দরকার হলে এবারও মরমু তারপরেও সরকার নির্ধারীত দামে আলু বিক্রি করবনা- মুন্সিগঞ্জের আলু মজুতদার
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৬:১৯ | আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৭
তিন বছর লাখ লাখ টাকা লোকসান গুণছি তখন কেউ আমাদের খবর নেয়নাই।এবছর একটু লাভ হচ্ছে, সেগুলো সরকারের চোখে পড়ে গেছে।আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে। আলুর চাষ আর ব্যবসা কইরা অনেকবার মরছি। দরকার হলে এবারও মরমু।তার পরেও সরকারের দামে আলু বিক্রি করমুনা।
কথা গুলো বলছিলেন আলু মজুতদার ও কৃষক আব্দুস সাত্তার(৭০)।সোম বার বেলা ১ টার দিকে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার মুক্তারপুর এলাকার রিভারভিউ কোল্ডস্টোরেজে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে আক্ষেপের সঙ্গে এমনটাই বলেন আবদুস সাত্তার।
তিনি বলেন,সরকারের ইচ্ছে হলে আমাদের আলু নিয়ে যাক।তারা নিয়ে বিক্রি করুক,মানুষকে দিয়ে দিক, আমরা কিছু বলবোনা। শুধু আবদুস সাত্তারই নন,হিমাগারের অন্তত ১০-১৫ জন মজুতদার ও ব্যবসায়ির সঙ্গে কথা হলে একই কথা বলেছেন তারা।
তারা বলেন,দরকার হলে হিমাগারে রেখে আলু পচাঁবেন,তার পরেও সরকার নির্ধারিত ২৬-২৭ টাকা কেজি দামে আলু বিক্রি করবোনা। এটাই তাদের সাফ কথা।
গত বৃহস্পতিবার সরকার আলুর দাম খুচরা পর্যায়ে কেজি প্রতি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা এবং হিমাগার পর্যায়ে ২৬ থেকে ২৭ টাকা বেঁধে দেয়। তবে এটা মানেনি ব্যবসায়ীরা। খুচরা বাজারে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করেন তারা।গ্রামের বাজার ও দোকানগুলোতে বিক্রি হয় ৫০ টাকা কেজি দরে।
এর প্রেক্ষিতে গতকাল শনিবার মুন্সিগঞ্জের হিমাগারে পরিদর্শনে আসেন জাতীয় ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। হিমাগার পরিদর্শন শেষে রোববার থেকে পাকা রসিদের মাধ্যমে ২৬ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে এবং খুচরা বাজারে ৩৫-৩৬ টাকা বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেন মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে। তবে এ নির্দেশনা হিমাগার ও বাজার পর্যায়ের কোথাও বাস্তবায়ন হয়নি।
আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে সদর উপজেলার বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস কোল্ড স্টোরেজে গিয়ে দেখা যায় ব্যবসায়ীরা জটলা করে বসে আছেন। সেখানে কোনো ক্রেতা ছিল না। কাঙ্খিত দামে আলু বিক্রি করতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন মজুতদার ও ব্যবসায়ীরা।
এ কোল্ড স্টোরেজে ৪০৯ বস্তা আলু আছে হারুন ব্যাপারি নামের এক ব্যবসায়ির। হারুন বলেন,মৌসুমের শুরুতে যে আলু হিমাগারে ছিল সেগুলো বিক্রি করে দিয়েছি। গত কয়েক দিন আগে ৪০৯ বস্তা আলু ৩৭ টাকা কেজি দরে কিনেছিলাম। সরকার যদি ২৬-২৭ টাকা করে বিক্রি করতে বলে সেটা কি করে মেনে নিবো! আমাদের লোকসানের টাকা কে দিবে?আলু পঁচবে,তার পরেও বিক্রি করবোনা।
তবে এদিন রিভারভিউ কোল্ডস্টোরেজে গিয়ে দেখাযায়, সেখানকার হিমঘর থেকে আলু বের করে বাছাই করছেন শ্রমিকরা। বাছাই করা আলু বস্তা ভরে ট্রাকে তোলা হচ্ছিল। তবে এসব আলুর মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই চট্টগ্রামের আরতে পাঠাচ্ছেন বলে জানান ব্যবসায়িরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন গত বৃহস্পতিবার এর পর থেকে আমাদের এখানে আলু বিক্রি নেই। আজকে কয়েকশো বস্তা আলু হিমাগার থেকে বের হয়েছে। এগুলো চট্টগ্রামের আরতে যাবে। তবে এসব আলুর দাম এখানে নির্ধারণ করা হয়নি। আরতে যাওয়ার পরে দাম নির্ধারণ করা হবে।
এদিন এ হিমাগারে আলুর মজুতদার এবং ব্যবসায়ীদের নিয়ে ছোট্ট পরিসরে সভা করেন পঞ্চসার ইউপি চেয়ারম্যান ও রিভারভিউ হিমাগার মালিক গোলাম মস্তফা।সভায় কমপক্ষে ২৫-৩০ জন ব্যবসায়ি উপস্থিত ছিলেন।
সভার বিষয়ে গোলাম মোস্তফা বলেন,সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরা সম্মান করি। তবে যে দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে এ দামে আলু ব্যবসায়ীরা তাদের আলু বিক্রি করলে মোটা অংকের লোকসান গুনতে হবে। ব্যবসায়িদের নিয়ে ছিলাম। তারা চাচ্ছে জেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলে নতুন করে দাম নির্ধারণ অথবা নির্ধারিত দামে বিক্রি করলে যে ক্ষতিটা হবে, এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেবে কিনা।যদি সমোতা হয়,তবে ব্যবসায়িরা তাদের আলু বিক্রি শুরু করবেন।
খুচরা পর্যায়ে সরকারি বেঁধে দেওয়া দামে আলু বিক্রি হচ্ছেনা। সোমবার বেলা ১১ টার দিকে মুন্সিগঞ্জ বড়বাজারের সবজি দোকান গুলোতে ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ দোকানে আলু নেই। যেসব দোকানে আলু রয়েছে আকার-আকৃতি ভেদে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
এ সময় কথা হয় সবজি ব্যবসায়ি মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন সরকার যে দামে আলু বিক্রি করতে বলেছে, আমরা সে দামে আলু কিনতে পারছি না। বাজারে ভ্রাম্যমান আদালত আসতে পারে । এ ভয়ে আপাদত আলু বেচা-বিক্রি বন্ধ করে রেখেছি।
এই বাজারের একজন সবজি বিক্রেতারা অন্যান্য সবজির সাথে কয়েক বস্তা আলু মজুত করে রাখা ছিল । তিনি খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ৪৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছিলেন।
হাসান নামে ওই বিক্রেতার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, দুদিন আগে ৪১ টাকা করে আরত থেকে আলু কিনেছিলাম। সে আলু ৪৫ টাকা করে বিক্রি করছি। এর কমে বিক্রি করতে পারছিনা। বাজার পরিস্থিতি ঠিক হলে নতুন করে আলু কিনব। তখন কমদামে বিক্রি করতে পারবো।
মো. মিছর আলী দেওয়ান। তিনি হিমাগার থেকে আলু এনে প্রতিদিন সকালে মুন্সিগঞ্জ বর বাজারে পাইকারী দরে আলু বিক্রি করেন।
মিছির আলী বলেন,গত দুদিন ধরে সকালে পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি করতে পারছিনা। সরকার যে দাম বেঁধে দিয়েছে সে দামে হিমাগার থেকে কিনতে পারছিনা। খুচরা পর্যায়ে বেশি বিক্রি করতে পারবোনা। তাই আলু বিক্রি বন্ধ রেখেছিলাম। আজকে পেটের দায়ে হিমাগারে এসেছিলাম আলু কিনতে। তারা ৩৮ টাকার কমে আলু বিক্রি করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
সরকার একটা ঘোষণা দিলো।সে ঘোষণা কার্যকর করতে সরকারি পদক্ষেপ নেই হিমাগারে।এ অবস্থা চলতে থাকলে বাজারে মানুষ খাওয়ার আলুও পাবেনা।
শনিবার জতীয় ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সরকার নির্ধারিত দামে পাকা রশিদের মাধ্যমে হিমাগার থেকে আলু বিক্রি কররা বিষয়টি তদারকি করতে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন,গোয়েন্দা সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।মজুতদাররা নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি না করলে প্রশাসনকে আলু বিক্রি করার উদ্যােগ নিতে বলেন।
তবে রোববার সকাল থেকে এইপর্যন্ত হিমাগার গুলোতে জেলা প্রশাসনের কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এ বিষয়ে তদারকি করতে দেখা যায়নি।
হিমাগার তদারকি ও নির্ধারিত মূল্যে আলু বিক্রি বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাফর রিপনের মুঠোফোনে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) আফিফা খান বলেন, উন্নয়ন মেলা নিয়ে অনেক ব্যস্ত ছিলাম। এজন্য হিমাগারগুলো পরিদর্শন করা সম্ভব হয়নি।
আমরা হিমাগারগুলোতে যাব। সরকার নির্ধারিত মূল্যে যেহেতু আলু বিক্রি করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করব। কেউ যদি নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করতে না চায়, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিব।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর ভোক্তাদের মোট আলুর চাহিদা রয়েছে ৯৫ হাজার ৮৮ টন। সেখানে উৎপাদিত হয়েছে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৬৩ টন।জেলার ১৬০ টি হিমাগারে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মজুদ ছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ১৮২ টন আলু।
জাতীয় পর্যায়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার ৫০০ টন। দেশে আলুর চাহিদা ৭০ -৮০ লাখ টন। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকে ৩৬ লাখ টনের বেশি আলু।
তবে হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীদের দাবি হিমাগারে যে পরিমান আলু মজুত আছে তা ডিসেম্বরের আগেই শেষ হয়ে যাবে।এতে দেশে আলুর সংকট তৈরি হবে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত