ধারণার চেয়েও ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, সিডিসির নথি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২১, ১৮:০০ |  আপডেট  : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৬

করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনটি জলবসন্তের মতই সহজে ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং আগের ধরনগুলোর চেয়েও গুরুতর অসুস্থতার কারণ ঘটাচ্ছে বলে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের এক নথিতে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) একটি অভ্যন্তরীণ নথির বরাতে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের অতিসংক্রামক ডেল্টা ধরন টিকাপ্রাপ্ত এবং টিকাহীন সবার মাধ্যমেই প্রায় সমানভাবে ছড়াতে পারে।

সিডিসির অভ্যন্তরীণ একটি বৈঠকে পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইডে এই নতুন তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, কর্মকর্তাদের এটা স্বীকার করে নিতে হবে যে ‘লড়াইটা বদলে গেছে’।

সিডিসির ওই পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেনটেশনে নতুন যেসব তথ্যউপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে, তা শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হতে পারে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।

পত্রিকাটি লিখেছে, জনগণকে টিকা নিতে, মাস্ক পরাতে, সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মানাতে এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করাতে যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক শীর্ষ এ সংস্থাকে কতটা বেগ পেতে হচ্ছে, তা উঠে এসেছে ওই প্রেজেন্টেশনে।

নতুন গবেষণার ফলের বরাত দিয়ে সেখানে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়াতে পারে।

সিডিসির ওই নথিতে একটি জরুরি বার্তাও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, টিকা গ্রহণে উৎসাহিত করতে জনগণকে বার্তা পৌঁছানোর পদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে, কারণ অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরনটি প্রায় নতুন একটি করোনাভাইরাসের মত আচরণ করছে, এ ধরনটি এমনকি ইবোলা বা সাধারণ সর্দি-জ্বরের ভাইরাসের চেয়েও দ্রুততায় একজন থেকে আরেকজনে ছড়াচ্ছে। আর এ ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে টিকা নেওয়ার কোনো বিকল্প আপাতত নেই।

ওয়াশিংটন পোস্টের ওই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সিএনএন কথা বলেছে সিডিসির পরিচালক ড. রোচেলি ভেলেনস্কির সঙ্গে, যিনি ওই নথির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

সিএনএনকে তিনি বলেন, “আমি মনে করি মানুষের এখন বোঝা দরকার যে আমরা এখানে মায়াকান্না কাঁদছি না। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমাদের জানা অন্যতম অতিসংক্রামক একটি ভাইরাস এটা।”

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, টিকা পাওয়া এবং না পাওয়া- সবার জন্য চারদেওয়ালের ভেতরে লোক সমাগমস্থলে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা দিয়ে মঙ্গলবার যে নতুন নির্দেশনা সিডিসি জারি করেছে, তার মূল কারণ ওই নতুন গবেষণার তথ্য।

সিডিসি পরিচালক সিএনএনকে বলেছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মীসহ সবারই এখন মাস্ক পরা উচিত।

সিডিসির ওই প্রেজেন্টেশনের তথ্যউপাত্ত বলছে, ডেল্টা ধরনটি জলবসন্তের মতোই সংক্রামক, যেখানে সংক্রমিত একজন মানুষ গড়ে আরও আট থেকে নয়জনকে সংক্রমিত করতে পারে। করোনাভাইরাসের মূল ধরনটি এতটা সংক্রামক ছিল না, সেটা ছিল অনেকটা সাধারণ সর্দি-জ্বরের ভাইরাসের মত, যেখানে একজন সংক্রমিত ব্যক্তি গড়ে আরও দুইজনকে সংক্রমিত করতে পারে।

একটি ভাইরাসের এই সংক্রমিত করার ক্ষমতাকে গবেষকরা বলেন ‘আর জিরো’ । ভেলেনস্কি সিএনএনকে বলেছেন, আট বা নয় মাত্রার ‘আর জিরো’ আছে- এমন ভাইরাস খুব বেশি নেই।

বৃহস্পতিবার তিনি ব্যক্তিগতভাবে নতুন এই গবেষণার ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যদের জানিয়েছেন। সিডিসির গবেষণায় দেখা গেছে, টিকা পাওয়া কোনো ব্যক্তি যদি ডেল্টা ধরনে সংক্রমিত হন, তিনিও টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদের সমপরিমাণ ভাইরাস দেহে বহন করেন।

সান ফ্র্যানসিসকোর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব মেডিসিনের চেয়ারম্যান রবার্ট ওয়াচার ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, এই গবেষণাপত্রটি পড়ে তিনি অনেক বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

এই তথ্যউপাত্ত এখন সিডিসির কাজকে আরও বেশি কঠিন করে তুলেছে। তাদের এখন টিকার প্রমাণিত কার্যকারিতার ওপর জোর দিয়ে জনগণের সামনে তা প্রচার করতে হবে, যে টিকা গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু ঠেকাতে কতটা কার্যকর। তবে একইসঙ্গে এটাও স্বীকার করে নিতে হবে যে টিকা নেওয়ার পরেও লোকজন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কিছুটা অসুস্থ হতে পারে, এবং টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমেও ভাইরাস ছড়াতে পারে। ফলে বিধিনিষেধ সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।

ওই বৈঠকের একটি স্লাইডে দেখানো হয়েছে তরুণদের তুলনায় বৃদ্ধদের হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি, সেটা টিকা নেওয়া থাক বা না থাক। আরেকটি হিসাবে দেখানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ কোটি ২০ লাখ টিকাপ্রাপ্ত নাগরিকের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে ৩৫ হাজারের মধ্যে উপসর্গযুক্ত সংক্রমণ ধরা পড়ছে।

সিডিসির নথিতে এও জানানো হয়েছে, যেসব রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের জন্য এবং নার্সিং হোমের বাসিন্দাদের জন্য টিকা খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না। ফলে ঝুঁকিতে থাকা এই শ্রেণির জন্য অতিরিক্ত আরেক ডোজ টিকা দরকার হতে পারে।

জনগণ টিকা নেওয়ার পরেও সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনার খবর জানলে টিকার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যেতে পারে। সে কারণে রোগ প্রতিরোধের বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন কৌশল নির্ধারণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে সিডিসির নথিতে।

এমোরি ভ্যাকসিন সেন্টারের প্রধান ড. ওয়াল্টার ওরেনস্টাইন বলেন, “শেষ কথাটি হল, টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনে সংক্রমিত হলে তাদের দেহে ভাইরাসের পরিমাণ টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদের সমানই হয়। কিন্তু টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা অনেক বেশি নিরাপদ থাকেন বলে নথির তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে।

“টিকা ৯০ শতাংশের বেশি গুরুতর অসুস্থতা থেকে সুরক্ষা দেয়, তবে হয়ত সংক্রমণ রোধে তা কম কার্যকর। তাই টিকা দেওয়া হলেও নাগরিকদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াতে পারে।”

সিডিসির নথি বলছে, টিকা নিলে গুরুতর অসুস্থতা বা মৃত্যুর ঝুঁকি ১০ গুণ এবং সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি তিন গুণ কমে যায়।

কিন্তু এই নতুন গবেষণা টিকার মাধ্যমে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের লক্ষ্যটি আরও কঠিন করে তুলেছে বলে মনে করছেন সংক্রামক-ব্যাধি বিশেষজ্ঞরা।

আর সিডিসি বলছে, লড়াই যদি বদলে যায়, সেক্ষেত্রে সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাবটিও বদলে যাবে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত