বাংলাদেশী সঙ্গীতের বরপুত্র হ্যাপি আখন্দ

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:১০ |  আপডেট  : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ২১:০৩

বাংলাদেশী সঙ্গীতের বরপুত্র হ্যাপি আখন্দ (১২ অক্টোবর ১৯৬৩ - ২৮ ডিসেম্বর ১৯৮৭)। যিনি আর ডি বর্মণ,আববাসউদ্দীন, মান্না দে, সমর দাশের মতো সংগীতজ্ঞের প্রশংসা আর স্নেহ অর্জন করেছিলেন নিজ যোগ্যতায়। 

‘আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে
 চলো না ঘুরে আসি অজানাতে
 যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।’

প্রায় চার যুগ আগে তৈরি হওয়া গানটি ক্যাম্পাসের আড্ডাতে , ভ্রমণ অনুষ্ঠানে এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এখনো রাত কিংবা দিনে আমাদের প্লেলিস্টে বাজে এই গান। অথচ এ প্রজন্মের আমরা হয়তো অনেকেই জানি না এই গানে যাঁর কণ্ঠ শুনতে পাই, তিনি আমাদের হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্র হ্যাপী আখান্দ। আজ ২৮ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৭ সালের এই দিনে মাত্র ২৭ বছর বয়সটা তার রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে । বাংলা ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি অনেক মিউজিশিয়ানের মতে, হ্যাপীর চলে যাওয়া বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসের প্রথম বড় কোনো ধাক্কা।

এই ২৭ বছর বয়সেই মারা যাওয়াটাও কিন্তু সংগীতজগতের এক কৌতূহল। একেবারে ঠিক ২৭ বছরেই আশ্চর্যজনকভাবে মারা গেছেন জিম মরিসন, জিমি হেনড্রিক্স, কার্ট কোবেইন, ব্রায়ান জোন্স, জ্যানিস জপলিনের মতো কিংবদন্তি এবং মিউজিশিয়ানরা। এঁদের সবারই কিন্তু উত্থান ঘটেছিল ধূমকেতুর মতো, আর প্রস্থান খুবই আকস্মিকভাবে।

হ্যাপী আখান্দ জন্মেছিলেন ১৯৬০ সালের ১২ অক্টোবর পুরান ঢাকার পাতলা খান লেনের আখান্দ পরিবারে। হ্যাপীর আগেই এই পরিবারে জন্ম নিয়েছিল আরেক কিংবদন্তি গায়ক-সুরকার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক লাকী আখান্দ। এদের পূর্বপুরুষ ছিল পার্সিয়ান আর তাদের নামের মূল পদবি ছিল আখান্দজাদে। এই আখান্দ ব্রাদার্সের বাবাও ছিলেন একজন সুরকার ও সংগীতপ্রেমী মানুষ। ছোটবেলা থেকেই এক সাংগীতিক আবহে বড় হয়েছেন হ্যাপী। সংগীতে হ্যাপীর হাতেখড়ি মাত্র আট বছর বয়সে। প্রথমে তবলা দিয়ে শুরু। এরপর গিটারের প্রতি ঝোঁক বাড়িয়ে দিলেন বড় ভাই লাকী আখান্দ। মাত্র ১০ বছর বয়সে তার হাতে গিটারের তাল ধরা দেয়। তারপর পিয়ানো, কি–বোর্ড, ড্রামস। কী বাজাতে পারতেন না তিনি! এ ছাড়া আশপাশে থাকা যেকোনো কিছু থেকে সাংগীতিক শব্দ বের করে ফেলতে পারতেন তিনি। সব বাদ্যযন্ত্রই তিনি বাজাতে পারতেন। এমনকি বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও তিনি সক্রিয় থাকতেন। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে পকেটে থাকা ম্যাচের বাক্স থেকে কাঠি বের করে সেটা দিয়েই কিছু একটা বাজাতেন হ্যাপী।’

মূলত বড় ভাই লাকী আখান্দের হাত ধরেই সংগীতে আগমন ঘটেছিল হ্যাপীর। যেখানেই লাকী গান গাইতে যেতেন, সঙ্গে বাজানোর জন্য নিতেন কিশোর হ্যাপীকেও। ল্যাটিন আমেরিকান বিট খুব স্পর্শ করত তাঁকে। ছিলেন জ্যাজ, ব্লুজের ভক্ত। বড় ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছিলেন ম্যাক্সিকান, রাশিয়ান সংগীতের সঙ্গে। প্রখর মনোযোগ আর নতুন কিছু তৈরির আগ্রহের ফলে খুব অল্প বয়সে তাঁর ছিল তুখোড় মিউজিক সেন্স (সংগীতজ্ঞান)। তাঁর মায়াবী কণ্ঠের জাদুতে শ্রোতাদের মনের সব বন্ধ জানালা খুলে যেত। এতটাই দক্ষ ছিলেন যে কোনো গানের সবচেয়ে জটিল নোটটা সবার আগে ধরা দিত তাঁর কানে। 

স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকটি ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন হ্যাপী। ‘স্পন্দন’ ব্যান্ডের সঙ্গে কিছুদিন বাজিয়েছেন। সে সময় আজম খান ও লাকী-হ্যাপী আখান্দ ছিলেন সবচেয়ে আলোচিত মিউজিশিয়ান। হ্যাপী তখন ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ ব্যান্ডেও গাইতেন-বাজাতেন। এই ব্যান্ডের পূর্বনাম ছিল ‘আইওলাইটস’, যাদেরকে স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড বলা হয়। কিছুদিন পর ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ ভেঙে গেলে ১৯৭৯ সালে হ্যাপী গঠন করেন ‘মাইলস’। হ্যাপীর হাতে গড়ে ওঠা ‘মাইলস’ ব্যান্ডটি সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত তুমুল জনপ্রিয়।  মাইলস- নিয়ে জানতে

এখনকার মতো তখন এই সব বাদ্যযন্ত্র শেখার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল না। সবাই মিলে একসঙ্গে বসে শিখতেন, অনুশীলন করতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা কলকাতা—বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছে শিক্ষা নিয়েছেন এখনকার নামকরা অনেক মিউজিশিয়ানও। তখন যারা ব্যান্ড সংগীত চর্চা করতেন, তাঁরা বিভিন্নভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তাঁর কাছ থেকে।

জানা যায় আখান্দ ব্রাদার্স  কলকাতা গিয়েছিলেন একটা গানের রেকর্ডিংয়ে। তাঁদের কলকাতার এক বন্ধু এই দুই ভাইকে নিয়ে গেলেন সেখানে গান শুনতে। ব্যাকস্টেজে গিয়ে শিল্পীদের সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে হ্যাপী আখান্দ মঞ্চে একটা গান গাইতে চাইলেন। আয়োজকদের প্রথমে আপত্তি থাকলেও শেষমেশ রাজি হলেন তারা। মঞ্চে হ্যাপী উঠলেন গিটার নিয়ে, সঙ্গে কি–বোর্ডে তাঁর ভাই লাকী। তিনি প্রথমে গাইলেন একটি জনপ্রিয় ফোক গান, তারপর রাহুল দেব বর্মণের গান। দর্শক তখন মাতোয়ারা। দর্শকদের অনুরোধে গাইলেন নিজেদের গান। সেদিন হ্যাপী গান গেয়েছিলেন মোট ১১টি। এরপরও দর্শক অনুরোধ করছেন আরও গান গাইতে হবে। এরপর স্টেজ থেকে নামলে সবার সামনে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন রাহুল দেব বর্মণ।

একজন সুরকার, কি–বোর্ড বাদক, গিটার বাদক, সংগীত পরিচালক হ্যাপী আখান্দ এত সব দায়িত্বের কারণে খুব বেশি গান আমাদের জন্য রেখে যাননি। এ নিয়ে লাকী আখান্দ আজীবন আক্ষেপ করেছেন। নব্বই দশকের শুরুতে আদরের ছোট ভাই হ্যাপী আখান্দের গান দিয়ে ‘শেষ উপহার’ নামে অ্যালবাম বের করেছিলেন তিনি। হ্যাপীর স্মরণে ‘হ্যাপীটাচ’ নামে ব্যান্ডও বানিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর। হ্যাপীর কণ্ঠে জনপ্রিয় হওয়া গানগুলোর মধ্যে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘কে বাঁশি বাজায় রে’, ‘কে ওই যায়রে’, ‘নীল নীল শাড়ি পরে’, ‘খোলা আকাশ’, ‘তুমি কি দেখছ পাহাড়ি ঝরনা’, ‘এই পৃথিবীর বুকে আসে যারা’, ‘স্বাধীনতা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। 


সা/ই 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত