বিলুপ্তপ্রায় বাংলার এক গ্রাম্য সংস্কৃতি
পটের পাঁচালি
প্রকাশ: ৬ অক্টোবর ২০২১, ১১:১৭ | আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৫
নির্তেশ সি দত্ত
------------
'পটের পাঁচালি', আবহমান বাঙলার গ্রাম্য সংস্কৃতির এই বিষয়টি এখন প্রায় বিলুপ্ত। খুব ছোটবেলায় 'গাজীর পট' শোনার সৌভাগ্য আমার বেশ কয়েকবার হয়েছিল, খাঁটি 'গাজীর পটের' পাঁচালি। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিক্রমপুরের (মুন্সিগঞ্জে জেলা সদর) একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামের নাম রতনপুর। সেই গ্রামে গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে অচেনা কোনো এক সুদূর গ্রামগঞ্জ থেকে আসা লাল সালু কাপড় পরা একটা লোক কাঁধে কালো কাপড়ের লম্বা ঝোলা আর হাতে একটা ইয়া লম্বা লাঠি (বাঁশের শর) নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে 'গাজীর পটের' গান শুনিয়ে যেত আর বিনিময়ে সামান্য চাল-ডাল-সবজি বা সামান্য টাকা-পয়সা সংগ্রহ করতো। সম্ভবত তাই দিয়ে তার সংসার চলতো। বহুদূর থেকে হেঁটে আসা তার খালিপায়ে লেগে থাকা ধূলাবালিতে আমার চোখ আটকে যেতো।
তখনো ইস্কুলে যাওয়া শুরু হয়নি আমার। দুপুরের আগে আগে দ্বিপ্রহরে লোকটা বাড়িতে ঢুকেই হুংকার দিতো- 'জয় সত্য গাজীর জয়'। আমরা বুঝে যেতাম, 'গাজীর পট' আইছে। দৌড়ে ঘর থেকে উঠানে বেরিয়ে আসতাম। লোকটা কাঁধের ঝোলা নামিয়ে বলত, এক লোটা পানি দেন গো আম্মা। (লোটা মানে জল রাখার পিতলের পাত্র বিশেষ)। আমার ঠাম্মা এক লোটা জল এনে তার সামনে রাখতো। লোকটা খানিকটা জল উঠানের মাটিতে ঢেলে দিয়ে লোটাটা তার উপর রেখে তার পেছনে লম্বা লাঠিটির সরু অংশটি ভেজা মাটিতে পুঁতে দিত। তারপর তার ঝোলা থেকে একটা মসৃন লাঠিতে রোল করা বড়সড় একটা কাপড় (প্রায় একটা শাড়ির অর্ধেক সমান) খুলে পুঁতে রাখা লাঠিটির মাথায় ঝুলিয়ে দিতো। সেখানে সারি সারি অনেক ছবি আঁকা ছিল। হাতির ছবি, বাঘের ছবি, গরুর ছবি, মানুষের ছবি, আর বড় বড় কালো গোঁফওলা যম রাজার ছবি। রঙের পরত দেওয়ার কারণে কাপড়টি বেশ ভারি ও মোটা দেখাতো। তারপর লোকটা রোল করা কাপড়টির ভেতর হতে আগে থেকে বের করে রাখা সেই মসৃন লাঠি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা কাপড়টির ছবিগুলি একে একে নির্দেশ করে তার গাজীর পটের পাঁচালি সুর করে গাইতো। মাঝে মাঝে হাতের লাঠিটি দিয়ে কাপড়ের মধ্যে সজোরে আঘাত করে একধরনের রিদম তৈরি করতো আর বিশেষ রকমের অঙ্গভঙ্গিও করতো। তাঁর পাঁচালীর গান শুনে আমাদের বেশ আনন্দ হত। বছরে বড়জোর দু'একবার আসতো এই গাজীর পট। কয়েক বছর পরে কখন জানি লোকটির আসা বন্ধ হয়ে গেছিলো।
পরে জেনেছি গাজীর পট একটি বহু পুরোনো সংস্কৃতি। বাংলাদেশের পটশিল্পী সম্ভু আচার্য্য বলেন, 'পট আঁকা ঐতিহ্যটি আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রায় চার'শ বছরের পরম্পরা।' গাজীর পট যারা গাইতেন তারা পটশিল্পীদের কাছ থেকে কাপড়ের পটটি আঁকিয়ে আনতেন। পটশিল্পী সম্ভু আচার্য্যের পূর্ব-পুরুষরা ছিলেন এমনি একটি পটুয়া পরিবার। সেই ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছেন আমাদের বিক্রমপুরের পটশিল্পী সম্ভু আচার্য্য।
গাজীর পটে গাজীর পাঁচালি, লক্ষ্মীর পাঁচালি, সীতার পাঁচালি ইত্যাদি সুরে সরে গাওয়া হতো। সম্প্রতি লন্ডন ন্যাশনাল মিউজিয়ামের আমন্ত্রণে সেখানে গাজীর পটের পাঁচালি গেয়ে এসেছেন বিক্রমপুরের গায়েন মঙ্গল মিয়া ও তাঁর দল। সেখানে পট চিত্র অঙ্কন করেছেন পটশিল্পী সম্ভু আচার্য্য। সেসব লন্ডন ন্যাশনাল মিউজিয়ামের সংরক্ষিত হয়েছে।
বহুদিন পর ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর চারুকলার বকুলতলায় বিক্রমপুরের গায়েন মঙ্গল মিয়া ও তাঁর দলের 'গাজীর পটের' গান শুনেছিলাম।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত