বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকট এবং বাংলাদেশ 

  সাজ্জাদুর সিরাজ নিবিড়

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৫০ |  আপডেট  : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:০৪

বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমান সময়ে একটি অস্থিরতা বিরাজ করেছে। অর্থনীতিবিদেরা এবং প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সত্য অকপটে স্বীকার করছে। উন্নত দেশের অর্থনীতি রেকর্ড মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করছে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকে করোনা মহামারীর পূর্ব পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতিকে তেমন কোন বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়নি। ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তিকে চীনে করোনা মহামারীর সূচনা হয়। ২০২০ সালের মার্চের মধ্যেই এই মহামারী সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করে। অর্থনীতির চাকা শ্লথ হতে শুরু করে। মহামারী থেকে বাঁচতে প্রতিটি দেশ লকডাউন ঘোষণা করে। পর্যাপ্ত টিকা হাতে পাওয়ার পরেই অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিটি দেশ আরেক দেশের উপর নির্ভরশীল। করোনা মহামারীতে সমগ্র বিশ্বের সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে পরে। অর্থনীতি শ্লথ হওয়াতে আয় কমতে থাকে মানুষের। আয় কমলে ভোগ কমে, ভোগ কমলে উৎপাদন ব্যহত হয়, হ্রাস পায় কর্মসংস্থান। 

কেইনসের তত্ত্ব অনুযায়ী সরকার যদি তার ব্যয় বৃদ্ধি করে তবে অন্য সকল সূচক স্বাভাবিক থাকলেও অর্থনীতি বড় হয়। এই তত্ত্ব অনুসরণ করে, বিশ্বের প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক করোনা পরবর্তী অর্থনীতিকে তেজী করতে প্রাণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। ঝিমিয়ে পরা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ব্যবসায়ীদের কম সুদে অর্থ দেয় সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রেপোর হার কমিয়ে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করেছে ২০২১ সালের শুরুর থেকেই। করোনা ভীতিতে মানুষ যে সঞ্চয় করেছিল, অবস্থায় উন্নতির সাথে সাথে মানুষ আবার তা বিনিয়োগ করতে শুরু করে। ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতি শুধু যে স্থবির হয়েছে তা নয়, উন্নত দেশগুলো ঋণাত্নক প্রবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছিল। ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে  বিশ্ব অর্থনীতি পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। ঠিক সেই সময়েই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে প্রণোদনার টাকা সঠিক উপায়ে বন্টন করা হয়নি। আমরা সকলেই দেখেছি করোনা মহামারী বিশ্বে যেমন নব দারিদ্র্য তৈরী করেছে তেমনি তৈরী করেছে নব বিলিয়নিয়ার।

বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি যখন বিশ্ব  অর্থনীতির সুবাতাসের গল্প লিখতে শুরু করে ঠিক তখন এই বছরের ফেব্রুয়ারীতে রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমন করে। একের পর এক আঘাতে পর্যদুস্ত হয়ে পরে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতি। যেহুতু বিশ্ব অর্থনীতি এখন পরস্পরের উপর নির্ভরশীল তাই বিশ্বের এক প্রান্তে সংগঠিত যুদ্ধ বিশ্বের সকল দেশকেই প্রভাবিত করবে। আর সেই যুদ্ধের একপক্ষ যদি হয় রাশিয়ার মত পরাশক্তি তবে ভোগান্তির কোন অন্ত নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশ। রাশিয়ার জ্বালানীর উপর নির্ভরশীল ইউরোপের অধিকাংশ দেশ। ইউরোপের অর্থনীতির পাওয়ার হাউস খ্যাত জার্মানীর অর্ধেক জ্বালানীর যোগান দেয় রাশিয়া।  জ্বালানী সংকটে জার্মানীতে রোড লাইট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ফ্রান্সে ইলেকট্রিক বিলবোর্ড বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, ইতালিতে এয়ারপোর্টগুলোতে এসির ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে। ইউরোপ এবং আমেরিকাতে দুই অংকের মূল্যস্ফীতি চলছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে সর্বোচ্চ চাপ সহ্য করছে। করোনা পরবর্তী সময়ে ব্যাপক আমদানী ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই সাথে বেড়েছে রপ্তানি আয়। কিন্তু রপ্তানির তুলনায় আমদানী বেড়েছে ব্যাপকহারে। করোনার বিধি-নিষেধ তুলে দেয়ার পরে হুন্ডির প্রভাব বেড়েছে তাই কমেছে রেমিট্যান্স। আমাদের রিজার্ভে বেড়েছে চাপ। রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমেছে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে। সম্প্রতি সিআইডি তথ্য অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে হুন্ডির নতুন মাধ্যম। মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে বছরে পাচার হচ্ছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা। ডলারের হিসেবে তা প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। এরসাথে আমদানীতে ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস কর। কিন্তু দেশের জিডিপি অনুসারে কর আহরণ হচ্ছে না আমাদের দেশে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কর জিডিপির অনুপাত ১৫ শতাংশের আশেপাশে হলেও বাংলাদেশে তা দুই অংকের নিচে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। জুলাইতে মূস্ফীতি হয়েছে ৮ শতাংশের কাছাকাছি। 

মূল্যস্ফীতি মূলত দুইভাগে সংগঠিত হয়। একটি ডিমান্ডপুল ইনফ্লেশন আরেকটি কস্ট পুল ইনফ্লেশন। জ্বালানি এবং সারের দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে আমরা প্রত্যক্ষ করছি কস্ট পুল ইনফ্লেশন। অপরদিকে করোনা পরবর্তী চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়াতে প্রত্যক্ষ করছি ডিমান্ডপুল ইনফ্লেশন। 

বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ব্যাংক রেট বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে। সুদের হার তারা বাজারের উপর ছেড়ে দিয়েছে। এতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশংকা থাকলেও তা করতে সেন্ট্রাল ব্যাংকগুলো বাধ্য হচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে ব্যাংক রেট বাড়লে সঞ্চয়ের হার বৃদ্ধি পাবে যা পরবর্তীতি বিনিয়োগ করা হবে। কিন্তু আমাদের দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপোর হার বাড়ালেও সঞ্চয়ে সুদের হার বাড়াচ্ছে না। ছয়-নয় সুদের হার পরিবর্তন করতে অর্থনীতিবিদেরা সুপারিশ করছে। আমাদের বাজেট ঘাটতি কমাতে সরকার প্রতিবছর আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিচ্ছে যার ফলে আমাদের বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। উন্নয়নশীল দেশের  মত আমাদের দেশে  সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগও আসছে না। তাই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সঠিক সুফল নিতে পারছে না বাংলাদেশ।

অর্থিনীতিক দুর্যোগের সাথেই যুক্ত হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের অংশ হিসেবে প্রতিটি দেশ প্রত্যক্ষ করছে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ বছর সিলেটে বন্যায় আমাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে, চীনে বন্যা এবং খরা একই সাথে চলছে। পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ জায়গা এখন পানির নিচে। ইউরোপ-আমেরিকাতে হচ্ছে দাবানল এবং ঘূর্নিঝড়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কমেছে খাদ্য উৎপাদন, যা ভবিষ্যতের দুর্ভিক্ষের আগাম পূর্বাভাস দিচ্ছে। 

বিশ্বব্যাংক প্রধান অকপটে স্বীকার করছে বিশ্ব অর্থনীতির সামনে ভয়াবহ দিন আসছে। বিশ্বে রিসেশন বা অর্থনৈতিক শ্লথ গতি ধেয়ে আসছে এমন শিরোনাম দেখা যাচ্ছে বড় বড় মিডিয়াগুলোতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ইউরোপ জুড়ে চলছে কূটনৈতিক আলাপ। আসন্ন শীতে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ না করলে ইউরোপ মূলত স্থবির হয়ে পড়বে। হর্ন অফ আফ্রিকার দেশগুলোতে অনাহারে মারা যাচ্ছে শিশু। এরই মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব তৈরী হয়েছে চীন এবং তাইওয়ানের মধ্যে। যুদ্ধ অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বৃদ্ধি করলেও, অনাহারের শঙ্কায় থাকে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ। 

যে কোন দেশের দুরবস্থায় সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংকটের মোকাবিলা করে। কিন্তু আমাদের দেশে সংকটে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের দোষ খোঁজার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ভুক্তভোগী হয় দেশের সাধারণ মানুষ। আমাদের এখন প্রয়োজন মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা, বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়ানো, রপ্তানির বৈচিত্রকরণ, কর হার বাড়ানো, আমদানী হ্রাস করা, অভ্যন্তরীন বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান তৈরী করা, প্রান্তিক মানুষদের সহযোগিতা করা এবং দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সুশাসনের সমন্বয়ে আমারা গড়ে তুলব সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা। এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। 
 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত