পানির অপচয়রোধে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর
প্রকাশ: ৪ এপ্রিল ২০২২, ১৩:৫৪ | আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪৪
পানির অপচয়রোধ ও পানির যত্নে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পানির অপচয় রোধ করতে হবে। আমাদের যে পানিসম্পদ আছে, সেটার যত্ন নিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মের ব্যবহার উপযোগী রাখতে হবে। পানিসম্পদ নষ্ট হয়ে গেলে কোনো সম্পদই থাকবে না।’
ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে সকল ক্ষেত্রে পানির অপচয় রোধ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আমাদের যত নদী, পুকুর, খাল, বিল, হাওর রয়েছে, তার সবগুলোতে যেন নাব্যতা থাকে। সেগুলো খনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। এর ফলে পানির উপর নির্ভরশীল জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে, মৎস্য সম্পদ বাড়বে, সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমবে এবং ভূগর্ভস্থ পানিধারক স্তর রিচার্জ হবে।
আজ সোমবার ‘বিশ্ব পানি দিবস ২০২২’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। রাজধানীর গ্রিন রোডে পানি ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্যার সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হবে, বন্যাকেই আপন করে নিতে হবে এবং বন্যার সঙ্গে বসবাস করার পদ্ধতিটাই আমাদের শিখতে হবে।
তিনি বলেন, 'আমরা প্রকৃতপক্ষে মিঠা পানির দেশ। তারপরেও জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি-৬ বাস্তবায়নের দিকে আমাদের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এসডিজির সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। ইতোমধ্যে স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি প্রায় ৯২ ভাগ সাফল্য অর্জন করেছি। আমাদের স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় সমগ্র বাংলাদেশেই এখন স্যানিটেশন, ল্যাট্রিন তৈরি করা হয়েছে। প্রকাশ্য ডেজার্টের খুব কমই দেখা যায়, সেটা নেই। কাজেই সেদিক থেকে আমরা যথেষ্ট অগ্রগামী।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'সুপেয় পানির জন্য আমরা বিভিন্ন ব্যবস্থা হাতে নিয়েছি। পানি ও জলের যে অভাব সারা বিশ্বব্যাপী রয়েছে, বিশেষ করে পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যেখানে সুপেয় পানি পাওয়া একান্ত কষ্টকর। তারা অনেক কষ্ট করছে এটা ঠিক। কিন্তু আমাদের বিশাল পানি সম্পদ রয়েছে। বিশ্বে প্রায় ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাবে আছে এবং ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি হতে বঞ্চিত এবং প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানীয় জলের অভাবে রয়েছে।'
শেখ হাসিনা বলেন, 'আমাদের এই সম্পদ যদি আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি, তাহলে আমাদের দেশের মানুষের আসলে এ কষ্ট কোনোদিনই হবে না। বরং আমরা বিশ্বকে পানি সরবরাহ করতে পারব। আমাদের সে বিষয়টা মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে। আমাদের দেশে বিভিন্ন সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা পানি ব্যবহার করে থাকি। আর ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপরও এখনো যথেষ্ট নির্ভরশীলতা রয়েছে। তবে বর্তমানে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই ঢাকা শহরে আমরা নদীর পানি পরিশুদ্ধ করে সরবরাহ করা শুরু করেছি। ঠিক সেভাবে জেলা-উপজেলায়ও আমরা সুপেয় পানি পাইপের মাধ্যমে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি, সেটাও আমরা নদীর পানি পরিশুদ্ধ করে দিচ্ছি। ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার সীমিত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ ইতোমধ্যে আমরা হাতে নিয়েছি।'
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে বন্যা হয়, বন্যায় ভাঙন হয়, অনেক সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার জন্য আমরা ড্রেজিংয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। ড্রেজিং শুধু নদীর নাব্যতাই বাড়াবে না, নদীর নাব্যতা যেমন বাড়াবে, আমাদের নৌপথগুলো সচল হবে, আমরা স্বল্পমূল্যে আমাদের পণ্য পরিবহন করতে পারব। আর নদীগুলো দীর্ঘদিন ড্রেজিং না হওয়ায় নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে, নদীর বিশালতা বেড়ে গেছে, এতো চওড়া নদী আমাদের প্রয়োজন নেই। এখানে বিভিন্ন পকেট তৈরি করে নদী ড্রেজিং করে ড্রেজিং করা পলি সেখানে ফেলে আমরা ভূমি উত্তোলন করতে পারি। আমি ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার পর থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে যথেষ্ট পরিমাণ ভূমি আমরা উত্তোলন করতে পেরেছি বা নদী রক্ষায় যে বাঁধ নির্মাণ, সেটিও নদী থেকে পলি উত্তোলন করে তা দ্বারাই সেটি করা যায়। চাষ উপযোগী জমি কখনো যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং ড্রেজিং করা পলি যেন চাষ উপযোগী জমিতে না পড়ে। তার জন্য আলাদা পকেট নদীতেই করা যাবে। কারণ এতো বিশাল বিশাল চওড়া নদী আমাদের সব জায়গায় প্রয়োজন নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নদী অনেক বেশি চওড়া, সেটাও যেমন লক্ষ্য রাখতে হবে, আর তাছাড়া জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ব্যবস্থা নিতে হবে।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'যখনই যেকোনো নির্মাণ হবে বা আমাদের কোনো প্ল্যান-প্রোগ্রাম নেওয়া হবে, প্রত্যেকটা প্রোগ্রামে এটা মাথায় রাখতে হবে যে, বন্যার সময় আমাদের যে পানি বহমান থাকে, সেটা যেন বহতা থাকে। একইসঙ্গে পানি যেন কোনোরকম বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে দেখতে হবে। ইতোমধ্যে আমরা ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশুদ্ধ করে ব্যবহার উপযোগী করায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি বলেই আমরা সেচ কাজেও সেভাবে পদক্ষেপ নিয়েছি। ইতোমধ্যে আমাদের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, আমাদের সারা বাংলাদেশে যত নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওর এবং বিশেষ করে ছোট ছোট জলাধারগুলো সংস্কারের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। বর্ষাকালে পানি এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা, এই পদক্ষেপ আমাদের সবসময় নিতে হবে, তাহলে আমাদের ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমে যাবে।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির বেশি ব্যবহার করার ক্ষতি আরও হবে এই কারণে যে, বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ একটি জায়গা। এই পানি আমাদের রক্ষা করে। আমাদের বাংলাদেশের নিচে বিশাল শিলা আছে, তার নিচে আরও বিশাল পানির স্তর আছে এবং এটাই কিন্তু আমাদের রক্ষা করছে। কাজেই সেখানে যদি আমরা ভূ-গর্ভস্থ পানি বেশি ব্যবহার করে ফেলি, তাহলে আমাদের ভূমিকম্প বেশি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। সেগুলো মাথায় রেখেই আমাদের সমস্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে সেসব ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি।'
শেখ হাসিনা বলেন, 'আমাদের যতগুলো জলাধার আছে, সবগুলো সংস্কার করা, এটা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেটি আরও উন্নীত করতে হবে এবং কাজ করতে হবে যাতে আমরা এই কাজগুলো করতে পারি। রাস্তাঘাট যখন নির্মাণ করা হবে, আমি বার বার বলেছি, সেই রাস্তা নির্মাণের সময় আমাদের পানির প্রবাহ যেন ঠিক থাকে, নৌ চলাচল যে ঠিক থাকে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করতে হবে। আর হাওড়-বাওর এলাকায় রাস্তা করলে সেগুলো মাটি ভরাট করে যেন না করা হয়, সেগুলো পিলার দিয়ে এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন পানির প্রবাহ কোনোমতেই বাধাগ্রস্ত না হয়। সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।'
তিনি বলেন, 'আর এই অপরিকল্পিত বাঁধ, যেখানে-সেখানে যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ বা বাঁধের উচ্চতা, আমি জানি- হয়তো একটু উঁচু হলেই বেশি পয়সা খরচ হয়, বেশি পয়সা খরচ হলে কিছু লোক কমিশন পাবে, এই ধরনের মানসিকতা পরিহার করতে হবে। দেশের জন্য কল্যাণকর যা, সেভাবে পরিকল্পনা নিতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা উপকূলীয় বাঁধগুলো যেমন শক্তিশালী করা, প্লাবনভূমির সঙ্গে নদীর সংযোগ যেন হয়, কারণ অনেকগুলো জায়গায়, এমনকি নদীর সঙ্গে যে সমস্ত খালের সংযোগ, সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই খালের সংযোগ খুলে দিতে হবে। নদীর সঙ্গে যদি খালগুলোর সংযোগ না থাকে বা জলাভূমিগুলো হাওড়-বাওর, এগুলো যদি সংযুক্ত না থাকে, তাহলে নদীর নাব্যতাও নষ্ট হয়ে যায়, সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'বন্যার সময় পানির ধারণক্ষমতা যেন থাকে, আমরা নদীর ড্রেজিং করার সময় যেমন নদীর নাব্যতা বাড়বে, আবার পাশাপাশি বন্যার সময় বাফারজোন রেখে দিতে হবে অতিরিক্ত পানি ধারণ যাতে করতে পারে। যেটা শীতকালে আমরা চাষ করতে পারি, কিন্তু বর্ষাকালে এটা পানির নিচেই থাকবে। বন্যার সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হবে। বন্যাকেই আমাদের আপন করে নিতে হবে এবং বন্যার সঙ্গে বসবাস করার পদ্ধতিটাই আমাদের শিখতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশ ব-দ্বীপ, বন্যার সময় পলি পড়ে। আমাদের সামনের অভিঘাত, তাতে আমাদের মতো বা ছোট ছোট দেশগুলোতে বা আইল্যান্ডগুলোতে যেভাবে লাগছে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের দেশকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে এবং সেজন্য যথাযথ পরিকল্পনা আমরা নিচ্ছি।'
তিনি বলেন, 'প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাতে আমরা মোকাবিলা করতে পারি, সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে বৃক্ষরোপণ, যেখানে সড়ক নির্মাণ করব তার দু-পাশে বৃক্ষরোপণ, অর্থাৎ বৃক্ষরোপণ করেই আমরা ভূমিধস থেকে মাটিগুলো সংরক্ষণ করতে পারি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য এবং এই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করার জন্য আমরা একটা পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারেটি প্ল্যান প্রণয়ন করছি এবং এসব বিষয়ে সেখানে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া আছে।'
শেখ হাসিনা বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সহিঞ্চু উন্নয়ন দর্শন গ্রহণ করেছে এবং অনেকেই এটা অনুসরণ করছে। তবে এটা যার যার দেশের অবস্থান থেকেই প্রণয়ন করে নিতে হবে। আমরা শুধু ধারণাটা তাদেরকে দিচ্ছি। উন্নয়ন দর্শনে নেচার বেসড সলিউশনে আমরা জোর দিয়েছি। পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলোতে প্রকৃতি নির্ভর ব্যবস্থাপনা কৌশল আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ সংক্রান্ত প্রণয়ন করেছি। আমাদের লক্ষ্য এই ব-দ্বীপটায় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন ভালোভাবে বাঁচতে পারে এবং এই দেশটা যেন উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে উঠে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা এই ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন করেছি এবং তার অনেক কিছু আমরা বাস্তবায়নও শুরু করেছি। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে যৌথভাবে আমরা এ ক্ষেত্রে কাজ করছি।'
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক, উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম ও সচিব কবির বিন আনোয়ার।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত