দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটের অধিকাংশ ফেরির ফিটনেস নেই

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৪৮ |  আপডেট  : ১ মে ২০২৪, ১৬:১১

গত বুধবার সকালে কুয়াশায় আটকে থাকা ছোট ইউটিলিটি ফেরি রজনীগন্ধার তলা ফুটা হয়ে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটের অদূরে ৯টি ট্রাক নিয়ে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া রজনীগন্ধা ফেরিটিরও ফিটনেস ছিল না বলে ফেরিতে থাকা ট্রাক চালক ও হেলপাররা অভিযোগ করেছেন।

এর আগে, ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর ‘আমানত শাহ’ নামের একটি ফেরি ১৭টি যানবাহন নিয়ে দৌলতদিয়া থেকে ছেড়ে পাটুরিয়ার উদ্দেশে গেলে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরি ঘাটের কাছে ডুবে যায়। সেই ফেরিও ফিটনেসবিহীন ছিল। ফেরিটি প্রায় ৪১ বছরের পুরোনো ছিল। সর্বশেষ ২০১২ সালে ডকিং মেরামত হয়েছিল আমানত শাহ ফেরিটির। এরপর থেকে কোনো ফুল ডকিং করা হয়নি। এছাড়া কোনো সার্ভে সার্টিফিকেট ছিল না ফেরির। ফলে ফেরিটি চলাচলের অনুপযোগী ছিল।

জানা গেছে, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের অধিকাংশ ফেরির বয়স ৩৫ বছরের বেশি। রজনীগন্ধার বয়স ছিল ৪৭ বছরের বেশি। রো রো ফেরি ‘খান জাহান আলী’ তৈরি হয় ১৯৮৭ সালে। আরেক রোরো ফেরি ‘কেরামত আলী’ ৩৬ বছরের পুরোনো। ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’ ফেরি তৈরি হয় ১৯৯২ সালে।

বিআইডব্লিউটিসির একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিসির আওতাধীন ৫৩ ফেরির মধ্যে ৪৭টিরই সনদ নেই। বেশির ভাগই এসব ফেরির ৪০ বছরের বেশি পুরাতন। এছাড়াও ১৮টি রো রো ফেরির (বড় ফেরি) মধ্যে ১৪টিরই ফিটনেস সনদ নেই। এছাড়াও নেই বেশিরভাগ ফেরিতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি। অনেক ফেরির বয়স ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। আইন অনুযায়ী ৪০ বছরের বেশি বয়সী নৌযানের ফিটনেস সনদ দেয় না বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। তার পরেও চলছে ফেরি সার্ভিস। যার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা।

বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি ফেরিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফগ লাইট বসানো হয়। একেকটি ৭ হাজার কিলোওয়াটের লাইট কিনতে ৫০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়। বলা হয়েছিল, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। অথচ কয়েক দিন পরই অধিকাংশ লাইট নষ্ট হয়ে যায়। ‘খান জাহান আলী’, ‘শাহ আলী’, ‘কেরামত আলী’, ‘ভাষা শহীদ বরকত’, ‘কপোতি’, ‘বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন’, ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’, ‘শাহ আমানত’ ও ‘শাহ পরান’ ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট বসানো হয়। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ছোট-বড় ১৬টি ফেরি চলাচল করে। এসব ফেরিতে ১৭ থেকে ১৮শ যানবাহন পারাপার হয়। কিন্তু কুয়াশার কারণে প্রতিদিনই তিন থেকে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ থাকছে।

কয়েকজন ফেরিচালক জানান, প্রতিটি ফেরির বয়স ৩৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। নাব্যতা সংকটের কারণে ধীরে ধীরে চললেও কুয়াশার কারণে প্রতিদিনই ৬ থেকে ৯ ঘণ্টা ফেরি বন্ধ রাখতে হয়। ফগ লাইট লাগানো হলেও তা কাজে আসেনি। নদীপথ অস্পষ্ট হয়ে গেলেই ফেরি বন্ধ করে দেয় ঘাট কর্তৃপক্ষ। অথচ কোটি টাকা খরচ করে এই কুয়াশার কারণে ফেরিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফগ লাইট লাগানো হয়েছিলো যা কোনো কাজেই আসছে না। 

দুর্ঘটনার দিন রজনীগন্ধার আরোহী ছিলেন ট্রাকচালক আশিক। তিনি বলেন, ফেরিটির কোনো নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লাগেনি। তলা দিয়ে পানি ঢুকে কাত হয়ে ৯টি ট্রাক নিয়ে ফেরিটি ডুবে যায়।ফেরিটি অনেক পুরাতন ও ফিটনেসবিহীন ছিল। এছাড়াও ফেরি কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে রজনীগন্ধা ফেরিটি ডুবে যায়।

রজনীগন্ধা ফেরি ডুবির প্রত্যক্ষদর্শী আরেক ট্রাক চালক মজনু বলেন, রাতে দৌলতদিয়া থেকে রওনা হওয়ার পর মাঝ নদীতে এসে কুয়াশার কারণে ফেরি নোঙর করে রাখা হয়। পরে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ফেরিতে পানি উঠতে থাকে। এ সময় ফেরির লোকজন পানি নিষ্কাশন করার চেষ্টা করলেও ধীরে ধীরে ফেরিটির এক পাশ কাত হয়ে ডুবতে থাকে। একপর্যায়ে সকাল সোয়া ৮টার দিকে সব মালবাহী ট্রাক নিয়ে ফেরিটি পানিতে তলিয়ে যায়। এ সময় আমরা যে যার মতো জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে উঠি। ফেরিটির সঙ্গে কোনো বাল্কহেডের ধাক্কা লাগেনি।

এদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ ফেরির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশন। বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শাহ মোহাম্মদ খালেদ নেওয়াজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ নৌপথে মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো ফেরি নেই। ফেরি রজনীগন্ধার কাগজপত্র সব ঠিক ছিল, ফিটনেস ছিল, সার্ভে ছিল। অনেকেই বলেছে যে ফিটনেস ছিল না। তারা এটা না জেনে বলেছে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ৯টি রো রো ফেরি, ৩টি ইউটিলিটি ফেরি, ১টি কে টাইপ ফেরি ও ৩টি ছোট ফেরি রয়েছে। প্রত্যেকটি ফেরিরই ফিটনেস কাগজপত্র ঠিক রয়েছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) উপপরিচালক মো. শাহজাহান বলেন, এখন পর্যন্ত তিনটি যানবাহন উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় এসেছে। উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা, রুস্তম ও প্রত্যয়ের সমন্বয়ে ফেরিটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল বলেন, পাঁচ বছরে একবার ফেরির ডকিং করতে হয়। রজনীগন্ধার ২০২১ সালে ডকিং হয়। আর ফগ লাইটের বিষয়ে মন্ত্রী কথা বলেছেন, আমি কিছু বলব না। আর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর ফেরিডুবির কারণ সম্পর্কে বলা যাবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান ড. এ. কে. এম মতিউর রহমান বলেন, ফেরির ফিটনেস ও দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখা হবে।

এদিকে রজনীগন্ধার দ্বিতীয় মাস্টার (চালক) হুমায়ুন কবিরের সন্ধান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।তিনি বিআইডব্লিউটিসি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের আরিচা আঞ্চলিক কমিটির দক্ষিণ (পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া) শাখার সভাপতি।

সা/ই

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত