অবৈধ পন্থায় টাকা দিলে মিলছে দ্রুত ফেরিতে উঠার সিরিয়াল

ভিআইপিদের দখলে শিমুলিয়া ফেরিঘাট-ভোগান্তিতে সাধারণ যাত্রীরা

  লৌহজং ( মুন্সিগঞ্জ ) প্রতিনিধি:

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২১, ২০:১৫ |  আপডেট  : ১৮ মে ২০২৪, ১১:৩৩

(অনিয়মই যেখানে নিয়ম সেখানে ব্যবস্থা নিবে কে??)

পদ্মা সেতুর পিলারের সাথে একাধিকবার ফেরির ধাক্কা লাগা সহ অন্যান্য দুর্ঘটনা এড়াতে দীর্ঘদিন শিমুলিয়া বাংলাবাজার নৌরুটে সব ধরনের ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার পর। ৪ টি ফেরি দিয়ে হালকা ও মাঝারি যানবাহন পারাপারের জন্য সীমিত পরিসরে ফেরি চলাচল সচল করা হলেও ঘন কুয়াশা সহ অন্যান্য কারণে এখনো ব্যাহত এ নৌরুটে ফেরি চলাচল। 

আর ফেরি স্বল্পতার কারণে প্রতিনিয়ত দীর্ঘ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে এই নৌরুটে নিয়মিত যাতায়াতকারী যানবাহন সহ যাত্রীদের। এতে ঘাট পারাপারের জন্য ফেরির অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা, তাই সব থেকে বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে জরুরী রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স গুলোকে। তবে বিআইডব্লিউটিসি বলছে দ্রুত এই সংকট নিরসনে ব্যবস্থা নিবে ঘাট কতৃপক্ষ সহ সংশ্লিষ্টরা।

মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত সরেজমিনে শিমুলিয়া ঘাট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গভীর রাত থেকে পদ্মা পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায় ঘাট এলাকার পার্কিং ইয়ারে ছিল ছোট-বড় যানবাহনের দীর্ঘ সারি। এতে জরুরী অসুস্থ রোগীবাহি প্রায় অর্ধশতাধিক অ্যাম্বুলেন্স ও দীর্ঘক্ষন ছিল পারের অপেক্ষায়।

এ সময় নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই, সংশ্লিষ্টদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, সিরিয়াল ভেঙে অবৈধ পন্থায় বিভিন্ন যানবাহনকে ভিআইপি পরিচয়ে উঠতে দেখা গেছে ঘাট এলাকার ২নং ও ৩নং ঘাটে নোঙ্গর করে রাখা ফেরি গুলোতে। 

ঘাটে পারাপারের জন্য অপেক্ষমান যাত্রীদের অভিযোগ, আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে উৎকোচ দিয়ে ভিআইপি পরিচয়ে ঘাট এলাকা থেকে পার হয়েছে বিভিন্ন যানবাহন। ফলে এ বিষয়কে কেন্দ্র করে সোমবার বাকবিতন্ডা সহ একাধিক বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটেছে যাত্রীদের সাথে ঘাট সংশ্লিষ্টদের।

ঢাকা থেকে মাদারীপুরগামী তুহিন হাসান  নামের একযাত্রীর অভিযোগ, সিরিয়াল ভেঙে দ্রুত পারাপারের জন্য তার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা দাবি করেছে ঘাটের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা। তিনি সেই শর্তে রাজি না হওয়ায় সকাল সাতটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ফেরিতে ওঠার অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে তাকে।

তবে পূর্ব নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ফেরি চলাচলের নির্দেশনা থাকায়, নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী বিকেল ৪টায় ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়,তাই দীর্ঘক্ষন ঘাট এলাকায় পারাপারের অপেক্ষায় থেকে পুনরায় ঢাকায় ফিরে যেতে হয়েছে তাকে। তার দাবি এমন অনিয়ম প্রতিরোধে সংশ্লিষ্টদের বাড়তি নজরদারি রাখা জরুরি।

ঢাকার কমলাপুর থেকে পরিবার নিয়ে বরিশালের গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ বাবা কে দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের ব্যক্তিগত প্রাইভেটকার নিয়ে ঘাট এলাকায় পারের অপেক্ষায় থাকা আরেক যাত্রী, শামসুল হুদা নয়ন বলেন, শিমুলিয়া ঘাট একটি অনিয়মের নৈরাজ্য পূর্ণজায়গা এখানে বিভিন্ন সময় নানা অনিয়ম ঘটলেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না, এ ব্যাপারে আগে-পরে একাধিক যাত্রী অভিযোগ করলেও কোন প্রতিকার মেলেনি এখনো। 

একদিকে ফেরির স্বল্পতা অন্যদিকে অবৈধ পন্থায় মাধ্যমে সাধারণ  যাত্রীদের সিরিয়াল ভেঙে ভিআইপি পরিচয়ে পার করে দিচ্ছে ঘাট সংশ্লিষ্টরা, এতে ঘাট এলাকায় দীর্ঘক্ষন পারাপারের অপেক্ষায় থেকেও ফেরিতে উঠতে না পেরে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ যাত্রীরা, তাই এ ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।

শিমুলিয়া ঘাট সূত্রে জানা গেছে,চলতি বছরের গেল আগস্ট মাস থেকে টানা ৫ মাসের ও বেশি সময় ধরে ব্যাহত হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে মাদারীপুরের বাংলাবাজার নৌরুটে সব ধরনের ফেরি চলাচল। পদ্মায় প্রবল স্রোতের কারণে পদ্মা সেতুর পিলারের সাথে একাধিকবার ফেরির ধাক্কা লাগা সহ অন্যান্য দুর্ঘটনা এড়াতে সব ধরনের ফেরি চলাচল বন্ধ রাখে বিআইডব্লিউটিসি।

এরপর গত ১৮ আগস্ট থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত টানা ৩ মাস বন্ধ থাকার পর, জরুরী এম্বুলেন্স সহ হালকা ও মাঝারি যানবাহন পারাপারের জন্য সিমিত পরিসরে ৪ টি ফেরি দিয়ে শুরু হয় এই নৌ-রুটের ফেরি চলাচল। এতে ফেরি স্বল্পতার কারণে ঘাট পারাপারে তিনগুণ বেশি সময় লাগায় ভোগান্তি পৌহাতে হচ্ছে এ নৌরুটের যাত্রীদের। 

সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ফেরিতে উঠার  অপেক্ষায় ঘাটে আটকে থাকা শিপন মৃধা, হুমায়ুন কবির,তানভির হোসেন, রিতা আক্তার, আতিফা বেগম,সহ আরও বেশ কয়েকজন যাত্রী জানান, ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেও, নির্দিষ্ট সিরিয়াল মেনে ফেরিতে উঠতে পারেনি তারা সবাই। 

তাদের অভিযোগ সিরিয়ালে না দাঁড়িয়েই সরাসরি ফেরিতে উঠতে দেখা গেছে বিভিন্ন যানবাহনকে। ঘাট এলাকায় পারাপারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা কালিন সময়ে দ্রুত পারাপারের আশ্বাস দিয়ে অবৈধ অর্থ দাবি করেছে সংশ্লিষ্টরা, কেউ কেউ এসব ফাঁদে পা রেখে অর্থের বিনিময় সিরিয়াল ভেঙে দ্রুত ফেরিতে ওঠার চেষ্টা করেও তা আর সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে ভোগান্তিতে নাকাল এই নৌরুটে নিয়মিত যাতায়াতকারী যানবাহন ও যাত্রীরা। তাই এমন অনিয়ম বন্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো তৎপরতার মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সকলে।

তবে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের টার্মিনাল ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আল ফয়সাল  জানান, শিমুলিয়া বাংলাবাজার নৌ-রুটে ফেরি স্বল্পতার কারণে আমরা সাধারন মানুষকে সঠিকভাবে সার্ভিস দিতে পারছিনা, এর পাশাপাশি সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের চাপে আমাদের বিভিন্ন ভবে প্রেসারে থাকতে হয়, এতে বিনা সিরিয়ালে অনেক গাড়িকে দ্রুত পারাপারের জন্য ফেরিতে তুলে দিতে হয় ফলে প্রতিনিয়ত এই কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ যাত্রীরা। 

বিভিন্ন সময় যাত্রীরা অভিযোগ করেন যে অবৈধ পন্থায় অর্থের বিনিময়ে আমরা এসব কাজ করে থাকি তবে এটি সঠিক নয়, বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের স্বজনপ্রীতির কারনে কেউ ঘাটে আসলেই মুঠোফোনে ধরিয়ে দিচ্ছে কাউকে না কাউকে, উপরমহলে নির্দেশনা অনুযায়ী অনেকটা বাধ্য হয়েই এইসব যানবাহনকে প্রাধান্য দিয়ে দ্রুত ফেরিতে তুলে দিতে হচ্ছে আমাদের, এতে আমরা অনেকটা অসহায় ও নিরুপায় এটি বলা চলে। 

আর ঘাট এলাকায় যে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না এটি আমি বলবো না কোথাও না কোথাও অনিয়ম হচ্ছে এবং সাধারণ যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। সুস্পষ্ট ভাবে লিখিত কোন অভিযোগ পেলে বিষয়টি আমরা উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের অবহিত করবো, তারা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এদিকে পদ্মা সেতুর সাথে দুর্ঘটনা এড়াতে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটের বিকল্প পথ হিসাবে শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি নৌরুট চালুর লক্ষ্যে শরীয়তপুরের জাজিরায় গত ২৬ই আগষ্ট স্থাপন করা হয়েছিলো মাঝিরকান্দি ফেরিঘাট।  

তবে নাব্যতা সংকট ও পদ্মায় তীব্র স্রোত সহ নানা জটিলতার কারণে বিকল্প নৌরুটটি চালু হয়নি  দীর্ঘদিন। বর্তমানে মাঝেমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে দু'একটি ফেরি চলাচল করলেও ঘাট পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে যাত্রীরা।

তবে বিআইডব্লিউটিসি'র উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান  বলেন বিকল্প রুটে বাড়তি চাপ সামলাতে বারাতে হয়েছে ফেরি সংখ্যা। তাই যাত্রীদুর্ভোগ কমাতে এই নৌরুটে ফেরি সংখ্যা বাড়ানো এখন সম্ভব নয়।

বিকল্প নৌরুট সচল করতে শরীয়তপুরে পাইনপাড়া চ্যানেলে চারটি স্থানে পলি অপসারণ করে গভীরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফেরি চলাচলের উপযুক্ত করতে ড্রেজিং চলছে পদ্মায়। চ্যানেলের বর্তমান পানির গভীরতা রয়েছে ১৬ ফুট, তাই সন্ধায় জোয়ারের সময় প্রতিদিন পরীক্ষামুলকভাবে দু'একটি ফেরি যাত্রী ও যানবাহন নিয়ে শিমুলিয়া ঘাট থেকে শরীয়তপুরের মঙ্গল মাঝির ঘাটে যাতায়াত করছে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ড্রেজিংয়ের কাজ সম্পন্ন হলে এই নৌরুটি ২৪ ঘণ্টা ফেরি চলাচলের জন্য স্বাভাবিক করা হবে, এই নৌরুট ব্যবহারে পদ্মা সেতুর সাথে ধাক্কা লাগার কোনো ঝুঁকি থাকবে না তাই এই নৌরুট চালুর লক্ষ্যে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

এছাড়াও শিমুলিয়া থেকে মাঝিরকান্দি বিক্ল্প এ নৌরুট চালু হলে নদী পারাপারে দূরত্ব কমবে ২কিলোমিটার এতে সময় কমে আসবে ফেরি পারাপারে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত