মাদারীপুর জেলার ১৫টি বদ্ধভূমি রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে নিশ্চিহৃ  

  শফিক স্বপন,মাদারীপুর

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ১৮:৪২ |  আপডেট  : ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:২৪

মাদারীপুর জেলার ১৫টি বদ্ধভূমি রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে নিশ্চিহৃ হয়ের আছে।  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা মাদারীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্বিচারে গণহত্যা, গ্রামের পর গ্রাম অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারী নির্যাতন চালিয়ে বিশ্ব মানবতাকে স্তম্ভিত করে দেয়। শহরে গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে লাশগুলো মাটি না পুঁতে চলে যায়। পরে এলাকাবাসী তাদের স্বজনদের লাশ গর্ত থুঁড়ে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। মাদারীপুর মহকুমার যত্রতত্র অসংখ্য গণকবর রয়েছে। এ সকল গণকবর বা বদ্ধভূমির মধ্যে ১৫টি বদ্ধভূমি উলে¬খযোগ্য। এ সকল বদ্ধভূমি সংরক্ষণের অভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আটকে আছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম স্মৃতিস্তম্ভ। স্বাধীনতা অর্জনের ৫১বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণের কার্যকর কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। সরকারি ভাবে ২০১৩ সালে মাদারীপুরের ১০টি বদ্ধভূমি উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য কর্মসূচির অর্ন্তভুক্ত করা হয়। আজো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মাদারীপুর গণপূর্ত বিভাগ একটি সমীক্ষা করে তা ঢাকায় প্রেরণ করে। যে সকল গণকবর বা বদ্ধভূমির নাম উল্লেখ করা  হয়েছে তাতেও রয়েছে স্থান নির্বাচনে ব্যাপক ভুলভ্রান্তি। কোন গণকবরে কতজন শহীদের লাশ রয়েছে, কোন তারিখে কিভাবে ঘটনা ঘটেছে তারও কোন সমীক্ষা করা হয়নি। এদিকে ১৫ বছর আগে মাদারীপুর স্বাধীনতা অঙ্গনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নাম স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতার অভাবে স্মৃতিস্তম্ভে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সম্বলিত স্টোন আজও লাগানো হয়নি। যে কারণে বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভে নাম ছাড়াই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। যে সকল পরিবারের সদস্যরা মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন (গণহত্যা শিকার বা গণ-শহীদ) তাদেরকে আজও শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। যাদের আত্নত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, ৫১ বছরে তাদের পরিবার অবহেলিত এবং অবহেলিত তাদের কবরগুলো। এ ছাড়া কালকিনির ফাসিয়াতলা ও শিবচরের গুয়াতলা গণহত্যার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। শিবচরের গুয়াতলার অনেক মুক্তি পাগল মানুষকে হাত-পা বেঁধে পার্শ্ববর্তী আড়িয়ালখাঁ নদে ফেলে দেয় হানাদার বাহিনী। এ ছাড়াও সদর থানার মিঠাপুর গণহত্যা, কালকিনির ফাসিয়াতলা গণহত্যা, রাজৈরের সেনদিয়া গণহত্যা ও কালকিনির ভূরঘাটার লালব্রিজ গণহত্যার স্মৃতি আজো স্বজনদের তাড়িয়ে বেড়ায়। 

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মাদারীপুর সদর উপজেলায় ৭টি এবং রাজৈর উপজেলায় ৮টি বদ্ধভূমি রয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার কুকরাইল মৌজার এ.আর হাওলাদার জুট মিলের অভ্যন্তরে জেলার সর্ববৃহৎ বধ্যভূমি। এখানে প্রায় ৭৫০শত মুক্তিকামী নর-নারী ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। বর্তমানে স্থানটি গো-চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। মিলের ডি-টাইপ বিল্ডিং-এর টর্চার সেলে অসংখ্য নারীকে মাসের পর মাস আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শহীদ সুফিয়ার পরিবার অন্যতম।

মাদারীপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের পূর্ব কলাগাছিয়া সুষেন হালদারের বাড়ির পুকুর পাড় বধ্যভূমি। এখানে ৩৫ জন মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের তারাপদ শিকারীর বাড়ির পুকুর পাড় বধ্যভূমি। এখানে ৬২ জন মুক্তি পাগল মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। সদর উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের মিঠাপুর শিকদার বাড়ি বধ্যভূমি। বর্তমানে এই বধ্যভূমির উপরে গড়ে উঠেছে দ্বিতল ভবন, রয়েছে সরকারি ব্যাংক ও অন্যান্য অফিস। এখানে স্মৃতি ফলক নির্মাণের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। সদর উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের মিঠাপুর গোপীঠাকুরের বাড়ির পিছনে পুকুরের উত্তর পাশে বধ্যভূমি। বর্তমানে সেখানে বাঁশঝাড় ও মরিচ-বেগুনের চাষ করা হচ্ছে। উলে¬খিত দুটি বধ্যভূমিতে ৫১ জন মুক্তি পাগল মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তথ্য অনুসন্ধান করে ৩৮ জনের নাম পাওয়া গেছে। সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের চৌহদ্দি হাটখোলা বধ্যভূমি। এখানে ৩০ জন মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল।মাদারীপুর  পৌরসভার অধীন কুলপদ্বী সাবেক সরকারি শিশু সদন ভবনের পূর্ব পাশে বধ্যভূমি, যেখানে দোল-যাত্রার ভাঙ্গা মঠ রয়েছে। এখানে ১৬ জন মুক্তিপাগল মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। কুলপদ্মী জেলেপাড়া বদ্ধভুমিতে ১১জন শহীদের লাশ রয়েছে।

রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের কমলাপুর গ্রামের কেষ্ট বৈদ্য’র বাড়ির পুকুর পাড় একটি গণ কবর রয়েছে। এখানে প্রায় ৭০ জন মুক্তি পাগল মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ইউনিয়নের পাখুল¬া গ্রামের রাসু গাটিয়ার বাড়ির পুকুর পাড় বধ্যভূমি। এখানে প্রায় ৩০ জন মুক্তি পাগল মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের গণেশ পাগলের সেবা আশ্রমের পূর্ব পাশে, যেখানে মেলা অনুষ্ঠিত হয়, সেই পুকুর পাড় বধ্যভূমি। এখানে প্রায় ৭৫ জন মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের আলেক ফকিরের বাঁশঝাড় (বুড়ির ভিটা) সংলগ্ন ৩ খালের সংযোগ স্থানে বধ্যভূমি। রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের সিদ্দিক মাতুব্বরের বাড়ির দক্ষিণ পূর্ব কোনে বধ্যভূমি। রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের শচীন বারিকদারের বাড়ির দক্ষিন পাশে খালের পাড় (গনেশ বারিকদারের বাড়ির সামনে) বধ্যভূমি। রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের ডা. রাসু বারিকদারের বাড়ির পাশে বাগানের ভিতরের খালপাড় দক্ষিন পূর্ব কোনে বধ্যভূমি। রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের ছাতিয়ানবাড়ি গ্রামের পূর্ণ চন্দ্র বৈদ্য এর বাড়ির উত্তর পাড় পুকুরের মধ্যে বধ্যভূমি।

রাজৈর উপজেলার সেনদিয়া ছাতিয়ান বাড়ি ও পলিতা গ্রামের ৬টি বধ্যভূমিতে ১২৭ জন নর-নারী শহীদের লাশ রয়েছে। ১৯৭১ সালে (বাংলা ১৩৭৮ সালের ৫ জৈষ্ঠ্য) এই ৩টি গ্রামে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে। টেকেরহাটের এক চিহ্নিত রাজাকার মহিউদ্দিন মনি হাওলাদারের সহযোগিতায় পাকি সেনা ও তাদের দোসররা ঐ ৩ গ্রামের নিরিহ নর-নারী-শিশুকে ব্রাস ফায়ার করে হত্যা করা হয়। পরে ওইদিন সন্ধায় লাশগুলি উলে¬খিত ৬টি বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দেয় গ্রামবাসি। ওই ঘটনাকে স্মরণ করে স্থানীয় শহীদ পরিবারের সদস্যরা এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ২০০৯ সালের ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ ১৪১৬) সেনদিয়া গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন। ওই স্মৃতিস্তম্ভে ১২৬ জন শহীদের নাম সম্বলিত একটি স্টোন লাগানো হয়েছে। সেদিন গণহত্যার সময় পাকিবাহিনী ও তাদের দোসররা অমূল্য কুন্ডুর ঘরে আগুন দিয়ে ঘরসহ তার বৃদ্ধা মাকে পুড়িয়ে হত্যা করে। বৃদ্ধার নাম না জানার কারণে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে তার নাম খোঁদাই করা সম্ভব হয়নি। ওইদিন শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঘনিষ্ট সহচর বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাদার মারিনো রিগন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত