বৈষম্য আন্দোলন সফল করতে এখন প্রয়োজন ব্রেইন গেইন নীতি- বন্ধ করতে হবে ব্রেইন ড্রেন

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৪, ১১:২৩ |  আপডেট  : ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৫২

আমাদের বাংলাদেশের অহংকার একমাত্র আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব স্যার ডঃ ইউনুস এখন রাষ্ট্র প্রধান। বাংলদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী। মাননীয়  প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রংপুরে বলেছেন, “আমরা এখন সামনের পথে দাঁড়াই, আবু সাঈদ যেমন দাঁড়িয়েছিল, আমাদেরও সেভাবে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যখন বড় হবে, তারা স্কুলে পড়বে আবু সাঈদের কথা। তারাও বলবে, আমিও ন্যায়ের জন্য লড়ব। স্বাধীন এই নতুন বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব এখন আমাদের। তার (আবু সাঈদ) কথা স্মরণ হবে এই কাজটা বাস্তবায়ন করার মধ্যে। কাজেই সে কাজটা যেন আমরা করি।” তাহলে এখন উনার পাশে দাঁড়ানোর  জন্য বিদেশে অবস্থানরত মেধাবী দক্ষ উচ্চ-শিক্ষিত প্রবাসীদের বাংলাদেশে ফিরে আসা উচিত। যতদিন তিনি ক্ষমতায় আছেন।   

ব্রেন ড্রেনের প্রভাব আমাদের দেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আগের সব সরকারের নেতিবাচক মনোভাব দলীয়করনের জন্য বহু মেধাবী বিদেশে চলে গেছেন। ব্রেন ড্রেন হলো উচ্চ প্রশিক্ষিত ও মেধাবী শিক্ষিত ব্যক্তিরা দেশ থেকে অন্য উন্নত দেশে চলে যাওয়া। এই ব্যক্তিরা আমাদের দেশে শিক্ষা অর্জন করেছেন; কিন্তু তাঁরা আরও উচ্চশিক্ষার জন্য এবং কাজের খোঁজে বিদেশে চলে গেছেন। এই দেশত্যাগ আমাদের দেশের জন্য সৃষ্টি করেছে কঠিন সমস্যা। কারণ মেধাবীদের পরির্বতে বিভিন্ন কোটায় অদক্ষ কম মেধাবীদের সম্বনয় ঘটেছে প্রশাসন ও দেশ পরিচালনায়। যেখানে উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক মান বজায় রাখার জন্য অনেক উচ্চশিক্ষিত এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকের প্রয়োজন ছিলো। কারণ মনে রাখতে হবে উচ্চশিক্ষিত মানুষ একটি পেশাদার সমাজ গঠনের চাবিকাঠি।

ব্রেন ড্রেনের কারণে আমাদের দেশ আরও উন্নতির সক্ষমতা হারিয়েছে। প্রতিভাবান মানুষ দেশে জন্মগ্রহণ করেছে, বেড়ে উঠেছে এবং শিক্ষিত হয়েছে, কিন্তু যখন কাজ করার সময় এসেছিলো, তখন তাঁরা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, উন্নত দেশে চাকরির খোঁজে। প্রশ্ন হলো, কেন উচ্চশিক্ষিত এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকেরা আমাদের দেশ ছেড়ে চেলে গেছেন? কারণ হলো, উন্নত কর্মজীবনের সম্ভাবনা, সামাজিক অবিচার, অর্থনৈতিক বৈষম্য, অনেক সমস্যার সম্মুখীন হওয়া, দারিদ্র্যতা ও প্রযুক্তিগত উন্নতির অভাব, মেধার অবমূল্যায়ন, কম সুযোগ প্রাপ্তি, দলীয়করণের কালো থাবা, দুর্নীতি, অসম্মান এবং বৈষম্য। দেশের মধ্যে অশান্তি, অন্যান্য দেশে অনুকূল পেশাগত সুযোগের অস্তিত্ব বা উচ্চতর জীবনযাত্রা অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষা থেকেও তাঁদের মস্তিষ্কে ড্রেন চিন্তা জাগে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিম্নমানের জীবনযাত্রা, অনুন্নত স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবসহ বেশ কয়েকটি সাধারণ কারণে তাঁদের মস্তিষ্কের ড্রেনকে প্ররোচিত করেছে।

ব্রেন ড্রেনের কারণে আমাদের দেশ, শিল্প ও সংস্থাগুলো মেধাবী ব্যক্তিদের একটি মূল অংশকে হারিয়েছে। সে স্থানে ভারত আর শ্রীলংকার লোকেরা চাকরী বাগিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগের রিপোর্ট অনুসারে, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশি নাগরিকদের সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭ জন। তবে আর একটি সূত্র মতে, বাংলাদেশে ঠিক কতজন বিদেশি নাগরিক অবস্থান করছেন সে সম্পর্কে সরকারি পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য না থাকলেও  তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে আমাদের দেশে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় নাগরিক কাজ করছে। ভারতের পরে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চীন, ১১ হাজার ৪০৪ জন। আয়কর ফাঁকি দিয়ে ভারতের নাগরিকরা এ-থ্রি ভিসা, বি-ভিসা কিংবা ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। বাংলাদেশে পোশাক খাতে ভারতীয়দের অবস্থান শক্ত। পোশাকের বায়িং হাউজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয়রা। ফলে পোশাক কারাখানাগুলো বায়ার পেতে তাঁদের কারখানায় মার্কেটিং এবং হিসাব বিভাগেও ভারতীয়দের নিয়োগ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানা গুলোতে ১ লাখেরও বেশি ভারতীয় কাজ করেন। বায়িং হাউজে এই সংখ্যা আরো বেশি। এর বাইরে আইটি খাতেও ভারতীয়দের দাপট। এমনকি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, কনসালটেন্সি এসব খাতেও ভারতীয়রা রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশেরই কোনো ওয়ার্ক পারমিট নেই। তাঁরা ট্যুরিস্ট ভিসায় আসেন। তাঁদের বেতন অনেক বেশি।

২০০৬ সালে প্রণীত ভিসা নীতিমালায় কর্মানুমতি গ্রহণের শর্ত না থাকায় অনেকে আবার কর্মানুমতি না নিয়ে কিংবা ভিসার মেয়াদ না থাকায় বা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও বছরের পর বছর কাজ করে মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে দেশ ত্যাগ করছেন। আমাদের দেশের নাগরিকরা যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গত দেড় দশকে বাংলাদেশে বেকার সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। দেশে বর্তমানে বেকারত্বের হার ১২ শতাংশ, যা এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।  আমাদের দেশের নাগরিক কর্মসংস্থান খুঁজতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুবরণ করছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে কর্মরত অবৈধ বিদেশীরা বছরে ১০.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। অবৈধ হওয়ায় তাঁরা ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রদান না করে দেশের টাকা পাচার করছে। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হচ্ছে আর মানবাধিকার ও জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখিন হচ্ছে। এই বিদেশীরা বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করছেন। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা বহুগুণ বেশি।

আমাদের মেধাবী দক্ষ উচ্চশিক্ষিতরা দেশ ত্যাগ করার কারণে আমাদের দেশ দুটি প্রধান উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রথমত, দেশ দক্ষ জনশক্তি হারিয়েছে , দ্বিতীয়ত, দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্রেন ড্রেনের ফলে তাৎক্ষণিক ক্ষতিকারক ফলাফল দেখা যায় না; বরং দীর্ঘ মেয়াদে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রভাব দেখা দেয়। উদ্বেগপূর্ণ এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণহীন এবং ব্রেন ড্রেন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সমস্যা হলো উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা, যারা ভালো সুযোগের জন্য উন্নত দেশে চলে যান, তাঁরা বুঝতে চান না যে তাঁরা তাঁদের দেশকে উন্নত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেন। আমাদের নীতিনির্ধারকদের এটি অনুধাবন করতে হবে যে, অর্থনীতির ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করে দেশের শক্তিশালী অর্থনীতি, দেশের সমস্ত সম্পদ, যার মধ্যে শিক্ষিত কর্মীও অন্তর্ভুক্ত। এই ভারসাম্য ছাড়া একটি শক্তিশালী অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অতএব, ব্রেন ড্রেনকে বন্ধ করা উচিত বা অন্ততপক্ষে এই ধারণা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা সমাজে মেধাবীদের মধ্যে শক্তভাবে প্রচার করা উচিত যে, উচ্চশিক্ষিত মেধাবীরা যে জাতিতে আছেন, যে দেশ তাঁদের গড়ে তুলেছে, তাঁদের সেই দেশ ত্যাগ করা উচিত নয়।

তদ্ব্যতীত, আমাদের বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতামূলক থাকার জন্য আরও সক্রিয়ভাবে উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের ধরে রাখতে কাজ করা উচিত। আমাদের আরও উন্নত প্রযুক্তি আমদানি করা উচিত, গবেষণার সুবিধাদিসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও উপকরণ আমদানি করা উচিত, যাতে করে মেধাবীরা তাঁদের মেধাচর্চার সুযোগ পান। মেধাবীদের ধরে রাখার জন্য তাঁদের যোগ্য কাজ, পদ ও বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন। তা না হলে তাঁরা অন্যত্র চলে যাবেন। সরকারের ব্রেন ড্রেন বন্ধ করার জন্য উচিত কঠোর কিন্তু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া। সেই সঙ্গে শিক্ষিতদের দিকে নজর রাখা এবং নীতি তৈরি করে হস্তক্ষেপ করা, যাতে শিক্ষিত ব্যক্তিদের দেশে থাকতে রাজি করাবে এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। সরকারের উচিত শিক্ষিত মেধাবী জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, গবেষক তৈরি করতে যে বিনিয়োগ হয়, তা রক্ষা করা এবং নিশ্চিত করা যে, সরকার দক্ষ ও মেধাবী জনগোষ্ঠী তৈরি করে সঠিক ফলাফল অর্জন করছে।

আমাদের দেশ বর্তমানে যে উন্নয়নের গতিতে রয়েছে, তাঁকে ধরে রাখতে এবং আরও এগিয়ে নিতে “ব্রেন ড্রেন” থেকে “ব্রেন গেইন” নীতিতে যেতে হবে। আর্থিক সংস্থান করতে হবে। ভালো বেতনের চাকরির পাশাপাশি প্রণোদনা প্রদান করতে হবে, উচ্চ আর্থসামাজিক অবস্থা বৃদ্ধির সুযোগ দিতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে দেশব্যাপী একটি নীতি তৈরি করতে হবে, যেমনঃ হাজার প্রতিভা কর্মসূচির মতো উদ্যোগ। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক আকৃষ্ট করার জন্য চালু করেতে হবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান। প্রচুর বিনিয়োগ  করতে হবে  আমাদের প্রবাসী ও দক্ষ শ্রমিকদের আকৃষ্ট করার জন্য।

তবে বিশ্বায়ন এবং মানুষের গতিশীলতার ক্রমবর্ধমান প্রেক্ষাপটে প্রতিভা দেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমাদের কিছু মেধাবী উন্নত দেশে থাকা বেছে নেবেন। এ ধরনের মেধাবী দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে না এলে তাঁদের উন্নত দেশে অবস্থানের মধ্যেও দেশের সঙ্গে জড়িত করা যায়, যাকে আমি বলছি “হোম-হোস্ট মিথস্ক্রিয়া মস্তিষ্কের সংযোগ মডেল”। উন্নত দেশে অবস্থানকারী মেধাবীরা বা উচ্চ দক্ষ মেধাবীরা দেশের সঙ্গে একধরনের সেতুবন্ধ তৈরি করে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে ভূমিকা রাখবেন। এটি মস্তিষ্কের যোগসূত্রের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার একটি নতুন মডেল। তাঁদের দেশের সঙ্গে জড়িত রাখা, বিভিন্ন সংস্থায় সংযুক্ত করা এবং নেটওয়ার্ক সৃষ্টির মাধ্যমে উত্পাদনশীল ক্ষমতা থেকে লাভ করা। বর্ধিত আস্থা ও সহযোগিতা, তথ্য আদান-প্রদান ও উদ্ভাবনে উন্নত অ্যাক্সেসের মাধ্যমে তাঁদের মেধাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। “রিভাস ব্রেন ড্রেন” নীতির মাধ্যমে বিদেশে শিক্ষার জন্য পাঠানো মেধাবীদের স্থায়ীভাবে দেশে প্রত্যাবর্তন করাতে হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

সান
 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত