টিসিবির পণ্য নিতে মধ্যবিত্তরাও লাইনে
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৪ | আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৩
মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা। রামপুরা বৌবাজার এলাকায় যাচ্ছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্যবাহী গাড়ি। পথ বাকি আধা কিলোমিটার। তখনও পেছনে ছুটছেন ১০ থেকে ১২ জন। যখন গাড়িটি নির্ধারিত জায়গায় থামলো, তখন ক্রেতা জড়ো হলো জনা পঞ্চাশেক।
এরপর লাগলো হুড়াহুড়ি। নিজের লাইন বুঝে পেয়েই বেশিরভাগ ক্রেতার কানে ফোন। তারা পরিচিত অন্যদের ফোন দিচ্ছেন। প্রায় সবার মুখে একই কথা ‘বৌবাজার টিসিবি এসেছে, তাড়াতাড়ি আসো।’
সরেজমিনে দেখা গেলো, লাইনে বেশ কয়েকজনের পোশাক-আশাক বেশ ভালো। মনে হয়নি গরিব মানুষ। এরপর কথা হয় সিরাজুল ইসলাম নামে একজনের সঙ্গে। তিনি পাশের এলাকায় কুঞ্জবনে থাকেন। জানালেন, রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে গাড়ি দেখে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা। আগে কখনো এভাবে পণ্য কেনেননি।
যেখানে টিসিবির গাড়ি দাঁড়িয়েছে, সেখানেই নবীনগর ফার্নিচার নামে একটি দোকান। ওই দোকানের মালিকও দাঁড়িয়েছেন ওই লাইনে। সঙ্গে কয়েকজন কর্মচারীও এসেছেন পণ্য নিতে।
তখন লাইনে একজন বলেই ফেললো, হাজি সাহেবের তো বাড়িও আছে। তারপরেও টিসিবির পণ্য খেতে হবে! তবে ওই দোকানি তখন কোনো উত্তর দেননি।
এটি টিসিবির বিশেষ সেল। ফ্যামিলি কার্ড ছাড়া এখানে ট্রাকসেলে পণ্য বিক্রি হয়। যে কারণে পণ্যের তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা বেশি। ফলে সবাইকে পণ্য দেওয়া যায় না।- ডিলার হাবিবুর রহমান
শুরুতে যখন টিসিবির গাড়ি এসেছিল, তখন সেখানে প্রত্যেক ক্রেতাকে সিরিয়ালের টোকেন দিয়েছিলেন ওই এলাকার মুদি দোকানি শফিকুল ইসলাম। তিনি প্রায় অধিকাংশ মানুষকে চেনেন। জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পণ্যের দামের চোটে এখন লাজলজ্জা ফেলে সবাই টিসিবির পণ্য নেয়। এমনকি বড়লোকও খোঁজ পেলে ড্রাইভার-কাজের লোক দিয়ে পণ্য নিয়ে যায়। এ লাইনেও এমন অনেকে আছে।
শফিকুল তখন ১১২ জন পুরুষ ও ১৬৫ জন নারীকে টোকেন দিয়েছেন। এরপর টিসিবির ডিলার চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের হাবিবুর রহমান তাদের মধ্যে পণ্য বিক্রি শুরু করেছেন। এরপরও আর কারও পণ্য কেনার সুযোগ ছিল না। টিসিবির ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরে গেছেন অনেকে।
ডিলার হাবিবুর রহমান বলেন, এটি টিসিবির বিশেষ সেল। ফ্যামিলি কার্ড ছাড়া এখানে ট্রাকসেলে পণ্য বিক্রি হয়। যে কারণে পণ্যের তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা বেশি। ফলে সবাইকে পণ্য দেওয়া যায় না।
টিসিবির সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর ৫০টি স্থানে এভাবে ফ্যামিলি কার্ড ছাড়া বিশেষ ট্রাকসেলে পণ্য বিক্রি করে টিসিবি। প্রতিটি ট্রাকে ৩৫০ জনের জন্য পণ্য থাকে। তবে অধিকাংশ জায়গায়ই এর চেয়ে ১০০ থেকে ১৫০ জন বেশি মানুষ উপস্থিত থাকে। যাদের পণ্য দেওয়া যায় না।
আরেক বিক্রেতা এনামুল বলেন, মারামারিও হয় লাইনের মধ্যে। যে কারণে টোকেন দিয়ে সিরিয়াল দেওয়া হয়। তারপরেও প্রচুর চাপ সামলাতে হয়।
টিসিবির ওই বিক্রি কার্যক্রম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে বেশ কয়েকবার ডিলার হাবিবুর রহমানকে বলতে শোনা যায়, ‘লাইন সোজা করেন, হুড়াহুড়ি করলে মাল (পণ্য) দেবো না। গরু-ছাগলের মতো লাইনে কেউ মাল পাবে না।’
সেখানে একজন ক্রেতা ইয়াকুব বলেন, নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে এ অবস্থা। সবাই টিসিবির পণ্য চায়, পেলে স্বস্তি। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা অমানবিক।
ওই বিক্রি কার্যক্রম প্রায় তিন ঘণ্টা চলে। তাতে নানান অস্বস্তি দেখা যায় ক্রেতাদের মধ্যে। রুস্তম আলী খানের বয়স সত্তরের বেশি। তিনি পাশের একটি চায়ের দোকানে পাউরুটি খেতে খেতে বলেন, ঠিক নামাজ পড়ে বাসায় ঢুকছি, বউ পাঠিয়ে দিছে। বাড়ি গেলে সিরিয়াল থাকবে না। তাই রুটি খাই, ভাত খেতে পারিনি।
দুই ঘণ্টা দাঁড়ালে একটা ট্রিপ মিস হবে। কিন্তু পণ্য পেলে ৪শ টাকা সাশ্রয় হবে। তাই যেখানে টিসিবি বা ওএমএস পাই, কিনি।– ক্রেতা বায়জিদ মুন্সি
কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির পণ্য কিনতে ট্রাকের সামনে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। পাশে সিএনজি অটোরিকশা রেখে একজন লাইনে দাঁড়িয়েছেন। বায়জিদ মুন্সি নামে ওই চালক জাগো নিউজকে বলেন, দুই ঘণ্টা দাঁড়ালে একটা ট্রিপ মিস হবে। কিন্তু পণ্য পেলে ৪শ টাকা সাশ্রয় হবে। তাই যেখানে টিসিবি বা ওএমএস পাই, কিনি।
একজন আইসক্রিম বিক্রেতাও আছেন। তিনি বলেন, গাড়ি দেখলে পেছনে পেছনে ছুটে আসে মানুষ। আর এখন ফোনের যুগ। শুধু একটা ব্যাগ কিনে আনতে আনতে ২৬ জনের পেছনে সিরিয়াল চলে গেছে। মৌমাছির মতো মানুষ আসে। কোথা থেকে আসে আল্লাহ জানে।
টিসিবির ট্রাক থেকে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি মসুর ডাল, পাঁচ কেজি চাল ও তিন কেজি আলু কিনতে পারছেন। বাজারে সম্প্রতি আলুর দাম বেড়েছে। এজন্য আলু বিক্রি শুরু করেছে টিসিবি।
এসব পণ্যের মধ্যে প্রতি লিটার ভোজ্যতেল ১০০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৬০, চাল ৩০ টাকা ও আলু ৪০ টাকায় কেনা যায়। এই চার পণ্য কিনতে একজন গ্রাহককে দিতে হচ্ছে ৫৯০ টাকা। খুচরা বাজার থেকে এসব পণ্য কিনতে লাগে প্রায় ১ হাজার টাকার মতো। অর্থাৎ টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনলে অন্তত ৪শ টাকার বেশি সাশ্রয় হয়।
এ পণ্য কিনতে এমন অনেক মানুষও দাঁড়িয়েছেন যারা নিয়মিত ক্রেতা নন। ফরিদ উদ্দিন নামে এক ব্যাংক কর্মচারী বলেন, জীবনে প্রথম দাঁড়াইছি। কাজ নেই। ভাবলাম দাঁড়িয়ে থাকি, যদি পাওয়া যায় তবে ভালো।
বেশ দূরে একজন ভালো পোশাকের নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবে তার দৃষ্টি সব সময় টিসিবির ট্রাকের দিকে। এগিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ছেলেকে দাঁড় করাইছি। লজ্জা লাগে, আর মেয়েদের মধ্যে যে ঠেলাঠেলি। মেয়েদের লাইনও বড়।
মূলত বাজার খরচ থেকে কিছু টাকা বাঁচাতেই দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়ানোর কষ্ট করেন নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ। সঙ্গে এখন মধ্যবিত্তরাও। যদিও এখনো টিসিবির ট্রাকের পেছনে গৃহকর্মী, রিকশাচালক ও দিনমজুরের উপস্থিতি বেশি। তবে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও ব্যবসায়ীদেরও লাইনে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে।
ওই বাজারের একজন পাইকারি পণ্য ব্যবসায়ীও ছিলেন লাইনে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, জীবনে তিনবার টিসিবি নিয়েছি। এক বছর পর দেড়মাস আগে একবার। এরপর আজ। তবে পণ্য পেলে খুব সুবিধা হয়। ২শ টাকার তেলে ১৫ দিন চলে যায়, যা বাজার থেকে কিনলে ৩৬০ টাকা লাগে। ডালেও ১২০ টাকা সাশ্রয় হয়, একমাস চলে যায়।
জীবনে প্রথম দাঁড়াইছি। কাজ নেই। ভাবলাম দাঁড়িয়ে থাকি, যদি পাওয়া যায় তবে ভালো।- ব্যাংক কর্মচারী ফরিদ উদ্দিন
আবার নিম্ন আয়ের কালাম বলেন, আমার কাছে দুই কেজি আলু কেনা আর একটা মুরগি কেনা সমান কথা। বাজারে দুই কেজি আলু ১৬০ টাকা। এখানে ৮০ টাকা।
এদিকে ওই সময় টিসিবির ট্রাকের পাশে পণ্য ভাগাভাগি করতে দেখা যায় এক নারীকে। জিজ্ঞাস করলে সেজমা আক্তার নামে ওই নারী জানান, যাকে পণ্য দিচ্ছেন তিনি তার মা। তার মা পণ্য পায়নি। যে কারণে নিজের থেকে অর্ধেক চাল, আলু ও ডাল দিয়েছেন।
সেজমা বলেন, ট্রাক দেখে মাকে ফোন দিয়েছি। আসতে আসতে সিরিয়াল শেষ। তাই আমার ভাগের থেকে দিলাম (টিসিবির পণ্য)। মা আমার পাশাপাশি থাকে। বাবা কর্মক্ষম হওয়ার পরও কাজ করে না। অভাবের সংসার সবাই মিলে চালাতে হয়।
টিসিবির পণ্য নিতে মধ্যবিত্তরাও লাইনে
এদিকে এত ভিড়ে সিরিয়ালের শেষের মানুষদের পণ্য পেতে অপেক্ষা করছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবে এসব মানুষের অভিযোগ শোনার যেমন কেউ ছিল না, তেমনি কোথায় অভিযোগ করবেন, সেটাও তাদের জানা নেই। আবার অভিযোগ করেও লাভ নেই, কারণ ডিলার ও তাদের প্রতিনিধিরা এ পুরো সময় পণ্য বিক্রিতে হিমশিম খাচ্ছিল। অনেকেই সহযোগিতা করেছে তাদের। আবার এর মধ্যে ওই এলাকার রাস্তায় বড় লাইনের কারণে যানজটও হয়েছে, হর্নের শব্দে মাঝে মধ্যেই কান ঝালাপালা হয়েছে তাদের।
তারপরও কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে শেষমেশ পণ্য পেয়ে সব আক্ষেপ ভুলে যাচ্ছেন। স্বস্তির আভাই দেখা যাচ্ছে তাদের চোখে–মুখে।
খালেদা আক্তার নামে একজন বৃদ্ধা শেষে বলে গেলেন, ‘মাল পাইছি এটাই বড়। এখন আর কোনো কষ্ট নেই। অর্ধেক মাসের কোনো চিন্তা নেই।’
সৌজন্যেঃ জাগো নিউজ
কা/আ
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত