বাঙালির বিস্মরণ ভয়ানক এক ব্যাধি!

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ৩ আগস্ট ২০২২, ১৩:৪১ |  আপডেট  : ২৬ মার্চ ২০২৪, ১৫:৩৯

প্রবির বিকাশ সরকার
-----------------------


যতই তাঁর কর্মজীবন সম্পর্কে জানছি, ততই বিস্মিত না হয়ে পারছি না! ১৯৩১ সালের ১৪ আগস্টে জন্ম, ২০১১ সালের ২৮ জুলাই মহাপ্রয়াণ। এই আশি বছরের জীবনে সিংহভাগ সময় নিযুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গবেষণা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। তার বাইরে বাঙালি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সঙ্গীত নিয়ে গভীর আগ্রহের সঙ্গে শিক্ষাগ্রহণ এবং প্রচার করে গেছেন দেশ-বিদেশে। 

রবীন্দ্ররচনার এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি কাজ করেন নি! বাংলা ব্যাকরণ এবং "গীতাঞ্জলি"র ছন্দকে তিনি ভাজা-ভাজা করেছেন। অনুবাদ তো করেছেনই, বিস্তর প্রবন্ধ তিনি বাংলা ও জাপানি ভাষায় লিখেছেন। আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনেরও উদ্যোক্তা তিনি। 

জাপান-বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে তিনি এমন এক উঁচু পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যার মূল্যায়নস্বরূপ বিশ্বভারতী তাঁকে "দেশিকোত্তম" উপাধিতে ভূষিত করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্মানিত করে "রবীন্দ্র পুরস্কারে"। জাপান সরকার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদক "কুনশোও" প্রদান করে ধন্য হয়। এর বাইরে অনেক পুরস্কার, সম্মাননা এবং সাম্মানিক ডি লিট ডিগ্রি তিনি কৃতকর্মের অবদান হিসেবে অর্জন করেছেন। 

এত বড় মাপের পণ্ডিত, রবীন্দ্র গবেষক এবং বাঙালিপ্রেমী বিদেশি আর দেখা যায় নি আজ পর্যন্ত। জীবদ্দশায় দুটি সুদূরপ্রসারী কাজ তিনি করে যেতে সক্ষম হয়েছেন, যা অন্য কোনো জাপানি করতে পারতেন বলে মনে হয় না! দুটো অসামান্য কাজের একটি হচ্ছে, শান্তিনিকেতনে "নিপ্পন ভবন" জাপানি অনুষদ প্রতিষ্ঠা, যা ছিল রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন। অন্যটি হচ্ছে, কলকাতার সল্টলেকে "ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন" তথা সাংস্কৃতিক ভাববিনিময় কেন্দ্র। 

বাংলাদেশের সিলেটেও তিনি অনুরূপ একটি প্রকল্প "বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র" নামে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর প্রিয় শিষ্য জাপান প্রবাসী দারাদ আহমেদকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সাড়ে ৬ কোটি টাকাসহ। পুরো টাকাই দারাদ আত্মসাৎ করে বাংলাদেশের কপালে চিরস্থায়ী কলঙ্কক্ষত খোদাই করে দিয়েছে! 

পশ্চিমবঙ্গের তো বটেই, বাংলাদেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর গভীর হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল পাক আমলেই। তাঁদের মধ্যে, ড.মুনীর চৌধুরী, ড.কবীর চৌধুরী, ড.আবদুল হাই, ড.আনোয়ার পাশা, ড.আনিসুজ্জামান, ডা.আহমদ রফিক, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরকালে তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ক এবং দোভাষী। দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর সম্পর্ক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর অবদান আদৌ কম নয়। 

পশ্চিমবঙ্গের এমন কোনো খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী নেই, যাঁর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি! কতজন বিশিষ্ট বাঙালিকে তিনি জাপানে বিভিন্ন সময় নানান উপলক্ষে আমন্ত্রিত করেছেন, সংবর্ধনা দিয়েছেন তার হিসাব নেই। কলকাতায় এবং শান্তিনিকেতনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের কাছে শ্রদ্ধেয় "আজুমাসান"। (জাপানি ভাষায় সান অর্থ শ্রী, মহাশয়, মিস্টার ইত্যাদি। ) তাঁকে নিয়ে কম মাতামাতি হয়নি শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য মহলে পশ্চিমবঙ্গে। 

শুধু আজুমা স্যারই নন, তাঁর সুযোগ্যা মহীয়সী স্ত্রী মাদাম কেইকো আজুমাও বিরাট মাপের রবীন্দ্রগবেষক এবং বাংলা ভাষার শিক্ষক ছিলেন। স্বামীর যত কাজ ও অবদান তার পেছনে সমস্ত শক্তি ও ভালোবাসা নিবেদন করেছিলেন কেইকো মাদাম, যা আমার স্বচক্ষে দেখা ও জানা। 

এ হেন বাঙালিপ্রেমী জাপানি দম্পতির সঙ্গে আমার ৩০ বছরের বেশি সম্পর্ক ছিল। দুজনেই আজ গত। দুজনেই আজ স্মৃতি। কত খ্যাত-অখ্যাত বাঙালি আজুমা দম্পতির বাড়িতে বাঙালি ভোজন দ্বারা আপ্যায়িত হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কত ছাত্র-ছাত্রীকে তিনি বিভিন্ন সময় উচ্চশিক্ষার বিষয়ে সহযোগিতা করেছেন তারও হিসাব নেই। আজুমা স্যারের জীবদ্দশাতেই আমি তাঁকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেছি, এখনো করে চলেছি। লিখেছি কেইকো মাদামকে নিয়েও। 

আজুমা স্যারের জীবদ্দশায় কলকাতা বা ঢাকার পত্রিকাগুলো কম ছবি এবং সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে নি! অথচ, মহাপ্রয়াণের এক দশক যেতে না যেতেই পরিষ্কারভাবে তাঁকে বিস্মৃত হয়েছে বাঙালি! এমনকি, যাঁরা তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁর প্রয়াণের পর কিছু লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। লিখলে ইন্টারনেটে কিছু না কিছু লেখা খুঁজে পেতাম! খুঁজে দেখলাম একমাত্র আমার লেখাগুলোই আছে, যেগুলো আমি বিভিন্ন সময় লিখেছি এই দম্পতিকে নিয়ে। 

বাঙালি কত সহজে ভুলে যেতে পারে, বিশ্ববিশ্রুত রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমাকে বিস্মরণ এর এক উজ্জ্বলতম প্রমাণ।

*শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
সভাপতি, জাপান-বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব 
টোকিও ২.৮.২২

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত