই মানিকের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের কারণে ঐ সকল মানুষের জীবনচিত্র সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা ছিল মানিকের। তাই ঐ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রকে তার সাহিত্যে অপূর্ব দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। বিচিত্র সব মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন লেখক। তার এই সকল অভিজ্ঞতাকেই তিনি তার সাহিত্যে তুলে ধরেছেন বিচিত্র সব চরিত্রের আড়ালে। পদ্মার তীরবর্তী জেলেপাড়ার পটভূমিতে রচনা করেন পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি।

জীবনের প্রথমভাগে তিনি ফ্রয়েডীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এছাড়া মার্কসবাদও তাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তার অধিকাংশ রচনাতেই এই দুই মতবাদের নিবিড় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিগত ভাবে মানিক ছিলেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার উত্তারাধিকারী। তার প্রথম গল্পগুচ্ছ অতসী মামী ও অন্যান্য সংকলনে সব কয়টি গল্প এবং প্রথম উপন্যাস দিবারাত্তির কাব্য মধ্যবিত্ত জীবনভিত্তিক কাহিনী নিয়ে গড়া। এছাড়া গ্রামীণ হতদরিদ্র মানুষের জীবন চিত্রও তার বেশকিছু লেখায় দেখতে পাওয়া যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে বস্তুবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। মনুষ্যত্ব ও মানবতাবাদের জয়গানই তার সাহিত্যের মুল উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ভাঙ্গা গড়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে তিনি তার সাহিত্যে চিত্রায়িত করেছেন। সমাজের শাসক ও পুঁজিপতিদের হাতে দরিদ্র সমাজের শোষণবঞ্চনার স্বরূপ তুলে ধরেছেন সাহিত্যের নানান চরিত্রের আড়ালে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বমোট ৪০টি উপন্যাস এবং ৩০০টি ছোট গল্প রচনা করেছেন। তার লেখা অন্যতম ছোটগল্প হলো মাসি -পিসি।যেটি সর্বপ্রথম 'পূর্বাশা' পত্রিকায় ১৩৫২ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর, মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী এই কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।

 

সান

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত